ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পুলিশ দেখলেই দরজা বন্ধ

হাসিবুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩৪, ২৭ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পুলিশ দেখলেই দরজা বন্ধ

হাসিবুল ইসলাম মিথুন: ওস্তাদ সামনে সার্জেন্ট আছে দরজা বন্ধ করি? হ্যাঁ কর, আর সবাইরে পিছনে যাইতে বল, বাস পুরা খালি। পিছনে যায় না, সামনে এতো কি করে সব, পিছনে নে।- এভাবেই হেলপারকে বলছিলেন বাসের ড্রাইভার। মামলার ভয়ে এমনটাই করছে রাজধানীর গণপরিবহনের বাস মিনিবাস।

নিয়ম অনুযায়ী সিটিং সার্ভিসের বাসে দাড়িয়ে লোক নেওয়া নিষেধ। কিন্তু এই নিয়ম মানছে না কোন মিনিবাস বা বাস। পুলিশ এই অনিয়ম দেখলে মামলা দেবে- এই ভয়ে পুলিশ দেখলেই বাসের হেলপার দরজা বন্ধ করে দেয়। আবার পুলিশ পার হয়ে গেলেই দরজা খুলে লোক তোলে হরহামেশা।

কিছু সংখ্যক পরিবহনের গাড়ি চলছে সিটিং সার্ভিস নামে কিন্তু লোক তুলছে লোকাল বাসের মতোই। তবে ভাড়া নেওয়ার সময় ঠিকই নিচ্ছে সিটিং সার্ভিসের ভাড়া। যাত্রীরা এর প্রতিবাদ করলে তাদের দেখায় হাইকোর্ট।

রাজধানীর নিউমার্কেট থেকে সাভার রুটে চলে অনেকগুলো সিটিং এবং লোকাল বাস। প্রায় সবগুলো পরিবহনের গাড়িই মানছে না কোন নিয়ম। নির্ধারিত বাস স্টপ থেকে যাত্রী তুলছে না বাসে। যখন যেখানে পারছে সেখান থেকেই যাত্রী তুলছে। আবার ভাড়া নেওয়ার সময় তারা নিচ্ছে সিটিং-এর ভাড়া। শুধু এই রুটেই নয়, পুরো রাজধানী জুড়েই প্রতিটি রুটে এই অনিয়ম চলছে।

সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি পরিবহন যেমন প্রজাপতি পরিবহন, ইতিহাস পরিবহন, ঠিকানা পরিবহন, শুভেচ্ছা পরিবহনসহ অনেক কোম্পানির বাসই নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়াই অতিরিক্ত যাত্রী তুলছে।

আসাদ গেট থেকে গাবতলী যাবেন মোহাম্মদ ইলিয়াস সরদার। তিনি উঠলেন ঠিকানা পরিবহণের একটি বাসে। যদিও সেখান থেকে লোক উঠানোর নিয়ম নেই। ভাড়া দেওয়ার সময় তিনি দিলেন ১০ টাকা। কিন্তু বাসের হেলপার (যিনি ভাড়া উঠাচ্ছেন) বললেন, ভাড়া ১৫ টাকা, কম নেই। ইলিয়াস বললেন, উঠলাম আসাদ গেট থেকে আর ভাড়া চাচ্ছেন নিউমার্কেটের কেন? আমি ১০ টাকাই দিবো। এর বেশি ভাড়া এখান থেকে হবে না।

এই নিয়ে ঝগড়া শুরু দুইজনের মধ্যে। এক পর্যায়ে হাতাহাতির পালা। পরে অন্যান্য যাত্রী তাদেরকে থামিয়ে দেন। বাসের কন্ডাক্টরও নাছোড়বান্দা, তিনি ১৫ টাকাই নেবেন। আর ইলিয়াস সরদারের কথা হচ্ছে, লোক তুলছে লোকাল বাসের মত আর ভাড়া কেন সিটিং সার্ভিস বাসের মত নেবে। শেষ পর্যন্ত যাত্রীরা অনেকে বলার পরে ১০ টাকাই নিয়েছে বাস কন্ডাকটর।

এমন ঘটনা রাজধানীর গণপরিবহনের বাস মিনিবাসে নিত্যদিনের। ভাড়া বেশি নিলে অনেকে প্রতিবাদ করছেন আবার অনেকে প্রতিবাদ না করে বাধ্য হয়েই বেশি ভাড়া দিয়ে যাচ্ছেন।

কথা হয় ঠিকানা পরিবহণের একটি বাসের কনডাক্টরের সঙ্গে। তার ভাষ্যমতে, ভাড়া মোটেও বেশি নেওয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘মালিককে গাড়ির জমা আগের থেকে অনেক বেশি দিতে হয়। যার কারণে বাসের ভাড়া বেশি। আর অতিরিক্ত যাত্রীও তোলা হয় না। মাঝে মধ্যে কিছু যাত্রী তুলতে হয়। আর আমরা কি করবো, বাস কোথাও থামলে যাত্রীরা ওঠার জন্য পাগল হয়ে যায়। আমাদের কি দোষ বলেন ?’

কথা হয় ওই একই বাসের যাত্রী মোহাম্মদ আসাদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘রাজধানীতে সিটিং সার্ভিসের নামে লোকাল বাস চালানো হচ্ছে। প্রতিটি বাসই যেখানে সেখানে দাড় করিয়ে লোক নিচ্ছে। আমার কথা হচ্ছে যদি সিটিং সার্ভিস হয় তাহলে কেন দাড় করিয়ে লোক নেবে। ভাড়া তো এক টাকাও কম নিচ্ছে না। আর কিছু বললেই তারা মারমুখী হয়ে ওঠে; ঝগড়া শুরু করে দেয় বা বলে, বাস থেকে নেমে লোকাল বাসে যান।’ আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আসলে কোনটা লোকাল বাস আর কোনটা সিটিং বাস?’

