‘এমন অসুখের চেয়ে মরণ ভালো’
মাহমুদুল হাসান মিলন || রাইজিংবিডি.কম
পাঁচ সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে ভরা সংসার ছিল কৃষি শ্রমিক আব্দুল বারিকের (৬০)। সন্তানদের মধ্যে প্রথম তিনটি ছেলে, পরের দু’টি মেয়ে। ছেলেরা বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে। অভাব দূর হয়ে স্বচ্ছলতা আসবে। এমনটাই ছিল স্বপ্ন। কিন্তু আব্দুল বারিকের ভাগ্যলিখন ছিল অন্যরকম। যা তিনি কল্পনাও করেননি।
ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার শেরপুর গ্রামে একটি ভাঙ্গা ঘরে স্ত্রীসহ চরম অসুস্থ তিন প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে আব্দুল বারিকের বসবাস। বৃদ্ধ বয়সেও দূর দূরান্তে কাজের সন্ধানে ছুটতে হয় তাকে। সরেজমিনে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি দূরের এক গ্রামে কাজে গিয়েছেন। বাড়িতে কথা হয় তার প্রতিবন্ধী ছেলেদের সঙ্গে। তাদের কাছে জানা গেল পরিবারের করুণ কাহিনি।
প্রায় ১৫ বছরের আগের ঘটনা। হঠাৎ করেই জ্বরে আক্রান্ত হন আব্দুল বারিকের স্ত্রী ছহুরা বেগম (৫৬)। সবাই ভেবেছিলেন স্বাভাবিক জ্বর, ক’দিন বাদেই ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু এ জ্বর ছিল কেবল উপসর্গ। আসলে মারাত্মক এক রোগ ভেতরে ভেতরে ছহুরাকে কাবু করে ফেলে। একে প্রত্যন্ত গ্রাম, তার উপরে অভাবের সংসার। ভালো ডাক্তার দেখানো সম্ভব হয়নি। কবিরাজই ভরসা।
জ্বর সেরে যায় ছহুরার। কিন্তু শরীরে আর শক্তি পান না তিনি। ধীরে ধীরে অবশ হয়ে পড়ে সমস্ত শরীর। এক সময় পঙ্গু হয়ে যান। মাংস শুকিয়ে হাড় সর্বস্ব হয়ে পড়েন। হাড়ের গায়ে লেগে থাকে শুধুই চামড়া। এবারও সেই কবিরাজই ভরসা। আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন ছহুরা। এখন কোনোমতে হামাগুড়ি দিয়ে চলাফেরা করেন। দুর্বলতার কারণে কথাও বলতে পারেন না ঠিকঠাক। শ্রবণ শক্তিও হারিয়েছেন।
সংসারের মূল চালিকা শক্তি এভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েন আব্দুল বারিক। টাকা পয়সার অভাবে স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে না পেরে বিবেকের দংশনে পুড়তে থাকেন। বড় দুই ছেলে সংসারে সহায়তা করতে তার সঙ্গে কাজে যোগদেন। ছোট ছেলেটিকে স্কুলে ভর্তি করান।
কিন্তু বিধিবাম। এবার জ্বরে পড়েন বড় ছেলে আবুল কালাম (৩৮)। ক্রমান্বয়ে মেঝ ছেলে রবী ইসলাম (৩৫) ও ছোট ছেলে রতন মিয়াও (৩০) আক্রান্ত হন সেই বিভিষিকাময় দুরারোগ্য ব্যধিতে। মায়ের মতো একে একে তিন ছেলেই পঙ্গু হয়ে যান। হাড়-চামড়া সর্বস্ব হয়ে পড়েন। চলাচলের শক্তি হারিয়ে পঙ্গু অথর্ব হয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে থাকেন। বাবার বোঝা কমানোর বদলে বোঝা হয়ে চড়ে বসেন বৃদ্ধ বাবার কাঁধে। বর্তমানে নিজেদের দেহের ভারই বইতে পারেন না তারা। হামাগুড়ি দিয়ে কোনোমতে চলাফেরা করেন।
সুস্থ-সবল ও কর্মঠ অবস্থা থেকে তিন ভাই ধীরে ধীরে হয়ে পড়েন পঙ্গু-প্রতিবন্ধী। বয়োবৃদ্ধ বাবার সামান্য উপার্জন, আর মাঝে মাঝে আশপাশের মানুষের দেয়া যৎসামান্য সাহায্যে খেয়ে না খেয়ে এখন চলছে তাদের জীবন।
