ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে ধারাবাহিক: পর্ব-৪

ডা. সজল আশফাক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ১৯ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে ধারাবাহিক: পর্ব-৪

ডেঙ্গুজ্বর নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা

ডেঙ্গু নির্ণয়ে বেশি টেস্ট করার প্রয়োজন নেই, প্রথম দিকে এনএস-১ অ্যান্টিজেন, সিবিসি এবং প্লাটিলেট কাউন্ট করলেই যথেষ্ট। রক্তের ডেঙ্গু ভাইরাস এন্টিবডি পরীক্ষার মাধ্যমেও ডেঙ্গুজ্বর নির্ণয় করা যায়।

এনএস-১ অ্যান্টিজেন: ২০০৬ সালে থেকে এই টেস্টের প্রচলন শুরু হয়, বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে এই পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষাটি ডেঙ্গু নির্ণয়ে শতকরা ৯০ ভাগ সংবেদনশীল এবং শতকরা ৬০-৮০ ভাগ সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারে।  এনএস-১ অ্যান্টিজেন পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গুজ্বর হয়েছে কিনা দ্রুত বোঝা যায়। এনএস-১ অ্যান্টিজেন ডেঙ্গুজ্বরের প্রথম দিন থেকে ৪র্থ দিন পর্যন্ত পজেটিভ থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথম ৪৮ ঘণ্টায় পরীক্ষা করলে তা পজিটিভ আসে। এজন্য জ্বরের প্রথম দিনেই এনএস-১ অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করানো উচিত। তবে জ্বরের ঠিক শুরুতে রক্ত পরীক্ষা করালে রিপোর্ট স্বাভাবিক থাকবে এবং তা রোগ নির্ণয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে।

প্লাটিলেট কাউন্ট: অতিপিরিচিত টেস্ট। প্লাটিলেটকে বাংলায় বলা হয় অণুচক্রিকা। এটি রক্ত জমাট বাধতে সাহায্য করে। তাই এটির উপস্থিতি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কম থাকলে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থাকে। ডেঙ্গুজ্বরে প্লাটিলেটের সংখ্যা কমে যায়। প্লাটিলেটের সংখা স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকলেই যে রক্তক্ষরণ হবে এমন নয়। অনেক কমে গলে রক্তক্ষরণ হয়। সংখ্যায় কমে কতটা হলে রক্তক্ষরণ হবে সেটাও রোগীভেদে ভিন্ন হতে পারে। প্লাটিলেটের স্বাভাবিক সংখ্যা দেড় লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ। প্লাটিলেট কাউন্ট ডেঙ্গজ্বর হওয়ার ৪ বা ৫ দিন পর কমতে শুরু করে, তাই জ্বর শুরুর ৪-৫ দিন পর রক্ত পরীক্ষা করা উচিত।

এন্টি ডেঙ্গু অ্যান্টিবডি: শরীরে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধক ক্ষমতা তৈরি হতে কয়েকদিন সময় লাগে। ৪ থেকে ৬ দিন পর এন্টি ডেঙ্গু অ্যান্টিবডি টেস্ট করা যেতে পারে। আইজিএম এবং আইজিজি এই ধরনের ডেঙ্গু এন্টিবডি রয়েছে।

আইজিএম ইমিউনোগ্লোবুলিন: এই এন্টিবডি ডেঙ্গু রোগীর শরীরে তৈরি হতে সময় নেয় ৫ থেকে ৭দিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জ্বর শুরু হওয়ার ৬ষ্ঠ দিন পরে এটি পজিটিভ আসে। এটি পজিটিভ হওয়া মানে রোগী অতিসাম্প্রতিক ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত।

এন্টি ডেঙ্গু আইজিজি: এটির মাধ্যমে বোঝা যায় যে রোগীর ইতোপূর্বে ডেঙ্গু হয়েছিল কিনা। মারাত্মক হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বরের ক্ষেত্রে সাধারণত আইজিজি পজেটিভ পাওয়া যায়।

ডেঙ্গু রোগীর কি প্রতিদিনই প্লেটিলেট এবং পিসিভি টেস্ট করা উচিত?

হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গুজ্বরের রোগীকে প্রতিদিন কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয়। এর উদ্দেশ্য রোগীর অবস্থা সম্পর্কে জেনে নেয়া। প্রয়োজনীয় এই পরীক্ষার মধ্যে রয়েছে রক্তের প্লেটিলেট এবং পিসিভি টেস্ট।

রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে এই পরীক্ষা দুটি নিয়মিত করতে হয়। এ দুটি পরীক্ষার উপরই রোগীর চিকিৎসা কি হবে তা অনেকটা নির্ভর করে। কাজেই সিদ্ধান্ত নেবেন চিকিৎসক, অযথা বারবার পরীক্ষা করা অনেক ক্ষেত্রেই দরকার হয় না।

ডেঙ্গুজ্বরের চিকিৎসা পদ্ধতি

ডেঙ্গুজ্বরের এখনো কোনো কার্যকরী চিকিৎসা বের হয়নি। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বর সাধারণত এমনিতেই ৭ দিনের মধ্যে সেরে যায়। এই ক্ষেত্রে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। যেমন ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল, বমির জন্য বমিরোধক ওষুধ দেয়া হয়। এছাড়া ডেঙ্গুজ্বরে প্রচুর পানি পান করতে হবে। প্রয়োজনে শিরা পথে স্যালাইন দিতে হবে।

তবে সেরে যাওয়ার পর রোগীর দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা, বিষণ্নতা দেখা দিতে পারে। এগুলোও পরবর্তীতে সেরে যায়। ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এবং হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বর হয়েছে সন্দেহ হলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিতে হবে। হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বরের রোগীর প্লেটিলেট কাউন্ট কমে যেতে পারে। প্লেটিলেট কাউন্ট কমে গেলে রোগীকে রক্ত দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু প্লাটিলেট দিতে হয়। আর যদি রোগীর প্রত্যক্ষ রক্তক্ষরণ, যেমন-রক্তবমি হওয়া, পায়খানার সাথে কালো রংয়ের রক্ত যাওয়া, নাক দিয়ে প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষরণ হওয়া ইত্যাদি উপসর্গ থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে রোগীকে রক্ত দেয়া যেতে পারে।

চিকিৎসায় সতর্কতা, কখন হাসপাতালে ভর্তি হবেন?

যখন চারিদিকে ডেঙ্গুজ্বর হচ্ছে তখন নিশ্চিত না হয়ে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ব্যথা বা জ্বর কমানোর ওষুধ খাওয়া উচিত নয়। এত রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়তে পারে। ডেঙ্গুজ্বরের রোগীর ব্যথার জন্য এসপিরিন জাতীয় ওষুধ দেয়া যাবে না। কারণ এতে রক্তক্ষরণের প্রবণতা বেড়ে যায়। তাছাড়া ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত বাচ্চাকে এসপিরিন দিলে রাইসিনড্রোম নামক মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। ডেঙ্গুজ্বরের রোগীকে রক্ত দেয়ার ব্যাপারেও সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। যেমন শুধু প্লেটলেট কাউন্ট কম দেখা গেলে অর্থাৎ রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক থাকলে এবং রোগীর প্রত্যক্ষ রক্তক্ষরণ না থাকলে সে ক্ষেত্রে রোগীকে রক্তের পুরো উপাদান (হোল ব্লাড) না দিয়ে প্লেটলেট ট্রান্সফিউশন করতে হবে। এ অবস্থায় রক্তের পুরো উপাদান দেয়া হলে রোগীর হেমোকনসেনট্রেশন হয়ে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি ফুসফুসে পানি জমে যেতে পারে। তবে প্রত্যক্ষ রক্তক্ষরণ থাকলে এবং রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম থাকলে রক্ত দেয়ার কথা বিবেচনা করতে হবে।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়