ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

প্রতিবন্ধীদের আলোর স্কুল

রেজাউল করিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৬, ৬ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রতিবন্ধীদের আলোর স্কুল

চট্টগ্রাম সরকারি বাক, শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় (ছবি: রেজাউল করিম)

রেজাউল করিম, চট্টগ্রাম : ভাস্কর ভট্টাচার্য্য জন্মগতভাবে একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এটুআই প্রকল্পে একজন কনসালট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মোহাম্মদ হাসানও চোখে দেখতে পান না জন্মের পর থেকেই। এই হাসান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কম্পিউটার ট্রেইনার হিসেবে কর্মরত।

ভাস্কর ভট্টাচার্য্য এবং মোহাম্মদ হাসানের মতো অনেকেই অন্ধত্বকে জয় করে যাপিত জীবনে আলোর সন্ধান পেয়েছেন শুধু পড়ালেখা করে। আর তাদের এই পড়ালেখার ভিত তৈরি করে দিয়েছে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার মুরাদপুর এলাকায় অবস্থিত চট্টগ্রাম সরকারি বাক, শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্কুল। এই বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি থেকে পড়ালেখা শুরু করে অনেক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশু বড় হয়ে জীবনকে আলোকিত করেছেন। নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে নিয়েছেন। জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।

ক্লাস নিচ্ছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষক মোখলেছুর রহমান (ছবি: রেজাউল করিম)

 

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে নগরীর মুরাদপুর এলাকায় এক একরের বেশি এলাকা নিয়ে চট্টগ্রাম বাক, শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শুরু থেকেই এ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা এবং খাওয়া দাওয়া সবই ফ্রি প্রতিবন্ধী শিশু কিশোরদের জন্য। এই বিদ্যালয়ে যারা পড়ালেখা করে তাদের কেউ চোখে দেখতে পারে না। কেউ চোখে দেখতে পারে কিন্তু কানে শুনতে পারে না কিংবা মুখে কোন কথা বলতে পারে না।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মোখলেছুর রহমান মুকুল রাইজিংবিডিকে জানান, চট্টগ্রামে এই বিদ্যালয়টি শুরু থেকেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে আসছে। এই বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি থেকে ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করার সুযোগ রয়েছে। এরপর বোর্ড রেজিস্ট্রেশন করে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের লক্ষ্যে অন্যান্য স্বাভাবিক শিক্ষার্থীদের মতো দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদেরও সাধারণ স্কুলে ভর্তি হতে হয় ৮ম শ্রেণিতে। সেখান থেকে তারা শ্রুতি লেখকের মাধ্যমে এসএসসি এবং পরবর্তী সময়ে উচ্চ শিক্ষায় অংশগ্রহণ করে। মুলত চট্টগ্রামে এই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টি প্রতিবন্ধী শিশু কিশোরদের মধ্যে পড়ালেখার ভিত তৈরি করে দেয়।

বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিভাগে ক্লাসরুমে শিশু শিক্ষার্থীরা (ছবি: রেজাউল করিম)

 

মোখলেছুর রহমান আরও জানান, নানা সঙ্কট ও সমস্যা থাকলেও এই বিদ্যালয়ে আবাসিক অনাবাসিক মিলিয়ে ২ শতাধিক প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রী পড়ালেখা করছে। এরমধ্যে মেয়েদের জন্য পর্যাপ্ত আবাসিক অবকাঠামো না থাকায় আবাসিক সুবিধা দিয়ে প্রতিবন্ধী ছাত্রীদের ভর্তি করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ছাত্রদের জন্য ৩০ জনের আবাসিক সুবিধা রয়েছে। এই বিভাগে অধ্যয়ন করছে ৮০ জন ছাত্রছাত্রী। ছাত্রীদের জন্য এই বিভাগে কোন আবাসিক সুবিধা নেই। ৩০ জন ছাত্র ফ্রি খাওয়াদাওয়াসহ পূর্ণ আবাসিক সুবিধা পেলেও ৫০ জন ছাত্রছাত্রী অধ্যয়ন করছে অনাবাসিক সুবিধায়।

একইভাবে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিভাগেও ৮০ জন ছাত্রছাত্রী অধ্যয়ন করছে। এখানে আবাসিক সুবিধা রয়েছে ৩০ জনের। বিদ্যালয়ের বিপুল পরিমাণ খালি জায়গা থাকলেও প্রয়োজনীয় বরাদ্দের অভাবে এখানে নতুন করে আবাসিক ভবন নির্মিত না হওয়ায় প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীরা আবাসিক সুবিধা নিয়ে পড়ালেখা করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

 

এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী বিদ্যালয়ের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিভাগের ছাত্র মোঃ সোহেল রানা রাইজিংবিডিকে জানান, চট্টগ্রামের সরকারি এই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টি আমাদেরকে শিক্ষার ভিত তৈরি করে দিয়েছে। আমি এবং আমার মত অনেকেই এই বিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সিঁড়ি অতিক্রম করে নিজেদের জীবনকে আলোকিত করার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে আবাসিক সুবিধা বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে এই বিদ্যালয়ে আরও অনেক বেশি প্রতিবন্ধী শিশু অধ্যয়ন করার সুযোগ পেতো।

সোহেল রানা জানান, বিদ্যালয়ে ক্লাস রুমের সঙ্কট রয়েছে। অনেকটা ঘিঞ্জি পরিবেশে শিশুদের ক্লাস করতে হয়। কোন ক্লাসরুমে ফ্যান আছে আবার কোন ক্লাস রুমে নেই। প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রও নেই। এমনকি প্রধান শিক্ষকের কক্ষেও প্রয়োজনীয় চেয়ার টেবিল নেই। এই অবস্থার মধ্যেও নিজের প্রতিবন্ধীত্ব এবং পারিপার্শ্বিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করেই এখানে শিক্ষকরা ক্লাস নিচ্ছেন আর ছাত্রছাত্রীরা পড়ালেখা করছে।

বিদ্যালয়ের প্রাক্তন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্র চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কম্পিউটার ট্রেইনার মোহাম্মদ হাছান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমরা এই বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেই প্রাথমিকভাবে নিজেদের শিক্ষার ভিত তৈরি করেছি। পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছি। কিন্তু বিদ্যালয়টি এখন নানা সঙ্কটে রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন হচ্ছে না। আবাসিক ভবনের অভাবে ছাত্রীরা আবাসিক সুবিধা পাচ্ছে না। ক্লাসরুমের সঙ্কটে ঘিঞ্জি অবস্থায় ছাত্রছাত্রীরা পড়ালেখা করছে।’ তিনি বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নের দাবি জানান।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ জুলাই ২০১৯/রেজাউল/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়