এই প্রতিবেদককে দেখে কথা বলার জন্য তিন ভাই ও তাদের মা একত্রিত হন। মা কোনোমতে বেরিয়ে আসেন তার ছোট্ট ঘরটি থেকে। মায়ের কাছে যেতে মেঝ ছেলে রবী যেভাবে উঠে দাঁড়ালেন এবং হেঁটে চললেন, তা দেখলে যে কারো হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। তাকে অনুসরণ করে বড় ছেলে আবুল কালাম ও ছোট ছেলে রতন বসে বসে কোনো মতে গড়িয়ে চললেন। প্রতিটি নড়াচড়াতেই তাদের কষ্টের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বড় ছেলে কালাম জানান, তাদের বাবা আব্দুল বারিক ভোরে উঠে ভিন গ্রামে কাজে গেছেন। বৃদ্ধ বয়সেও তাকে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয়। বাড়িতে চারজন প্রতিবন্ধী। তারা সবাই সংসারের বোঝা। বাবাকে তাই এখনো কাজে যেতে হয়। বাবার কিছু হয়ে গেলে সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে বলে জানান তিনি।
খোঁজ নিতে ময়মনসিংহ থেকে সাংবাদিক এসেছে শুনে চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে ছহুরা বেগমের। হয়তো এর আগে কখনো কেউ তাদের খোঁজ নিতে যায়নি। সেজন্য আবেগ বাধ মানেনি। খুব কম কথা বলেন ছহুরা বেগম। যা বলেন, তাও জড়িয়ে যায়। শ্রবণশক্তি কমে যাওয়ায় খুব জোরে কথা বলতে হয় তার সঙ্গে।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা জড়ানো কণ্ঠে তিনি জানান, পাঁচ সন্তান জন্ম নেয়া পর্যন্ত তিনি ও তার সন্তানরা সবাই সুস্থই ছিলেন। ১৫ বছর আগে জ্বরে পড়েন। তারপর অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে যান। এ ঘটনার অল্প সময়ের মধ্যে তার বড় ছেলে কালাম একইভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। ক্রমান্বয়ে মেঝো ছেলে রবী ইসলাম ও ছোট ছেলে রতন মিয়াও আক্রান্ত হন একই রোগে। এখন দুই মেয়ে আর তার স্বামী আব্দুল বারিক সুস্থ আছেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘এমন অসুখের চেয়ে মরণ অনেক ভালো।’
চরম দারিদ্রের কষাঘাত সয়ে পরিবারটি একটি ছোট্ট ঘরে কোনোমতে গাদাগাদি করে বাস করছে। ঘরের চালে টিনের ছাউনি। প্রায় সব যায়গাতেই ফুটো। বর্ষায় পলিথিন দিয়ে বৃষ্টির পানি আটকানোর প্রাণান্ত চেষ্টা চলে।
আবুল কালাম বলেন, ‘আমাদের একটা ঘরও নেই। খুবই ছোট ভাঙ্গা ঘরে জড়সড় হয়ে শুয়ে থাকি আমরা। বৃষ্টি নামলে পানি পড়ে। তখন সবাই এক সাথে পলিথিন মুড়ি দিয়ে পড়ে থাকি। ’
সে সময় আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলেন আবুল কালম। তিনি বলেন, ‘আমরা সুস্থ হতে চাই। বেঁচে থাকতে চাই। সেজন্য সরকার কিংবা বিত্তবান মানুষদের সাহায্য প্রার্থনা করছি।’
ছেলেরা মায়ের মতো অজানা রোগে পড়ে অসুস্থ হলেও মেয়ে দু’টি বাবার মতো সুস্থ ও স্বাভাবিক আছেন। তাদের দু’জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। বড় মেয়ে ফাতেমা স্বামী সংসার নিয়ে ভালোই আছেন। বাবার সংসারের খোঁজ তেমন একটা রাখতে পারেন না তিনি।
তবে ছোট বোন আসমা বিয়ের পরেও মা-ভাইদের ছেড়ে যাননি। পাশের গ্রামে বিয়ে হয়েছে তার। স্বামী কৃষক। দুই বছরের একটি ছেলে আছে তার। বাবার বাড়িতে থাকার জন্য স্বামী তাকে একপ্রকার পরিত্যাগ করেছে। সেটি মেনে নিয়েই মা-ভাইদের সহায়তা করে চলেছেন আসমা। তিনিই তার মা ও ভাইদের চলতে ফিরতে, খেতে, গোসল করতে এবং অন্যান্য দৈনন্দিন কাজে সহায়তা করেন। তার সহায়তা ছাড়া তারা নিতান্তই অসহায়।
