ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

আহারে মা!

রুদ্র রুহান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫০, ১৬ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আহারে মা!

প্রতিটি মা-ই সন্তানকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। কোনো আশা বা আকাঙ্খায় নয়, প্রকৃতির নিয়মেই এমনটা হয়ে থাকে। এটাই মায়ের ভালোবাসা। কিন্তু সন্তান বোঝে না সে কথা। তাই মায়ের স্থান হয় গোয়াল ঘরে। বৃদ্ধ বয়সে কোমরে তালা দিয়ে শেকল বাঁধা অবস্থায় সন্তানের করুণায় ধুঁকে ধুঁকে বাঁচতে হয়। স্বাভাবিক হয়েও আখ‌্যা পেতে হয় মানসিক রোগীর।

এমনই এক অমানবিক ঘটনা ঘটেছে বরগুনা সদর উপজেলার গৌরিচন্না ইউনিয়নের চরধুপতি এলাকায়। এর পরও ছেলেদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে চান না সেই মমতাময়ী মা।

প্রতিবেশীরা জানান, পাঁচ মাস আগে মা খবিরুন্নেসাকে (৭৫) গোয়াল ঘরে বিছনা পেতে গরু বাঁধার রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। একদিন তিনি রশি খুলে ফেলেন। ছেলেদের চোখ এড়িয়ে মেয়ের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। পথ থেকে আবার ধরে নিয়ে আসেন ছেলেরা। এবার জোটে শিকল। কোমরে শিকল পরা অবস্থায় এখন অমানবিক জীবন যাপন করছেন তিনি।

বয়সের ভারে কানে একটু কম শোনেন খবিরুন্নেসা। কিন্তু তিনি অন‌্য আর দশ জনের মতোই স্বাভাবিক। প্রতিবেশীরা তেমনটাই জানেন। কিন্তু বৃদ্ধা মায়ের এমন দশা করলেও তার দুই ছেলেকে কিছুই বলার সাহস দেখাতে পারেননি তারা।

প্রতিবেশীরা জানান, মূলত জমি-জমা ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যাওয়ায় অসহায় হয়ে পড়েছেন বৃদ্ধা খবিরুন্নেসা। তিনি এখন ছেলেদের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। ছেলেদের কেউ বৃদ্ধা মায়ের যত্ন নিতে রাজী নন। অবহেলা অসম্মানে গোয়াল ঘরে ফেলে রাখা হয়েছে। পশুর মতো কোমরে লোহার শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছেন। দিনে একবারমাত্র খাবার দেয়া হয়।

প্রতিবেশী হুমায়ুন কবীর জানান, খবিরুন্নেসা দুই ছেলে ও তিন মেয়ের জননী। দুই বছর আগে স্বামী আবদুল হামিদ খান মারা যান। এরপর সহায় সম্পত্তি ছেলে-মেয়েরা ভাগ বাটোয়ারা করে নেন। সে সময় মা খবিরুন্নেসার ভরণ পোষণ নিয়ে ছেলেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়।

এ নিয়ে বৈঠকে আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের সহায়তায় উভয় ছেলে অর্ধেক ভরণ পোষণের ভার বহন করবে এমন সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ছেলেদের কেউই ঠিকমত মায়ের যত্ন নেননি।

ছেলেদের অযত্ন অবহেলার শিকার হয়ে মানসিকভাবে বিদ্ধস্ত হয়ে পড়েন তিনি। এ ছাড়াও রোগে শোকে কাতর খবিরুন্নেসার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এক পর্যায়ে ছেলেরা মাকে গোয়াল ঘরে বিছানা পেতে ফেলে রাখেন। দিনে মাত্র এক বেলা খাবার বরাদ্দ তার জন‌্য।

মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১০টার দিকে ওই বাড়িতে গিয়ে বৃদ্ধা খবিরুন্নেসাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই গোয়াল ঘরের বিছানায় পাওয়া যায়। তখনো কোমরে শেকল বাঁধা ছিল। স‌্যাঁতসেঁতে একটি নোংরা বিছানায় বসে তিনি নাতী-নাতনীদের ডাকছিলেন। শেকলে বাঁধা থাকায় বিছানা ছেড়ে কোথাও যেতে পারেন না তিনি। এমনকি মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে মশারীরও কোনো ব্যবস্থা নেই।

লোকজনের উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি পরিচয় জানতে চান। সে সময় ছেলেদের ব্যপারে জানতে চাইলে খবিরুন্নেসা বলেন, ‘আপনারা কারা বাবা? মোর পোলারা ভালো। হ্যারা মোরো ঠিকমত খাওন দাওন দেয়। মোর পোলাগো যেন কোনো সমস্যা না অয় বাবা।’

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে প্রশ্ন করলেও ছেলেদের ব্যাপারে কোনো অভিযোগ বের হয়নি স্নেহময়ী মায়ের মুখ দিয়ে। ছেলেরা যত অত‌্যাচার-অবহেলাই করুক না কেনো, ছেলেদের মঙ্গল কামনায় তার কোনো কার্পণ‌্য নেই।  তিনি বারবারই বলছিলেন, ‘আমার পোলারা আপনাগো দোয়ায় মোরে ঠিকমত খাওন-দাওন দেয়। হ্যারা অনেক ভালো।’

সে সময় খবিরুন্নেসার ছোট ছেলে বাচ্চুর দেখা মেলে। বাচ্চু জানান, তিনি মায়ের ভরণ পোষণ ঠিকমতই দিচ্ছেন। গোয়াল ঘরে কেন রাখলেন, জানতে চাইলে বাচ্চু বলেন, ‘মায়ের মাথায় সমস্যা, আমি বাইরে কাজে ব্যস্ত থাকি। মা কোথায় কখন চলে যায়, তাই বেঁধে রেখেছি।’

বড় ছেলে বাদলের ঘরে গিয়ে দামি আসবাবপত্র, টিভি ও ফ্রিজ দেখা যায়। এমনকি নিজের ছেলের পড়াশোনার জন্য গৃহশিক্ষকও রেখেছেন। পরিবার পরিজন নিয়ে তিনি যে বেশ কুশলেই জীবন যাপন করছেন। বাদলের ঘরে ঢুকলে যে কেউ অনায়াসেই সেটি বুঝতে পারবেন।

বাদলকে বাড়িতে না পেলেও তার স্ত্রী বেবির সাথে কথা হয়। বেবি বলেন, ‘আমার শাশুড়ি মানসিক রোগী। সে কারণে তাকে ছেলেরা বেঁধে রেখেছেন।’

এদিকে খবর পেয়ে বুধবার সকালে বরগুনা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ইউপি চেয়ারম্যান ওই বাড়িতে গিয়ে বৃদ্ধাকে উদ্ধার করেন। সে সময় তাকে পরিধেয় বস্ত্র ও নগদ অর্থ প্রদান করে মেয়ে তাসলিমার জিম্মায় দেয়া হয়।

গৌরিচন্না ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তানভীর হোসেন বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে বৃদ্ধা খবিরুন্নেসাকে যথাসাধ্য সহায়তা দেয়া হবে। এ ছাড়াও তার ভরণ পোষণ যাতে নিশ্চিত করা হয়, সে ব্যাপারে ছেলেদের ডেকে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ সে সময় চেয়ারম্যান ওই বৃদ্ধাকে দুই হাজার টাকা নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করেন।

জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম‌্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি চরম অমানবিক। এটি সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ছাড়া আর কিছু না। আমরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই মাকে উদ্ধার করেছি। পরে তার মেয়ে তাসলিমার জিম্মায় দিয়ে ছেলেদের ভরণ পোষণ নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছি। এর ব্যতিক্রম ঘটলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’


বরগুনা/রুদ্র রুহান/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়