ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

অটোইমিউন রোগ সম্পর্কে ১০ বিস্ময়কর তথ্য

এস এম গল্প ইকবাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩১, ৮ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অটোইমিউন রোগ সম্পর্কে ১০ বিস্ময়কর তথ্য

প্রতীকী ছবি

এস এম গল্প ইকবাল : অটোইমিউন রোগ হলো এমন দশা যেখানে একজন লোকের ইমিউন সিস্টেম ভুলবশত তার শরীরকে আক্রমণ করে। আরো সহজ ভাবে বললে, বাইরের কোনো ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণুর প্রভাব ছাড়াই রোগ সৃষ্টি হয় কারণ শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা কোনো সুস্থ কোষকে ক্ষতিকর মনে করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

সাধারণত ইমিউন সিস্টেম ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের মতো জীবাণু থেকে আমাদেরকে সুরক্ষা দেয়- যখন ইমিউন সিস্টেম বুঝতে পারে যে শরীরে আক্রমণকারী প্রবেশ করেছে, তখন এটি এসব শত্রুকে আক্রমণ করতে অ্যান্টিবডি নিঃসরণ করে। সাধারণত ইমিউন সিস্টেম শত্রু কোষ ও সুস্থ কোষের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে।

কিন্তু অটোইমিউন রোগের ক্ষেত্রে ইমিউন সিস্টেম শরীরের কোনো অংশকে শত্রু ভেবে ভুল করে এবং অটোঅ্যান্টিবডি নামক প্রোটিন নিঃসরণের মাধ্যমে সুস্থ কোষকে আক্রমণ করে। কিছু অটোইমিউন রোগ কেবলমাত্র একটি অর্গানকে টার্গেট করে, যেমন- টাইপ ১ ডায়াবেটিস অগ্ন্যাশয়কে ড্যামেজ করে। আবার কিছু অটোইমিউন রোগ পুরো শরীরকে প্রভাবিত করে, যেমন- সিস্টেমিক লুপাস এরিথিম্যাটোসাস। এখানে অটোইমিউন রোগ সম্পর্কে ১০ তথ্য তুলে ধরা হলো।

* ইমিউন সিস্টেম সেনাবাহিনীর মতো

ইমিউন সিস্টেম অ্যান্টিবডি নিঃসরণ করে রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব থেকে আমাদেরকে সুরক্ষিত রাখে। অ্যান্টিবডি হলো রক্তের প্রোটিন যা কোনো ঝুঁকি বা আক্রমণকারীকে নিষ্ক্রিয় করে। এটিকে বলা হয় ইমিউন রেসপন্স। কলাম্বিয়া লুপাস সেন্টারের পরিচালক আঙ্কা আসকানাসি বলেন, ‘ইমিউন সিস্টেম মানুষের জীবনের শৈশবের বছরগুলোতে কে বন্ধু কে শত্রু তা নিরূপণে ব্যস্ত থাকে, তাই এটি আপনাকে আক্রমণকারী থেকে রক্ষা করতে পারে।’ কিন্তু কখনো কখনো ইমিউন সিস্টেম সুস্থ কোষকে আক্রমণকারী ভেবে ভুল করে এবং এসব কোষকে আক্রমণ করতে অ্যান্টিবডি পাঠায়- অটোইমিউন রোগের ক্ষেত্রে এটাই হয়ে থাকে। সুস্থ কোষের ওপর এ আক্রমণ শরীরের যেকোনো স্থানে হতে পারে, যেমন- ত্বকে আক্রমণ হলে সোরিয়াসিস হয় ও থাইরয়েডে আক্রমণ হলে হ্যাশিমোটো’স রোগ হয়।