আবুল কালাম বলেন, ‘কোনো কাজকর্ম তো দূরের কথা, নিজেরা প্রস্রাব-পায়খানায়ও যেতে পারি না। ছোট বোনটা বাড়িতে থেকে আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করে। আমাদের সমস্ত কাজে সে সাহায্য করে।’
ছোট ছেলে রতন মিয়া বলেন, ‘আমরা বাঁচতে চাই। সবার সহযোগীতা পেলে হয়ত আমরা সুস্থ হয়ে উঠতে পারি। এই প্রতিবন্ধীর জীবন আর ভালো লাগে না। কাজ-কর্ম করে খেতে চাই। দয়া করে আমাদের বাঁচান।’ মেঝ ছেলে রবী অসুস্থতার কারণে কোনো কথাই বলতে পারেননি।
আবুল কালাম বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় আমাদের দু’টি প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড দেয়া হয়েছে। তবে সেখান থেকে খুব সামান্য টাকা পাই। সে টাকায় সংসার চলে না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে দু’টি হুইল চেয়ারেরও দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো ধরে চালানোর মত শক্তিই নেই আমাদের গায়ে। কেউ যদি তাতে বসিয়ে ঠেলে নিয়ে যায়, তাহলেই চলতে পারি।’
প্রতিবেশী জালাল উদ্দিন বলেন, ‘তারা যখন সুস্থ ছিল, তখন কাজকর্ম করত। ভালই চলতো সংসার। হঠাৎ তারা কী এক অজানা রোগে পড়ে পঙ্গু হয়ে গেল। এখন পরিবারটি খুবই কষ্টে আছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সরকার তো অনেক মানুষকেই বাড়ি ঘর করে দিচ্ছে। যদি এই অসহায় পরিবারকে একটা ঘর করে দিত, তবে তারা অন্তত ভালোভাবে ঘুমাতে পারত।’
আরেক প্রতিবেশী আজিজুল হক বলেন, ‘চোখের সামনে এতগুলো মানুষ তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ আমরা কিছুই করতে পারছি না। এদেরকে ভালমতো চিকিৎসা করাতে পারলে হয়তো সুস্থ হয়ে যেতো। সরকার কিংবা হৃদয়বান ব্যক্তিরা যদি এই অসহায় পরিবারটিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে, তাহলে তারা হয়তো তারা নতুন জীবন ফিরে পাবে। ‘
অসহায় এ পরিবাটির বিষয়ে নান্দাইল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ আব্দুর রহিম সুজন বলেন, ‘তাদের বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আমি অবশ্যই নিজে গিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে যতটুকু সম্ভব সহযোগীতা করব। তারা নিশ্চয়ই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি ঘর পাবার যোগ্য।’
উপজেলা চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ জুয়েল বলেন, ‘উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর এখনো কোনো কাজ করার সুযোগ পাইনি আমি। অবশ্যই ঐ পরিবারের প্রতি খেয়াল রাখব এবং সাহায্য সহযোগীতা করব।’
এদিকে রোগটির বিষয়ে জানতে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মতিউর রহমানের কাছে যাওয়া হয়। রোগাক্রান্তদের ছবি এবং ভিডিও দেখেন তিনি। তবে ছবি বা ভিডিও দেখে রোগ নির্ণয় করতে পারেননি অধ্যাপক মতিউর রহমান।
তিনি বলেন, ‘ছবি বা ভিডিও দেখে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব নয়। জ্বর যে কোনো রোগের উপসর্গ হতে পারে। তাদেরকে ভালো করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেই তবে বোঝা যাবে কোন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। আবার সুস্থ হতে পারবেন কি না সেটাও পরীক্ষার পরেই বোঝা যাবে।’
ময়মনসিংহ/মিলন/সনি
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন