ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘ভিটামিন সি’ করোনার সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়?

এস এম গল্প ইকবাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:১২, ৪ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘ভিটামিন সি’ করোনার সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়?

ভালোই চলছে করোনার দিনকাল। ইতোমধ্যে ভাইরাসটি ১০ লাখের বেশি মানুষকে আক্রমণ করেছে এবং ৫৮ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে। সচেতন মানুষ ঘর থেকে অপ্রয়োজনে বের হচ্ছেন না। তারা সোশাল মিডিয়ার ব্যবহার, টিভি দেখা, প্রার্থনা ও অন্যান্য উপায়ে সময় কাটাচ্ছেন।

সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাসটি সম্পর্কে অনেক তথ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকে নিশ্চিত না হয়ে এসব তথ্য শেয়ার করছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া তেমন একটি তথ্য হচ্ছে, লেবুর রস তথা ভিটামিন সি করোনার সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়। কিন্তু এর সত্যতা কতটুকু? আসলেই কি ভিটামিন সি করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে? এর সপক্ষে কি বৈজ্ঞানিক প্রমাণ রয়েছে?

ফেসবুক ও মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া এ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাজারে লেবুর দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে, ভিটামিন সি করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে পারে। চিকিৎসক ও গবেষকরা নতুন করোনাভাইরাসের ওপর ইন্ট্রাভেনাস ভিটামিন সি (শিরাপথে সরবরাহকৃত ভিটামিন সি) এর উচ্চ ডোজের প্রতিক্রিয়া জানতে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ফলাফল হাতে না আসা পর্যন্ত আপনাকে এটা মেনে নিতে হবে যে, শুধুমাত্র ভিটামিন সি অথবা পুষ্টিটির সাপ্লিমেন্ট (ভিটামিন সি ট্যাবলেট) কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও নিরাময় করতে পারে না।

কিন্তু খাবারের ভিটামিন সি অথবা ভিটামিন সি সাপ্লিমেন্ট কি শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অথবা চিকিৎসার ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে? এখানে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
ভিটামিন সি হচ্ছে একটি প্রয়োজনীয় পুষ্টি, যা শরীরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভিটামিন সি এমন কিছু প্রাণরাসায়নিক প্রক্রিয়ার সঙ্গেও সম্পৃক্ত হয়, যার সঙ্গে ইমিউন স্বাস্থ্যের সম্পর্ক রয়েছে।
ভিটামিন সি এর দৈনিক সুপারিশকৃত মাত্রা হচ্ছে ৯০ মিলিগ্রাম, কিন্তু স্তন্যপান করানো নারী ও ধূমপায়ীদের যথাক্রমে ৩০ ও ৩৫ মিলিগ্রাম অতিরিক্ত গ্রহণ করতে হয়। ডায়েট অথবা বিভিন্ন ধরনের ফল ও শাকসবজি থেকে দৈনিক সুপারিশকৃত মাত্রার সবটুকুই নিশ্চিত করা সহজ। উদাহরণস্বরূপ, একটি মধ্যম আকারের কমলা থেকে দৈনিক সুপারিশকৃত মাত্রার ৭৭ শতাংশ এবং এক বাটি (১২০ গ্রাম) রান্নাকৃত ব্রোকলি থেকে ১২০ শতাংশ ভিটামিন সি পাওয়া যায়।

‘ভিটামিন সি’ ইমিউন সিস্টেমের ওপর যেভাবে প্রভাব ফেলে

* ভিটামিন সি বিভিন্নভাবে ইমিউন স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। এটির অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট কার্যক্রম প্রদাহ কমায় যা ইমিউন কার্যক্রম উন্নত করতে সাহায্য করে।

* ভিটামিন সি কোলাজেন উৎপাদন বাড়িয়ে ত্বককে সুস্থ রাখে ও শরীরের ভেতর ক্ষতিকর কিছুর প্রবেশে বাধাদানে সহায়তা করে। ভিটামিন সি ত্বকের ক্ষত নিরাময় দ্রুত করে।

* ভিটামিন সি ফ্যাগোসাইটের কার্যক্রমও বাড়াতে পারে। ফ্যাগোসাইট হচ্ছে ইমিউন কোষ যা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য কণাকে গিলে ফেলতে পারে।

* এছাড়া ভিটামিন সি লিম্ফোসাইটের বৃদ্ধি ও বিস্তার বাড়াতে পারে। লিম্ফোসাইট হচ্ছে এক প্রকারের ইমিউন কোষ যা রক্তের বহিরাগত ও ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও বিষাক্ত পদার্থকে আক্রমণ করতে সংবহন অ্যান্টিবডি ও প্রোটিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে।

ঠান্ডার উদ্রেককারী ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভিটামিন সি এর কার্যকারিতা দেখতে গবেষণা চালানো হয়েছে। দেখা গেছে যে এতে ঠান্ডার হার কমেনি, কিন্তু ঠান্ডার স্থায়িত্ব ও উপসর্গের তীব্রতা কমেছে।

