ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

স্বামী-শাশুড়ি-দেবরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ গৃহবধূর আত্মহত্যা

নীলফামারী প্রতিনিধি  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৪০, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২  
স্বামী-শাশুড়ি-দেবরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ গৃহবধূর আত্মহত্যা

নিহত গৃহবধূ জ্যোতি

স্বামী-শাশুড়ি-দেবরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহননের চেষ্টাকারী গৃহবধূ জ্যোতি অবশেষে মারা গেছেন। রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) সকালে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে স্বামীসহ পরিবারের লোকজন গা ঢাকা দিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) ঘুমের ওষুধ খেয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে তিন দিন ধরে হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন দুই সন্তানের জননী জ্যোতি। তার নিজের হাতে লেখা সুইসাইড নোটে উঠে এসেছে আভিজাত্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নির্যাতনের লোমহর্ষক ঘটনা। এমন ঘটনা ঘটেছে নীলফামারীর সৈয়দপুরে। মৃত গৃহবধূ জ্যোতি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সন্তান ও শহরের সুপরিচিত ব্যবসায়ী সুমিত কুমার আগারওয়াল নিক্কির স্ত্রী।

এক সপ্তাহ আগে দুই পৃষ্ঠার চিঠি লিখে তা ছবি তুলে সৈয়দপুর হিন্দু কমিউনিটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের কাছে ম্যাসেঞ্জারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় জ্যোতি। কিন্তু কেউ তার উপর পারিবারিক অত্যাচারের বিষয়ে সুরাহা করতে এগিয়ে না আসায় গত বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে অস্বাভাবিক পরিমাণে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।

শহীদ বদিউজ্জামান সড়ক এলাকায় ভাড়া বাড়িতে এই ঘটনায় গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় পরিবারের সদস্যরা টের পায়। কিন্তু তাৎক্ষণিক হাসপাতালে না নিয়ে পারিবারিকভাবে চিকিৎসা করতে থাকে নিক্কির ছোট ভাই অমিত কুমার আগারওয়ালার স্ত্রী ডা. অমৃতা কুমারী আগারওয়াল।

কিন্তু অবস্থার অবনতি হলেও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। শুক্রবার পরিস্থিতি বেগতিক হওয়ায় বাধ্য হয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। গত তিন দিন থেকে সেখানে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন জ্যোতি।

ঘুমের ওষুধ খাওয়ার আগে ডায়েরির পাতায় লেখা দুই পৃষ্ঠার ওই সুইসাইড নোটে জ্যোতি তার মৃত্যুর জন্য চারজনকে দায়ী করে তাদের নাম উল্লেখ করেছেন। তারা হলেন স্বামী সুমিত কুমার, শাশুড়ি উমা দেবী, দেবর অমিত কুমার ও জা ডা. অমৃতা কুমারী। এ ক্ষেত্রে তার দুই সন্তান একেবারে নির্দোষ বলেও তুলে ধরেছেন।

সুইসাইড নোটে তিনি লিখেছেন, ‘আমার বিয়ে হয়েছে ২০০১ সালের ১২ ডিসেম্বর। বিয়ের পর থেকেই শাশুড়ি ও স্বামী-দেবর মানসিক নির্যাতন করছেন। দেবরের বিয়ের পর জা অমৃতাও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে অত্যাচার চালিয়ে আসছেন। এরা আমাকে চার বার মেরে ফেলার চেষ্টাও করেছেন। বেঁচে আছি সেটা আমার ভাগ্য। আমাকে সাজিয়ে মিথ্যে বলে আমার গয়না ও জমানো টাকা নিয়েছেন তারা। ফেরত দিবে বলে আজও দেননি। বরং টাকা ও গয়নার কথা বললেই অত্যাচারের মাত্রা বাড়ান। গায়েও হাত তুলেছেন সবাই মিলে। আমার মা ও বাবা নেই। ভাই-বোনদের জন্য বেঁচে ছিলাম।’

তিনি আরও লিখেছেন, ‘শাশুড়ি উমা দেবী আমাকে কখনো দেখতে পারেননি, ভালোও বাসেননি। আমার সংসার ভাঙার পেছনেও তার হাত রয়েছে। তিনি উল্টাপাল্টা বলে তার ছেলে সুমিতের কান ভরতেন। এমনকি আমার বাচ্চা দুটোকেও এরা ভয় দেখিয়ে রাখে। একারণে তারা কিছু বলতে পারে না।’ বাচ্চাদের রক্ষার জন্যও আকুতি জানিয়েছেন জ্যোতি।

জ্যোতি আরও লিখেছেন, ‘মানুষ মৃত্যুর সময় কখনো মিথ্যে বলে না। বিশ্বাস না হলে কাজের লোক ও পাড়াপ্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করে দেখবেন। আমার শাশুড়ি অনেক অত্যাচার করেছেন। ২১ বছর ধরে আমি শুধু কাঁদছি। এরা কখনই সুখের দিন দেখতে দেয়নি। আমার মৃত্যুর বিচার চাই।’

জ্যোতি আগারওয়ালের বাবার বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। তার স্বামী সুমিত কুমার আগারওয়াল নিক্কি সৈয়দপুর উপজেলা হিন্দু কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি। তিনি সৈয়দপুরের সুনামধন্য দানবীর ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদ তুলশীরাম আগারওয়ালার নাতি ও শিল্পপতি সুশীল কুমার আগারওয়ালার বড় ছেলে।

এই ঘটনায় শহরজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে এবং সুইসাইড নোটের কথাগুলো ছড়িয়ে পড়ায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। ব্যবসায়ী মহলসহ শিল্পপতি ও রাজনৈতিক অঙ্গন এবং সাধারণ মানুষের মাঝেও সমালোচনার ঝড় তুলেছে পারিবারিক নির্যাতন ও আত্মহননের বিষয়টি। তবে সকলে আশা করেছিলেন, জ্যোতি সুস্থ হয়ে তার সন্তানদের কাছে ফিরে আসবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হেরে গেলেন তিনি।

শনিবার জ্যোতির স্বামী সুমিত কুমার আগারওয়াল নিক্কি মোবাইল ফোনে দাবি করেন, ‘সুইসাইড নোট বলে যে উড়ো চিঠির কথা প্রচার করা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। কারণ এটি আমার স্ত্রীর লেখা নয়। তার হাতের লেখার সঙ্গে মিল নেই। কীভাবে প্রমাণ করবেন যে চিঠিটা জ্যোতি লিখেছে।’

এদিকে জ্যোতির মৃত্যুর খবর পেয়ে পরিবারের সবাই গা ঢাকা দিয়েছে। শনিবারও (১৭ সেপ্টেম্বর) স্বামী সুমিত কুমার ও জা ডা. অমৃতা কুমারীর মোবাইল ফোন চালু ছিল। এখন সবার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাদের বাড়িতে গিয়েও কাউকে পাওয়া যায়নি। পুলিশও বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, চেম্বারে ঢু মারলেও সব বন্ধ ছিল। একটি সূত্রমতে জানা গেছে, তারা অমৃতার বাবার বাসায় লুকিয়ে আছে, নয়তো ভারতে চলে গেছে।

এ ব্যাপারে সৈয়দপুর থানার অফিসার ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মৃত্যুর খবর শুনেছি। তবে এখনও অভিযোগ পাইনি। মৃত জ্যোতির ভাই মোবাইলে জানিয়েছেন লাশসহ সৈয়দপুরে আসছেন। তিনি অভিযোগ দিলে আসামিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
 

সিথুন/বকুল 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়