* অটোইমিউন রোগ পরিবারে বহমান থাকে

চিকিৎসকরা জানেন যে, অটোইমিউন রোগের পেছনে বংশগত উপাদানের ভূমিকা থাকে এবং কিছু নির্দিষ্ট জাতির লোকের মধ্যে কিছু অটোইমিউন রোগ অধিক কমন। উদাহরণস্বরূপ, লুপাস (শরীরের সর্বত্র যন্ত্রণাদায়ক ও ধ্বংসাত্মক প্রদাহ) নামক রোগটি আফ্রিকান-আমেরিকান, হিস্পানিক, এশিয়ান ও ন্যাটিভ আমেরিকান নারীদের বেশি হয় এবং ককেশিয়ানদের মধ্যে টাইপ ১ ডায়াবেটিস (যেখানে অগ্ন্যাশয় খুবই অল্প ইনসুলিন উৎপাদন করে অথবা একটুও উৎপাদন করে না)। সম্প্রতি চিকিৎসা বিজ্ঞানে আবিষ্কৃত হয়েছে যে, একটি একক জিন ভিন্ন লোকের ক্ষেত্রে ভিন্ন রোগ সৃষ্টি করতে পারে, যেমন- সন্তানের ক্রন’স ডিজিজ (যা পরিপাকতন্ত্রকে আক্রমণ করে) থাকতে পারে, যেখানে একই জিন মায়ের মধ্যে অ্যালোপেসিয়া (এ দশার ক্ষেত্রে ইমিউন সিস্টেম চুলের গ্রন্থিকোষকে টার্গেট করে) সৃষ্টি করতে পারে। এনওয়াইইউ ল্যানগোনের অন্তর্গত জুডিথ অ্যান্ড স্টুয়ার্ট কল্টন সেন্টার ফর অটোইমিউনিটির পরিচালক টিমোথি বি. নিওল্ড বলেন, ‘কিছু জিন একাধিক রোগের ঝুঁকি বহন করে এবং কিছু জিন কেবলমাত্র একটি রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।’ পরিবেশও একটি ভূমিকা পালন করে- আমরা যা খাই ও ব্যবহার করি তার মাধ্যমে কেমিক্যাল ও পরিবেশ দূষণকারী পদার্থের সংস্পর্শে আসলে। ডা. নিওল্ড বলেন, ‘উদাহরণস্বরূপ, আমরা জানি যে ধূমপান রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি দ্বিগুণ বৃদ্ধি করে এবং ব্যক্তিভেদে ভিন্ন মাত্রার সংবেদনশীলতা থাকতে পারে।’

* অটোইমিউন রোগের উপসর্গ হঠাৎ করে প্রকাশ পায়

কোনো অসম্পৃক্ত অসুস্থতার পর অটোইমিউন রোগের আবির্ভাব হতে পারে, এমনকি ফ্লু’র মতো কমন রোগও, তাই বিজ্ঞানীরা ভাইরাস বা ইনফেকশন এ রোগের ট্রিগার বা প্ররোচক হতে পারে কিনা জানতে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। লুপাস, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস ও অন্যান্য অটোইমিউন রোগের সঙ্গে এপস্টেইন-বার ভাইরাসের (ইবিভি) যোগূসত্র আছে কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অধিকাংশ লোক জীবনের কোনো না কোনো সময় ইবিভি’র সংস্পর্শে আসে এবং এটি শরীরে সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে। গবেষণা ধারণা দিচ্ছে যে, ইবিভি কিছু লোকের সেসব জিনকে সক্রিয় করতে পারে যার সঙ্গে অটোইমিউন রোগের সম্পৃক্ততা রয়েছে এবং তাদের মধ্যে লুপাস, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস ও অন্যান্য অটোইমিউন রোগ বিকশিত হতে পারে।

* নারীদের অটোইমিউন রোগ বেশি হয়

নারীদের মধ্যে এ রোগ বেশি হওয়ার কারণ স্পষ্ট নয়। ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের স্কিন মলিকিউলার ইমিউনোলজির অধ্যাপক জোহান গুডজনস বলেন, ‘আমরা বলতে পারি যে নারীদের ইমিউন রেসপন্স পুরুষদের তুলনায় শক্তিশালী, কারণ পুরুষদের ক্যানসার ও ইনফেকশন নারীদের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি হয়। এই শক্তিশালী রেসপন্সে উপকার ও অপকার উভয়ই হতে পারে: এটি সুরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এটি নারীদের ইমিউন সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়।’