প্রাণী ও মানুষের ওপর চালিত গবেষণায় দেখা গেছে যে, উচ্চ ডোজে ইন্ট্রাভেনাস ভিটামিন সি সোয়াইন ফ্লু দ্বারা সৃষ্ট শ্বাসতন্ত্রীয় অসুস্থতায় ফুসফুসের প্রদাহ কমাতে পেরেছে। এছাড়া আরো কিছু ভাইরাস সংক্রমণেও ভিটামিন সি এর ব্যবহারে ফুসফুসের প্রদাহ কমেছে।

গবেষণাগুলোতে দৈনিক সুপারিশকৃত মাত্রার চেয়ে বেশি ডোজে ভিটামিন সি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ফুসফুসের প্রদাহ তথা নিউমোনিয়ার মাত্রা কমাতে উচ্চ ডোজে ভিটামিন সি’র ব্যবহারকে সমর্থন করতে পর্যাপ্ত গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। নিজ উদ্যাগে উচ্চ ডোজে ভিটামিন সি সেবন না করাই ভালো, এতে ডায়রিয়ায় ভুগতে পারেন।

ভিটামিন সি ও কোভিড-১৯

চাইনিজ জার্নাল অব ইনফেকশাস ডিজিজেসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সাংহাই মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের চিকিৎসায় উচ্চ ডোজে ভিটামিন সি ব্যবহার করতে অনুমোদন দিয়েছে। রোগীদের ফুসফুসের কার্যক্রম বাড়াতে শিরাপথে দৈনিক সুপারিশকৃত মাত্রার চেয়ে বেশি ডোজে ভিটামিন সি সরবরাহ করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। হয়তো এর ফলে মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশন অথবা লাইফ সাপোর্টের প্রয়োজন নাও হতে পারে।
এছাড়া ২০১৯ সালের একটি রিভিউতে দেখা গেছে, আইসিইউতে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের মুখে ও শিরাপথে উচ্চ ডোজে ভিটামিন সি চিকিৎসায় আইসিইউতে থাকার স্থায়িত্ব ও মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশনের স্থায়িত্ব যথাক্রমে ৮ ও ১৮ শতাংশ কমেছে।

কিন্তু একথা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, এখনো পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় ভিটামিন সি এর ব্যবহার আদর্শ অংশ নয়, কারণ সুস্পষ্ট প্রমাণের অভাব রয়েছে।

উচ্চ ডোজে কোভিড-১৯ রোগীদের শিরাপথে ভিটামিন সি সরবরাহে ফুসফুসের কার্যক্রমে উন্নতি আসে কিনা নিশ্চিত হতে গবেষণা চলমান রয়েছে। সমর্থন করার মতো এমন কোনো শক্তিশালী প্রমাণ নেই যে উচ্চ ডোজের মুখে খাওয়ার ভিটামিন সি ট্যাবলেট নতুন করোনার সংক্রমণে সহায়তা করে, বরং এতে ডায়রিয়ার মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে।

ভিটামিন সি ট্যাবলেট সেবনের প্রয়োজন আছে?

বর্তমানে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে মুখে খাওয়ার ভিটামিন সি সাপ্লিমেন্টের ব্যবহারকে সমর্থন করতে কোনো জোরালো প্রমাণ নেই।

ভিটামিন সি হয়তো অন্য ভাইরাস দ্বারা সৃষ্টি ঠান্ডার তীব্রতা ও স্থায়িত্ব কমাতে পারে, কিন্তু তার মানে এটা এই গ্যারান্টি দিচ্ছে না যে, এটি কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী নতুন করোনাভাইরাসের ওপরও একইরকম প্রভাব ফেলবে।

এছাড়া ভিটামিন সি হচ্ছে পানি-দ্রবণীয় ভিটামিন। এটি পানিতে মিশে বলে শরীরে বেশি পরিমাণে সঞ্চিত হয় না, এর পরিবর্তে মূত্রের মাধ্যমে নিষ্কাশিত হয়ে যায়। তাই বেশি পরিমাণে ভিটামিন সি সেবনের মানে এটা নয় যে শরীরে বেশি মাত্রায় শোষিত হচ্ছে।

উচ্চ ডোজে ভিটামিন সি সেবনের পরিণতি হিসেবে ডায়রিয়া হতে পারে, কারণ শরীর কোষ থেকে পানি বের করে পরিপাকতন্ত্রে পাঠানোর সংকেত পায়।

কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় উচ্চ ডোজে ভিটামিন সি ব্যবহারকে আশাপ্রদায়ক মনে হচ্ছে। কিন্তু এসব ডোজ মুখে খেয়ে নয়, শিরাপথে সরবরাহ করা হবে। এছাড়া এই চিকিৎসা তাদেরকে দেয়া হবে যাদের অবস্থা এতটা শোচনীয় যে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়। তাই আপনার ইমিউন সিস্টেম তথা রোগপ্রতিরোধ তন্ত্রের ওপর উপকারী প্রভাব ফেলতে চাইলে সাপ্লিমেন্ট নয়, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খান। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার পেতে সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সাপ্লিমেন্ট সেবন করতে পারেন।

 

ঢাকা/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়