ঢাকা     শুক্রবার   ১১ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২৬ ১৪৩১

তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীরাই জনপ্রতিনিধি!

সুজাউদ্দিন রুবেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২১, ২৬ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীরাই জনপ্রতিনিধি!

বাঁ থেকে জনপ্রতিনিধি শাহজাহান, নুর হোসেন ও আজিজ উদ্দিন

সুজাউদ্দিন রুবেল, কক্সবাজার : মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস আজ ২৬ জুন, রোববার।

 

বিভিন্ন দেশের মতো নানা কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে দিবসটি পালন হচ্ছে বাংলাদেশেও।  দিবস উদযাপন আর কর্মসূচির ভেতরেও মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসনের কবল থেকে কোনোভাবেই রক্ষা করা যাচ্ছে না দেশের যুব সমাজকে।

 

যেভাবেই হোক না কেন, মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা মাদকদ্রব্য ইয়াবার পাচার বেড়েই চলেছে। রূট পরিবর্তনসহ নানা কৌশলে চলছে এসব ইয়াবার পাচার।

 

ইয়াবা পাচার রোধে নানা কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা কোনো কাজেই আসছে না। বরং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভূক্ত এসব ব্যবসায়ীরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছেন।

 

যদিও সংশ্লিষ্টরা আইনগত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে উল্লেখ্য করে হাতে নাতে ধরা পড়লে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলছেন। আর এসব অসঙ্গতির মধ্যেই আজ পালিত হচ্ছে দিবসটি।

 

অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা ৬ এর একটি স্মারক সূত্রে ২০১৪ সালের ২৩ জানুয়ারি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (অপারেশন ও গোয়েন্দা) পরিচালক যুগ্মসচিব প্রণব কুমার নিয়োগী স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদন দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়।

 

ওই প্রতিবেদনে কক্সবাজারের ৭ জন প্রভাবশালী ব্যক্তিসহ ৭৬৪ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নিদের্শসহ নানা সুপারিশ রয়েছে।

 

ওই তালিকায় ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে চিহ্নিত ১৫ জন এখন টেকনাফের ছয়টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে এই ১৫ জন নির্বাচিত হন।

 

এই তালিকার বাইরে বিভিন্ন সময় ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আরো তিনটি তালিকা রয়েছে। আর এসব তালিকায়ও ঘুরে ফিরে রয়েছে এদের নাম।

 

ইয়াবার প্রতিবেদনের ওই তালিকায় টেকনাফ সদর ইউনিয়নের লেঙ্গুর বিল এলাকার অংশের ৪ নম্বরে রয়েছেন নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান জাতীয় শ্রমিকলীগ টেকনাফ শাখার সভাপতি মোহাম্মদ শাহজাহানের নাম। তিনি টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদের ছেলে। তার বাবার নাম ছাড়াও তার অপর দুই ভাইয়ের নাম রয়েছে ওই তালিকার শুরুতে।

 

৮ নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচিত সদস্য (মেম্বার) বর্তমানে কক্সবাজার কারাগারে বন্দি এনামুল হক নাজিপাড়ার তালিকায় ৬ নম্বরে রয়েছেন। তিনি ওই এলাকার মৃত. মোজাহার মিয়ার ছেলে। ওখানে তিনি ছাড়াও তার ৩ ভাইসহ অনেক নিকট আত্মীয় রয়েছেন।

 

ওই তালিকায় সাবরাং ইউনিয়নের মন্ডলপাড়ার ১ নম্বরে রয়েছে সাবরাং ইউনিয়ন থেকে নির্বাচিত চেয়ারম্যান নুর হোসেনের নাম। ওই তালিকায় প্রথম দিকে রয়েছে তার অপর ৫ ভাইয়ের নাম।

 

একই তালিকায় আলীর ডেইল এলাকার ১ নম্বরে রয়েছে ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সদস্য  (মেম্বার) হিসেবে নির্বাচিত আকতার কামালের নাম। একই তালিকায় রয়েছে তার আরেক ভাই।আর এই আকতার কামালের নাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মানব পাচারকারীর তালিকায়ও রয়েছে।

 

ইয়াবা তালিকায় পানছড়িপাড়ার ৩ নম্বরে রয়েছে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সদস্য  (মেম্বার) হিসেবে নির্বাচিত শামসুল আলমের নাম। এ তালিকায় রয়েছে তার বাবাসহ আরো ৩ ভাইয়ের নাম।

 

নয়াপাড়ার অংশের ১০ নম্বরে রয়েছে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সদস্য  (মেম্বার) হিসেবে নির্বাচিত মোহাম্মদুর রহমানের নাম।

 

