ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শিক্ষকতার পাশাপাশি কেঁচো সার উৎপাদন করছেন শাহেনা 

মো. মামুন চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৪, ১৮ জুলাই ২০২১   আপডেট: ১১:৩৭, ১৮ জুলাই ২০২১
শিক্ষকতার পাশাপাশি কেঁচো সার উৎপাদন করছেন শাহেনা 

মাটির পানি ধারণক্ষমতা ও বায়ু চলাচল বাড়াতে পাঁচ ভাগ জৈব পদার্থ থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে রয়েছে এক দশমিক আট থেকে দুই ভাগ। জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়াতে পচা আবর্জনা, সবুজ সারের যেমন ভূমিকা, কেঁচো বা ভার্মি সারের ভূমিকাও তেমনি অসামান্য। তরিতরকারির ফেলে দেওয়া অংশ, ফলমূলের খোসা, উদ্ভিদ বা লতাপাতা, পশুপাখির নাড়িভুঁড়ি, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, ছোট ছোট করে কাটা খড়কুটো খেয়ে কেঁচো জমির জন্য সার তৈরি করে। এ সার সব ধরনের ফসল ক্ষেতে ব্যবহার করা যায়।

তাই এ সার হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে উৎপাদন হচ্ছে। জেলার বাহুবলে উপজেলা পর্যায়ে প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য কৃষক প্রশিক্ষণ (৩য় পর্যায়) প্রকল্পের মাধ্যমে কেঁচো বা ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করছেন কৃষক-কৃষাণীরা। পরে এ সার জমিতে প্রয়োগ করে চাষিরা বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন করছেন।

বাহুবল উপজেলার দ্বিমুড়া কৃষি ব্লকের ভুলকোট গ্রাম পরিদর্শনকালে কথা হয় মোছা. শাহেনা আক্তারের সাথে। তিনি বলেন, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা শামীমুল হক শামীম আমাদের এখানে এসে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরিতে পুরুষ ও নারীদের উৎসাহ দিচ্ছেন। ফলে বাড়ি বাড়ি ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি হচ্ছে। এগুলো জমিতে প্রয়োগ করায় সম্ভব হচ্ছে কীটনাশকমুক্ত ফসল উৎপাদন।

তিনিও (শাহেনা) শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজের ঘরের পাশে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করে সফলতা পেয়েছেন। প্রায় ১ বছরে ৩০ মণ কেঁচোসার উৎপাদন করেছেন। এ সার প্রতি কেজি ২০টায় বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় কৃষকরা তার কাছ থেকে এ সার ক্রয় করে নিয়ে জমিতে প্রয়োগ করছেন। এতে করে বিষমুক্ত ফসলের চাষ করে তারা (কৃষকরা) লাভবান হচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা শামীমুল হক শামীম বলেন, শাহেনা ব্র্যাকের স্কুলে শিক্ষকতা করেন। অবসর সময়ে তিনি বাড়িতে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করছেন। এতে তিনি সফলতা পেয়েছেন। প্রকল্পের প্রযুক্তি গ্রহণ করে বাড়ি বাড়ি ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন হচ্ছে। এ সার চাষিরা জমিতে প্রয়োগ করছেন। এতে উৎপাদন হচ্ছে কীটনাশকমুক্ত ফসল।

তিনি জানান, ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচোসারে মাটির পানি ধারণ করার ক্ষমতা ও মাটি নরম করার ক্ষমতা রাখে। এছাড়া এতে আছে আটাশি দশমিক ৩২ ভাগ জৈব পদার্থ, এক দশমিক ৫৭ ভাগ নাইট্রোজেন, এক দশমিক ২৬ ভাগ বোরন। এগুলো অন্যান্য জৈব সারে এত বেশি পরিমাণে নেই। কেঁচোসার ব্যবহার করলে চাষের খরচ কম হয়। উৎপাদিত ফসলের বর্ণ, স্বাদ, গন্ধ হয় আকর্ষণীয়। ফসলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে। ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচোসার উৎপাদন করতে গভীর মাটিতে যে ছাই রঙের কেঁচো পাওয়া যায় সেগুলো না নিয়ে বরং মাটির ওপর স্তরে থাকা লাল রঙের কেঁচো খুবই ভালো। 

এছাড়া সার উৎপাদনের আলাদা কেঁচোও পাওয়া যায়। কেঁচোসার উৎপাদনের জন্য ছায়াযুক্ত স্থানে প্রথমে কোমর সমান গর্ত করে তাতে দুটো স্যানেটারি রিং বসিয়ে দিতে হয়। গর্তের তলার কিছু অংশ শুকনো ঝুরা মাটি দিয়ে ভরে দিতে হয়। তার ওপর বিছাতে হয় কুচি কুচি করে কাটা খড়কুটো, তার ওপর আবার ঝুরা মাটি, ঝুরা মাটির ওপর পচা আবর্জনার স্তর। আবর্জনার ওপর ঝুরা মাটির স্তর দিতে হয় আরও একবার। এবার মুরগির বিষ্ঠার একটি স্তর করে নিতে হয়। বিষ্ঠার ওপর আবার ঝুরা মাটি। শেষের স্তরে দিতে হয় গোবর। ঝড়-বাতাস আর বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে ওপরে দিতে হয় ছাউনি। 

