‘চর এবার হামার কপাল খুলি দিছে’
আমিরুল ইসলাম, রংপুর || রাইজিংবিডি.কম
‘সর্বগ্রাসী তিস্তার বালুচর এবার হামার (আমাদের) কপাল খুলি দিছে বাহে। বালু চরোত এবার যে ফসল হইছে, তা গত এক যুগেও হয় নাই। দুই বিঘা গম আবাদ করিয়া এখন শেষ সময়ে ফসল দেখি মোর (আমার) মন খুব খুশি। এই চরোত প্রত্যেক বার গম ফলার চেষ্টা করছিনু, তেমন ফলন হয় নাই কিন্তু এবার গমের গাছ (উচ্চতা) মোর বুক থাকি হইছে। গমের দানাযুক্ত শিষগুলাও ভালো। এবারের ফলনে চর হামার কপাল খুলি দিছে বাহে’, কথাগুলো বলেন কৃষক জিতেন্দ্র নাথ (৬০)।
তিনি বালাপাড়া ইউনিয়নের তালুক শাহাবাজ এলাকার বাসিন্দা। কাউনিয়ার তিস্তায় জেগে ওঠা চরে অন্যান্য ফসলের সাথে দুই বিঘা গম চাষ করে ফলন দেখে খুশি হয়েছেন তিনি।
জিতেন্দ্র নাথ বলেন, এই সর্বগ্রাসী তিস্তা প্রতিবার হামাক কান্দায় এবারও কান্নার পর বালুচরে গম চাষ করেছি। ফলন দেখি এখন খালি আফসোস করছি যে, ক্যা আরও বেশি জমিত গম আবাদ করলাম না। ৩৩ শতকের বিঘায় আমার খরচ হয়েছে গড়ে ৫ হাজার টাকা কিন্তু সেখানে ফলনের আশা ১৫ থেকে ১৮ মণ গমের। বিঘা প্রতি ২০ হাজার টাকা লাভ হবে বলে বিশ্বাস করি।
পাঁচ মাস আগেও তিস্তায় ভেসেছে জনপদ। গ্রাস করেছিল গ্রামের পর গ্রাম। কেড়ে নিয়েছিল কৃষকের স্বপ্ন। কিন্তু মাস ঘুরতেই সেই সর্বনাশী তিস্তা হয়েছে শুকিয়ে খাঁ খাঁ। পলি ভরাট ধু ধু বালুচরে ফের জিতেন্দ্র নাথের মতো শত শত কৃষক নানা ফসল চাষ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। সেসব ফসলের বাম্পার ফলন দেখে খুশি তারা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ সূত্রে জানা যায়, জেলায় এবার ২ হাজার ২২০ হেক্টর জমিতে গমের চাষাবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৮ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে এবার চরাঞ্চলে বন্যা পরবর্তী ফসল হিসাবে প্রায় ৫ শত হেক্টর জমিতে গমের চাষ হয়েছে।
কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের তিস্তার ঢুষমারা, শাহবাজ, হরিশ্বর চর ঘুরে দেখা যায় বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে গম, পেঁয়াজ, মিষ্টি কুমড়াসহ অন্যান্য ফসলের সবুজ সমারোহ। প্রখর রোদকে উপেক্ষা করে ফসলের হারভেস্ট ও শেষ সময়ে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে কৃষকরা। বাম্পার ফলন দেখে আশায় বুক বেঁধে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে অবিরাম পরিচর্যা করে যাচ্ছে ফসলের। বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে হাসি থাকলেও দাম আর সময়মতো ফসল ঘরে তোলা নিয়ে রয়েছে তাদের দুশ্চিন্তাও।
চর ঘুরে কথা হয় নজরুল ইসলাম নামের আরেকজন কৃষকের সঙ্গে। নজরুল ইসলাম এবার চরে ৪০ শতক গম আর ২৪ শতক মিষ্টিকুমড়া চাষ করেছেন। দাম নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, গতবার গমের ফলন ভালো হয়নি, তবে দাম মোটামুটি ভালো ছিল। আর মিষ্টি কুমড়ার ফলন ভালো হয়েও সস্তা দরে বিক্রি করতে হয়েছে। এবারে মিষ্টি কুমড়ার দাম কেজিতে ১০ থেকে ১২ টাকা থাকলে লাভবান হবে বলে জানান নজরুল। আর গমের ফসল শেষ সময়ে আবহাওয়া ভালো থাকলে ঠিকঠাকমতো ঘরে তুলতে পারলেই চিন্তামুক্ত।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (উদ্যান) কৃষিবিদ শামিমুর রহমান বলেন, এবার জেলায় ২ হাজার ২২০ হেক্টর জমিতে গমের চাষ হয়েছে। এতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ হাজার ৯৯২ মেট্রিক টন। এসব জমির কৃষককে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক পরামর্শ ও কৃষি উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে। গতবারের চেয়ে এবার গমের ফলন ভালো আশা করা যাচ্ছে। ফ্রেশ আবাদি জমির পাশাপাশি বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলের সাদা বালুচরেও গমের ফসল চাষে কৃষকের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে এবং সেখানেও এবার গমের বাম্পার ফলন হয়েছে বলেও জানান তিনি।
/মাহি/
আরো পড়ুন