* কিছু অটোইমিউন রোগের উপসর্গ একইরকম

ডা. আসকানাসি বলেন, ‘কিছু অটোইমিউন রোগের একইরকম উপসর্গ রয়েছে এবং এসব উপসর্গের অনেকগুলোই অন্য কারণেও প্রকাশ পেতে পারে। অটোইমিউন রোগের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষণ হলো ক্লান্তি, কিন্তু চিকিৎসকরা অতি পরিশ্রমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মনে করে এ লক্ষণকে উপেক্ষা করতে পারেন। প্রায় ১০০টি পরিচিত অটোইমিউন রোগ রয়েছে এবং অধিকাংশই একই উপসর্গ প্রকাশ করে: ডায়রিয়া (সেলিয়াক রোগ, ক্রন’স রোগ, আলসারেটিভ কোলাইটিস), ক্লান্তি (সেলিয়াক রোগ, ফাইব্রোমায়ালজিয়া, গিলেন-বেয়ার সিন্ড্রোম, লুপাস, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস), চুল পড়ে যাওয়া (অ্যালোপেসিয়া, হ্যাশিমোটো'স রোগ, স্ক্লেরোডার্মা), জয়েন্ট ব্যথা (রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস) এবং র‍্যাশ (ডার্মাটাইটিস, লুপাস, সোরিয়াসিস)।

* সংবেদনশীল পাকস্থলি অটোইমিউন দশার লক্ষণ হতে পারে

বিশ্বের সর্বত্র পেটের সমস্যা দেখা যায়। প্রায়ক্ষেত্রে ভাইরাস অথবা কিছু খাবার খাওয়ার কারণে পেটে সমস্যা হয়ে থাকে। কিন্তু পেটের সমস্যা অনবরত ভোগালে অথবা মাঝেমাঝে তীব্রমাত্রায় রূপ নিলে এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য উপসর্গ, যেমন- মলের সঙ্গে রক্ত, পেট ব্যথা, রাতে ঘাম নিঃসরণ ও জ্বর, থাকলে এটি ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম (আইবিএস) হতে পারে- আইবিএস হলো অটোইমিউন ডিসঅর্ডারের একটি গ্রুপ যা ডাইজেস্টিভ ট্র্যাক্টে ক্রনিক প্রদাহ সৃষ্টি করে। অন্যান্য অটোইমিউন রোগের সঙ্গেও গ্যাস্ট্রিক সমস্যার যোগসূত্র থাকতে পারে, কারণ ইমিউনিটি নিয়ন্ত্রণকারী ৭০ শতাংশ কোষের অবস্থান আমাদের অন্ত্রে। ইয়েল ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা লুপাসের মতো অটোইমিউন রোগ ও ত্রুটিপূর্ণ আন্ত্রিক বেষ্টনির (যা অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াকে অন্যান্য অঙ্গে যাওয়ার সুযোগ দেয়) মধ্যকার যোগূসত্র নিয়ে গবেষণা করছেন।

* অত্যধিক পরিচ্ছন্নতা ইমিউন সিস্টেমের জন্য ভালো নয়

আমাদের ঘর ও হাত পরিষ্কারের জন্য অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল প্রোডাক্টের ওপর অতি নির্ভরশীলতা ইমিউন সিস্টেমকে পরিপক্ব হয়ে ওঠতে দেয় না। একটি বহুল বিতর্কিত স্বাস্থ্য তত্ত্ব হলো: ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও অন্যান্য জীবাণুযুক্ত দশার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে ইমিউন সিস্টেম উন্নত হয়। এ তত্ত্ব অনুসারে, যেসব শিশুদেরকে অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য কেমিক্যালের সংস্পর্শে অতি পরিষ্কৃত পরিবেশে রাখা হয় তাদের ইমিউন সিস্টেম তুলনামূলক নির্বোধ থেকে যায় অর্থাৎ ইমিউন সিস্টেমের পক্ষে কে আপন কে পর তা বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে শরীরকে কোনো মারাত্মক অণুজীব আক্রমণ করলে ইমিউন সিস্টেম বুঝতে পারে না যে কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে এবং এটি ভুলপথে পরিচালিত হয়।