এভাবে তিন মাস রেখে দিলেই পাওয়া যায় কেঁচোসার। অন্যভাবেও কেঁচোসার উৎপাদন করা যায়। এ ক্ষেত্রে ছায়াযুক্ত স্থানে পলিথিন ব্যাগে আবর্জনা রেখে দিতে হয়, যাতে তা পচতে পারে। সাত-আট দিন পর পলিথিন বিছিয়ে দুটি রিং স্লাব পরপর সাজিয়ে তার ভেতর পচা এ আবর্জনা দ্বিগুণ পরিমাণ গোবরের সঙ্গে মিশিয়ে রেখে দিতে হয়। কেঁচো কম্পোস্ট সার ব্যবহারে উৎপাদন ও ফসলের গুণাগুণ বৃদ্ধি পায়। তুলনামূলকভাবে উৎকৃষ্ট ও বড় আকারের ফল বা সবজি পাওয়া যায়। মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর ফলে কেঁচোসার ব্যবহারে সেচের পানি কম লাগে। ক্ষারীয় লবণাক্ত মাটিতেও চাষাবাদ সম্ভব। 

ফসলে রোগ ও পোকা-মাকড়ের উপদ্রব কম হয়। জমিতে আগাছার প্রকোপ কম হয়। ফসলের বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বাড়ে। অধিক কুশি, অধিক ছড়া ও দানা গঠন হয়। উন্নত হয় মাটির বুনট। রাসায়নিক সারের চেয়ে খরচ অনেক কম হয়। পরিবেশও দূষণমুক্ত থাকে। এ সারে গাছের অত্যাবশ্যকীয় ১৬টি খাদ্য উপাদানের ১০টিই বিদ্যমান। এ ছাড়া এর মধ্যে গাছের অত্যাবশ্যকীয় কয়েকটি হরমোন ও এনজাইম রয়েছে যা গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও ফলের বর্ণ, গন্ধ, স্বাদসহ অন্যান্য গুণগত মান উন্নত রাখে।

বাহুবল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল আউয়াল বলেন, বৃষ্টিনির্ভর ফসল তিল, মুগ, ছোলা, মাসকলাই, জোয়ার, বাজরা, সরিষাসহ কম পুষ্টি চাহিদাসম্পন্ন ফসলে রাসায়নিক সার ছাড়াই একর প্রতি মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ কেজি কেঁচো কম্পোস্ট সার ব্যবহার করে অধিক ফলন পাওয়া যায়। সূর্যমুখী, বার্লি, ভুট্টা ও গম জাতীয় ফসলে কৃষকরা সাধারণত হালকা সেচ, রাসায়নিক সার ব্যবহার করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে একরপ্রতি মাত্র ৭০০ থেকে ৮০০ কেজি কেঁচো কম্পোস্ট সার ব্যবহার করে অধিক ফলন পাওয়া যায়। আমাদের দেশের কৃষকরা কেঁচো কম্পোস্ট সার ব্যবহার করে কম খরচে অধিক ফলন ঘরে তুলতে পারেন। এতে জমি রাসায়নিক সারের হাত থেকে রক্ষা পাবে এবং উর্বরতা বজায় থাকবে। কেঁচোকে জীবিত ও সক্রিয় রাখতে হাউসে বেশি পানি দেওয়া যাবে না, আবার পানি শুকিয়ে ফেলাও যাবে না।

হবিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. তমিজ উদ্দিন খান বলেন, এ সার ব্যবহারে ফসলের উৎপাদন খরচ কমে। সব ফসলেই এটি ব্যবহারযোগ্য। বেলে-দোআঁশ মাটিতে এর কার্যকারিতা বেশি। ফলদ গাছ বা উঁচু জমির ফসলে পর পর তিনবার কেঁচো সার ব্যবহার করলে ডিম থেকে উৎপন্ন কেঁচো ওই স্থানে নিজে থেকেই সার উৎপাদন করতে থাকে। ফলে পরবর্তী দু-তিনটি ফসলে সার ব্যবহার না করলেও চলে। জৈব পদার্থ দিয়ে সাধারণ সার তৈরির পরিবর্তে কেঁচোসার তৈরি করলে এর পুষ্টিমান ৭ থেকে ১০ গুণ বাড়ে।

হবিগঞ্জ/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়