ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

 ‘মাদক ব্যবসা ছেড়ে আমি সফল খামারি’

মঈনুদ্দীন তালুকদার হিমেল, ঠাকুরগাঁও   || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৫, ১৭ নভেম্বর ২০২১   আপডেট: ০৮:০৫, ১৮ নভেম্বর ২০২১
 ‘মাদক ব্যবসা ছেড়ে আমি সফল খামারি’

ঠাকুরগাঁও জেলায় পরিচিত একটি নাম মাজেদ। সদরের রায়পুর ইউনিয়নের বাসিন্দা তিনি। একসময় জেলার মানুষ তাকে নামকরা মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে চিনলেও এখন তার পরিচয় একজন সফল খামারি। ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রমে সুন্দর-সফল জীবনের উদাহরণ হয়েছেন এই মানুষটি।

কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, অভাবের তাড়নায় একসময় মাদক ব্যবসা শুরু করেন তিনি। নিজের পরিচিতি থাকায় এবং তার অবস্থান শহরের নিকটে হওয়ায় খুব দ্রুতই বিক্রি বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে জেলার সবচাইতে বড় মাদক বিক্রিতা বনে যান। তবে এই নিষিদ্ধ ব্যবসার কারণে মামলায় পড়তে হয় তাকে। ব্যবসা প্রসারের সাথে সাথে বাড়তে থাকে মামলার পরিমাণ। একপর্যায়ে তিনি ১২টি মামলার আসামি হয়ে যান।

মাজেদ একসময় বুঝতে পারেন যে, এই ব্যবসা থেকে যথেষ্ট টাকা আয় হলেও মামলা চালাতে গিয়ে আয়ের বড় অংশই খরচ হয়ে যায়। সঙ্গে সর্বদা আতঙ্ক আর অশান্তি তাকে অস্থির করে ফেলে। সমাজেও তিনি খারাপ একটি পরিচয় বহন করায় মানুষ তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করছেন। সমাজের প্রতিটি উৎসব ও অনুষ্ঠানে তিনি গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছেন। তাই তিনি এই মদক জগৎ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ঝুলে থাকা ১২টি মাদক মামলা আর সমাজের অগ্রহণযোগ্যতা তার পিছুটান হয়ে দাঁড়ায়।

মাজেদ বলেন, আমি মাদক ব্যবসা ছাড়তে চাইলেও পারছিলাম না। পরে একসময় আমাকে আমাদের ইউপি চেয়ারম্যান ডেকে পাঠান এবং এই নিষিদ্ধ ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। আমি তার সিদ্ধান্তে সম্মান জানিয়ে আমার সমস্যাগুলোর কথা তুলে ধরি। তিনি প্রতিটি সমস্যায় তার সর্বাধিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। পরে চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় মাদক ব্যবসা ছেড়ে একটি ব্রয়লার মুরগির খামার দিয়ে পথচলা শুরু করি। ধন্যবাদ চেয়ারম্যান সাহেবকে।

সেই রায়পুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, মাজেদের মাদক ব্যবসার কারণে আমাদের এলাকাটা মাদকের আখড়া হয়ে গেছিল। ইউনিয়নের মানুষ এটা নিয়ে আমার কাছে বারবার অভিযোগ করে। তাই আমি ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই মাদক কারবার নির্মূলের সিদ্ধান্ত নেই। আমি চাইছিলাম মাজেদ এই নিষিদ্ধ ব্যবসা ছেড়ে ভালো পথে ফিরে আসুক। তাকে জেলে দিয়ে লাভ নেই। বের হয়ে আবার ব্যবসা শুরু করবে। তাছাড়া ছেলে হিসেবে সে বেশ ভদ্র ছিল। তাই তাকে বুঝিয়ে ও সহযোগিতা করে একটি ব্রয়লার খামার শুরু করাই।

ইউনিয়নের বাসিন্দা সাদেকুল বলেন, একসময় এই ইউনিয়নের বাসিন্দারা এলাকার পরিচয় দিতে লজ্জা পেতো। মাদক এলাকা নামেই এটার পরিচর পেয়েছিল। আমাদের মেয়ে-ছেলেকে বিয়ে দিতে পারতাম না। রায়পুর শোনবার সাথে সাথেই প্রস্তাব ফিরে যেতো। তবে এখন আমরা বেশ ভালো আছি, শান্তিতে আছি।

বয়লার খামারে সফলতার বিষয়ে মাজেদ বলেন, আমি প্রথমে একটি মুরগির ফার্মে মাংস উৎপাদন নিয়ে ব্রয়লার পালন শিখে আসি। তারপর অল্প পুঁজি নিয়ে ছোট করে খামার প্রকল্প শুরু করে আস্তে আস্তে চার বছরে আমার খামারে এখন একসাথে দেড় হাজার বয়লার মুরগি পালিত হচ্ছে।

এখনও আমার ৫টি মাদক মামলা ঝুলে আছে। কয়দিন পর পর আদালতে হাজিরা আর উকিলের পেছনে টাকা খরচ আমার জন্য অনেক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনোভাবে যদি এই মামলাগুলো থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আর সরকারিভাবে সহযোগিতা পাই, তাহলে আমি ব্যবসা আরও প্রসার করতে পারবো। সেইসঙ্গে অন্য তরুণদের মুরগি পালনের একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে চাই। কারণ, আমি চাই না আর কেউ আমার মতো ভুল পথে পা বাড়াক।

মাজেদকে নিয়ে কথা হয় তার প্রতিবেশী রোহান রাজের সঙ্গে। তিনি বলেন, একসময় মাজেদের কারণে নিজেদের সন্তানের বিপথে যাওয়ার আতঙ্কে থাকতাম। মাজেদ থেকে দূরে রাখতাম। কিন্তু এখন আমাদের সন্তানদের সেই মাজেদকে দেখিয়েই অনুপ্রেরণা দেই। মাজেদ যদি তরুণদের নিয়ে কাজ করে, তাহলে আমরা অবশ্যই অনেক উপকৃত হবো।

ঠাকুরগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু তাহের সামসুজ্জামান বলেন, মাজেদের বিষয়টি শুনে বেশ ভালো লাগলো। তার জন্য শুভকামনা। তার সবরকম সহযোগিতায় ঠাকুরগাঁও উপজেলা প্রশাসন পাশে থাকবে।

/মাহি/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়