ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

ধূমপান ছাড়তে গিয়ে জড়াচ্ছেন নতুন নেশায়!

আরিফ সাওন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪২, ৫ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ধূমপান ছাড়তে গিয়ে জড়াচ্ছেন নতুন নেশায়!

জাতীয় প্রেসক্লাবের পশ্চিম কোণে কয়েকজন বসে আছেন। একজন কালো রঙের কী যেন মুখে নিয়ে টান দিচ্ছেন। তা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। একজন টেনে আরেকজনের কাছে দিলেন, আরেকজন টানছেন। তারা সবাই সংবাদকর্মী। তারা ধূমপান করেন। এখন ধূমপান ছাড়তে চাচ্ছেন। সিগারেটের নেশা ছাড়তে এখন যে জিনিসটি ধরেছেন তা হলো ইলেক্ট্রনিক সিগারেট।

তারা শুনেছেন, ইলেক্ট্রনিক সিগারেটে কোনো ক্ষতি নেই। শুধু ধোঁয়া আছে। এভাবে টানতে টানতে একসময় নিকোটিনের নেশা চলে যাবে। শুধু এই সংবাদকর্মীরাই নন, অনেকেই সিগারেট ছাড়তে ইলেক্ট্রনিক সিগারেটে ঝুঁকছেন।

সম্প্রতি স্বাস্থ‌্য মন্ত্রণালয়ে ‘ইমার্জিং টোব‌্যাকো প্রোডাক্ট (ই-সিগারেট, এইচটিপি) : বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এক জ‌্যেষ্ঠ নারী কর্মকর্তা জানান, তারা ছেলে ধূমপায়ী। আগে মায়ের সামনে কখনো সিগারেট খায়নি। এখন সিগারেট ছাড়ার জন্য যে ইলেক্ট্রনিক সিগারেট ধরেছে, সেটা সে প্রকাশ্যে টানছে। সে জানিয়েছে, এতে কোনো ক্ষতি নেই। এটা ধূমপান ছাড়তে সহায়ক।

ধূমপান ছাড়ার জন্য যারা ইলেক্ট্রনিক সিগারেট ধরেছেন, তাদের দৃষ্টিতে এটা ক্ষতিকর না হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা মারাত্মক ক্ষতিকর। এতেও নিকোটিন আছে।

দেশের তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোও বলছে, এটা টোব‌্যাকো কোম্পানিগুলোর বড় ধরনের প্রতারণা। ইলেকট্রনিক সিগারেটের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির জোর দাবি জানিয়েছেন ধূমপানবিরোধীরা।

ভাইটাল স্ট্র‌্যাটেজিসের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ শফিকুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, এটা তামাক কোম্পানিগুলোর প্রতারণার অংশ। তারাই ই-সিগারেট মার্কেটে ছেড়েছে। মানুষ মনে করছে, এতে তো তামাক নেই। তামাক না থাকলে কী হবে, এতে তো নিকোটিন আছে। নেশা ছাড়তে গিয়েই মানুষ আবার নতুন নেশায় জড়িয়ে পড়ছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে ছয় হাজার ফ্লেভারের ইলেকট্রনিক সিগারেট পাওয়া যায়। ওই ফ্লেভারের মধ্যেই নিকোটিন। এটা ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি করে। এটা খুব ব্যয়বহুল। দেশের সর্বত্র এখনো ছড়ায়নি। শুধু ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোতেই পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্বের ২৩টি দেশে ইলেক্ট্রনিক সিগারেট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভারতও সম্প্রতি এটা নিষিদ্ধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি রাজ‌্যে এটা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আগে আমাদের দেশেও ইলেক্ট্রনিক সিগারেট নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর গুলশান, বারিধারা, বনানী, ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন ক্লাবে ইলেক্ট্রনিক সিগারেট বেশি পাওয়া যায়।

জাতীয় হৃদরোগ ফাউন্ডেশনের ইপিডেমিওলজি ও রিসার্চের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ইলেক্ট্রনিক সিগারেট দুই ধরনের। একটাতে নিকোটিনের জুস থাকে। আরেকটা আছে, যেটা আমাদের দেশে এখনো আসেনি। ওটার ধোঁয়া দেখা যায় না। যিনি ব্যবহার করেন তিনিই বুঝতে পারেন। আমাদের দেশে এখন যেটা পাওয়া যাচ্ছে, আমরা ধরেই নিতে পারি, এটা ক্ষতিকর। কেননা ওটাতে বিভিন্ন মাত্রায় ক্যামিক্যাল ও নিকোটিনের জুসের সংমিশ্রণ থাকে।