এ ছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের অপর এক ইয়াবা ও মানবপাচারকারীর তালিকায় রয়েছে, সাবরাং ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সদস্য  (মেম্বার) হিসেবে নির্বাচিত মোয়াজ্জেম হোসেন দানুর নাম।

 

ইয়াবার তালিকায় বাহারছড়ার ইউনিয়নের পুরানপাড়া এলাকায় রয়েছে বাহারছড়া ইউনিয়ন থেকে নির্বাচিত চেয়ারম্যান আজিজ উদ্দিনের নাম। তার নাম মানবপাচারকারী ও রোহিঙ্গা মদদদাতার তালিকায়ও রয়েছে।

 

ইয়াবা তালিকায় হ্নীলা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে জামাল হোছাইন, ৮নং ওয়ার্ডের নুরুল হুদা, ৯নং ওয়ার্ডে মোহাম্মদ আলীর নামও রয়েছে।

 

টেকনাফ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়া সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ভাই মুজিবুর রহমানের নাম ইয়াবা তালিকায় ৭ প্রভাবশালীর একজন হিসেবে উল্লেখ্য রয়েছে।

 

একই তালিকায় ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর একরামুল হক, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নুর বশর নুরসাদের নাম রয়েছে।

 

কক্সবাজারের সচেতন মহল মনে করেন, ইয়াবার থেকে আয় করা বিপুল অংকের টাকা বিনিয়োগের কারণে এরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছে। এর কারণে এসব ইয়াবা সিন্ডিকেট আরো বেশি শক্তিশালী হচ্ছে। ফলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত গডফাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারি উদ্যোগের দাবি করেছেন কক্সবাজারের সচেতন মহল।

 

মাদকাসক্তদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে নিতে কাজ করেন বেসরকারি সংস্থা নোঙর। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক দিদারুল আলম রাশেদ জানান, ইয়াবার গডফাদাররা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার ইতিহাস এই প্রথম নয়। এর আগেও নির্বাচিত হয়েছেন। যদিও এবার তার মাত্রা অনেক বেশি। বিশেষ করে ইয়াবা থেকে আয় করা বিপুল অর্থের প্রভাবে এরা নির্বাচিত হচ্ছেন। এতে করে সমাজে এদের অবস্থান আরো বেশি শক্তিশালী হচ্ছে। এটা রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ খারাপ খবর।

 

গ্রুপ থিয়েটারের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট তাপস রক্ষিত বলেন, গডফাদারদের ধরা না গেলে ইয়াবা বন্ধ হবে না। তাদের কালো অর্থ সমাজে প্রভাব পড়বে এটা স্বাভাবিক। এদের আইনের আওতায় নিয়ে যেতে রাষ্ট্রকে ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির প্রাক্তন সভাপতি ও লেখক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর জানান, ইয়াবা রোধে এখন সামাজিক প্রতিরোধ জরুরি হয়ে উঠেছে। এখন কেবল তালিকা করে নাম তৈরী করলে হবে না। এর জন্য কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ কখনো চোখে পড়েনি। ফলে ইয়াবা আগ্রাসন চোখে পড়ছে স্বাভাবিক।

 

কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘টেকনাফের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে টেকনাফ উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ তালিকা পাঠানোর পর এটা যাচাই-বাছাই করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। ওইখান থেকে তাদেরকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তবে যখন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগ যাচাই-বাছাই করছিল তখন তারা যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী বিষয়টি কেউ অবগত করেননি বা কেউ জানায়নি। এ ছাড়াও নানা সংঙ্গত কারণে অনেককে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। পরে তারা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন।’

 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সুবোধ কুমার বিশ্বাস রাইজিংবিডিকে জানান, মাদকের আইনে হাতে নাতে ধরা না পড়লে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। ফলে অনেক সময় অনেকেই আড়ালে রয়ে যায়। তবে কাউকে হাতে নাতে পেলে তার ক্ষেত্রে কোন ছাড় নই। সে যত বড় নেতা ও কর্মকর্তা হোক তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

ইয়াবা রোধে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ ও সামাজিক আন্দোলন তৈরীর করার কথা বললেন বিজিবির টেকনাফস্থ ২ নম্বর ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ।

 

তিনি রাইজিংবিডিকে জানান, সমন্বিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচেষ্টা, উৎপাদন এলাকায় উৎপাদন বন্ধে অভিযান, পাচার ঠেকানো, ভোক্তা পর্যায়ে অভিযান এক যোগে করতে হবে। এর জন্য সামাজিক সচেতনতা, প্রতিরোধ অবশ্যই জরুরি।

 

 

 

রাইজিংবিডি/কক্সবাজার/২৬ জুন ২০১৬/সুজাউদ্দিন রুবেল/রুহুল

রাইজিংবিডি.কম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়