* অটোইমিউন রোগ নির্ণয়ের জন্য কোনো পারফেক্ট টেস্ট নেই

সেই রোগের জন্য টেস্ট ডেভেলপ করা কঠিন, যেখানে আপনি জানেন না যে কি কারণে রোগটি হচ্ছে। ডা. নিওল্ড বলেন, ‘অটোইমিউন রোগ নির্ণয়ের জন্য এখনো কোনো পারফেক্ট টেস্ট নেই। লুপাসের জন্য অ্যান্টিনিউক্লিয়ার অ্যান্টিবডি (এএনএ) চেক করা যেতে পারে। যদি আপনার লুপাস থাকে, তাহলে এএনএ টেস্ট পজিটিভ হবে। কিন্তু অন্যান্য দশার অনেক লোকের ক্ষেত্রেও পজিটিভ রেসপন্স পাওয়া যেতে পারে, এমনকি কিছু সুস্থ লোকের ক্ষেত্রেও।’ কোনো অটোইমিউন রোগ শনাক্ত করতে চিকিৎসকদের অনেকগুলো বিষয় বিবেচনা করতে হয়। রোগীর শারীরিক উপসর্গ, উপসর্গের তীব্রতা, পারিবারিক ইতিহাস ও এএনএ ব্লাড টেস্ট বিবেচনা করতে হবে।

* অটোইমিউন রোগ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকরা স্পষ্ট উপসর্গ খুঁজেন

অটোইমিউন দশার একটি প্রাথমিক ইঙ্গিত হলো, ভালো অনুভব না করা এবং কি কারণে এমনটা হচ্ছে তা স্পষ্টভাবে বুঝতে না পারা। অধিকাংশ চিকিৎসক রোগীর মধ্যে নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট উপসর্গ না দেখলে উপেক্ষা করেন অথবা রোগনির্ণয়ে ভুল করেন অথবা রোগীকে সাইকোলজিস্টের কাছে রেফার করেন। সাধারণত বেশিরভাগ চিকিৎসক ক্লান্তি, কুয়াশাচ্ছন্ন মস্তিষ্ক ও হরমোনের হ্রাসবৃদ্ধিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেন না, তারা ধরে নেন যে কিছু সাধারণ কারণে এসব উপসর্গের প্রকাশ ঘটছে। ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের এন্ডোক্রিনোলজিস্ট মেরি ভয়ুক্লিস বলেন, হ্যাশিমোটো’স থাইরয়েডাইটিসের উপসর্গকে পেরিমেনোপজ বা ডিপ্রেশন মনে করে ভুল হতে পারে। এছাড়া অনেক অটোইমিউন রোগের উপসর্গ আসে-যায় চক্রের মধ্যে থাকে।

* অটোইমিউন রোগ সম্পর্কে গবেষণা চলমান রয়েছে

যেহেতু অটোইমিউন রোগ সম্পর্কে এখনো সবকিছু জানা যায়নি, তাই গবেষকরা এ বিষয়ে গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন। ডা. নিওল্ড বিশ্বাস করেন যে, অটোইমিউন রোগের উৎপত্তি হয় ইনফেকশনের বিরুদ্ধে লড়তে শরীরের কার্যকর ভূমিকার অতিবিকাশ থেকে, তাই বিজ্ঞানীরা ইমিউন সিস্টেমকে পুনঃনির্দেশনা দিতে উপায় খুঁজছেন। তিনি যোগ করেন, ‘ইমিউন সিস্টেম কোন কোষগুলোকে আক্রমণ করতে হবে তা ভালোভাবে মনে রাখতে পারে। এখন আমাদেরকে জানতে হবে যে ইমিউন সিস্টেম সুস্থ অর্গান ও টিস্যুকে টার্গেট করলে তা কিভাবে পুনঃনির্দেশনা দেয়া যায়। এ বিষয়ে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। আমরা জিন থেরাপি ও টিকা ডেভেলপের চেষ্টা করছি।’

তথ্যসূত্র : প্রিভেনশন


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ জুলাই ২০১৯/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়