তিনি বলেন, ইলেক্ট্রনিক সিগারেট স্বাস্থ্যের জন‌্য কী ধরেনর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করে, তা নিয়ে আমাদের দেশে এখনো কোনো পরীক্ষা হয়নি। তবে আমরা ধরে নিতে পারি, নিকোটিন ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর। তাই এটাও ক্ষতিকর। অমেরিকাতে এরকম কয়েকটি কেস ধরা পড়েছে। তাই এখনই এটা নিয়ে ভাবার সময়।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এবং ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এখন পর্যন্ত (২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯) দেশটির ৮০৫ জনের ফুসফুসের রোগ এবং ১২ জনের মৃত্যুর সঙ্গে ই-সিগারেট/ভ্যাপিংয়ের যোগসূত্র থাকার কথা নিশ্চিত করেছে।

তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার প্রকল্প সমন্বয়ক হাসান শাহরিয়ার এ প্রতিবেদককে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত ‘রিপোর্ট অন গ্লোবাল টোব‌্যাকো এপিডেমিক’ এ ই-সিগারেটকে সুনিশ্চিতভাবে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইউএস সার্জন জেনারেল রিপোর্টে ই-সিগারেটসহ নিকোটিনযুক্ত সব পণ্যকে ‘অনিরাপদ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

সম্প্রতি স্বাস্থ‌্য মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত একটি মতবিনিময় সভা হয়। সেখানে জানানো হয়, সরকার ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করার কথা ভাবছে।

ওই মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিষয়টি আমাদের জন্য নতুন। একসময় ই-সিগারেট জাতীয় পণ্যকে সিগারেটের নিরাপদ বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও এখন বিভিন্ন গবেষণায় এর ক্ষতির বিষয়গুলো সামনে আসছে। সুতরাং আমরা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার চিন্তা করছি।

ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্ট কী:

ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেমস (ইএনডিএস) এক ধরনের ব্যাটারিচালিত ডিভাইস যা ই-লিকুইড বা নিকোটিনযুক্ত তরল দ্রবণকে তাপের মাধ্যমে বাষ্পে রূপান্তরিত করে। একজন ব্যবহারকারী যখন ডিভাইসটিতে টান দেন, তখন নিকোটিনের দ্রবণ গরমে বাষ্পীভূত হয় এবং ব্যবহারকারীকে নিকোটিন সরবরাহ করে। এতে নিকোটিন ছাড়াও নানারকম রাসায়নিক মিশ্রণ এবং সুগন্ধি মেশানো থাকে, যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ইলেক্ট্রনিক সিগারেট বা ই-সিগারেট, ভ্যাপ বা ভ্যাপ পেনস, ই-হুক্কা, ই-পাইপ এবং ই-সিগার প্রভৃতি ইএনডিএস পণ্যের বিভিন্ন ধরন। সাধারণ সিগারেট বা পাইপ আকৃতি ছাড়াও এগুলো দেখতে কলম, পেনড্রাইভ কিংবা সিলিন্ডার আকৃতির হয়ে থাকে।

হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট (এইচটিপি):

ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসভিত্তিক এক ধরনের তামাকপণ্য। তামাকযুক্ত স্টিক বা প্লাগ থেকে তাপ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিকোটিন এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশ্রিত ধোঁয়া গ্রহণ করা হয়। এতে তামাকের সাথে অন্যান্য রাসায়নিক এবং সুগন্ধি মেশানো হয়। এইচটিপি ডিভাইসে ধূমপানের জন্য তামাক এবং ইএনডিএসে সরাসরি নিকোটিন দ্রবণ মেশানো হয়ে থাকে।

উদ্ভাবনী কৌশল এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনের কারণে কিশোর এবং তরুণদের মাঝে বিশেষত বিদ্যালয়গামী শিশুদের মধ্যে এসব তামাকপণ্য জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করেছে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বেশকিছু দেশে এসব পণ‌্যের ব্যবহার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে আমেরিকায় স্কুলপড়ুয়া তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেটের ব্যবহার ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।


ঢাকা/সাওন/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়