তিনি বলেন, ‘আমি যতদূর জানি ডিএমপি থেকে পুরো রাজধানীতেই কিছু নির্ধারিত বাস স্টপ করে দেওয়া হয়েছে যাত্রী তোলা ও নামানোর জন্য। কিন্তু কোন বাস সেই নিয়ম মানছে না। তারা তাদের ইচ্ছেমতো বাস থামাচ্ছে যাত্রী তুলছে আবার নামাচ্ছে।’

গুলিস্তান-গাবতলী রুটের পরিস্থান পরিবহণের রোড ইনচার্জ মোহাম্মদ সোহেল বলেন, ‘আমাদের পরিবহনে হেলপারদের কোন বেতন মালিক পক্ষ দেয় না। এছাড়া ড্রাইভারদের প্রতি ট্রিপে ২০০ টাকা করে দেওয়া হয়। তাই সিটিং সার্ভিস হলেও বেশি যাত্রী আমাদের নিতে হয়। এই অতিরিক্ত যাত্রীর কাছ থেকে যে ভাড়া পাই সেটাই আসলে আমাদের বেতন।’

অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়ার বিষয়ে মালিকপক্ষ থেকে কোন নির্দেশনা আছে কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘রাজধানীর অধিকাংশ বাস এখন মালিকদের নিয়ন্ত্রণে নেই। মালিকরা তাদের বাস চুক্তিতে দিয়ে দেন। প্রতিদিন বডি ভাড়া হিসেবে ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা তারা নিয়ে থাকেন। তাই যারা চুক্তিতে নেন তারাই আসলে এই নিয়ম মানছেন না। তারাই আমাদের বলেন অতিরিক্ত যাত্রী নিতে তবে খুব বেশী সংখ্যক নয়।

কথা হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পশ্চিম বিভাগের ট্রাফিক জোনের ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ কাউছার উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আপনারা জানেন, কিছুদিন আগেও আমরা চেয়েছিলাম রাজধানীতে কোন সিটিং সার্ভিস থাকবে না। তখন মালিকপক্ষ এই সিদ্ধান্তে বাধা দেয়। আসলে এখন আপনারাই বলেন আমরা কি করতে পারি। রাজধানীতে এতো সংখ্যক লোক যে, আমরা বাধ্য হয়েছি সিটিং বিষয় থেকে সরে আসতে।’

রাজধানীর রাস্তায় পরিবহনগুলো সিটিং-এর নামে লোকাল বাসের মতো যাত্রী নিচ্ছে কিন্তু ভাড়া নিচ্ছে সিটিংয়ের- এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত ভাড়া যদি নেয় তাহলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। যদি এমন হয় তাহলে প্লিজ আমাদের কাছে অভিযোগ করুন আমরা ব্যবস্থা নিবো। ’

তিনি বলেন, আমরা কঠোরভাবে নজর রাখছি পরিবহনগুলো যেন নির্ধারিত বাসস্টপ ছাড়া যাত্রী তুলতে না পারে। যদি এই বিষয়ে অনিয়ম দেখি তাহলে আমাদের সার্জেন্টরা সঙ্গে সঙ্গে মামলা দেয়। আপনি শুনলে অবাক হবেন প্রতিদিন প্রচুর মামলা দেই আমরা। এতো পরিমানে অনিয়ম যেটা আসলে বলে বোঝাতে পারবো না। আমরা তাদের মামলা দেওয়ার সময় অনুরোধ করে বলি ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলতে। তারপরও তারা আইন মানছে না।

তিনি বলেন, ডিএমপি ও সিটি করপোরেশন থেকে নির্দেশনা দেওয়াই আছে যে, নির্ধারিত বাস স্টপ শুরু থেকে বাসের দরজা খোলা রাখার আবার বাস স্টপ শেষ হলেই তা আবার বন্ধ করে রাখার।

জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যারা শিক্ষিত তারাই বেশি আইন অমান্য করে। তাই তাদের উদ্দেশ্যে বলছি আপনারা আইন মেনে চলুন তাহলে আপনাদের দেখে অন্যরা শিখবে। আপনারা নিজেদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করুন যে, আপনি যেটা করছেন সেটা ঠিক কিনা। সবাইকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সেটা মানতে হবে।’

এই সমস্যা কিভাবে সমাধান করা সম্ভব- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি রাইজিংবিডিকে আরো বলেন, যতদিন পর্যন্ত পরিবহন মালিকরা ড্রাইভারদের নিয়োগ না দেবেন ততদিন এই সমস্যার সমাধান হবে না। বাস চুক্তিভিত্তিক চালানো যাবে না। তাই সকলকে নিয়মের মধ্যে আনতে হবে।

নগরীর পরিবহনগুলোর এই অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত আছে তারা বিভিন্ন সময়ে অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। আমাদের মালিক পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময়ে এই সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এই সমস্যা কীভাবে সমাধান হবে- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ঢাকা পরিবহনের রোডে চলার একটা নীতিমালা করছি। সেটা করলেই এই সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি।

 

রাইজিংবিডি/ ঢাকা/২৭ জুন ২০১৯/হাসিবুল/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়