ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পে দুর্নীতি

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৪৫, ২০ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পে দুর্নীতি

বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা রাজধানীর চিরচেনা রূপ। হোক না তা হালকা, মাঝারি কিংবা মূষলধারে বৃষ্টি। তবে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে সরকারের চেষ্টারও কমতি নেই।

এক হিসেবে দেখা যায় জলাবদ্ধতা নিরসনে বিগত ১০ বছরে অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। তবু মেলেনি সুফল। জলাবদ্ধতা দূর করতে গিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পেই প্রবেশ করেছে দুর্নীতির জল।

জলাবদ্ধতা দূর করতে ওয়াসার এমনই এক প্রকল্প ‘ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণ (ফেজ-২)’। ২০১০ সালে নেওয়া ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও এর বিরুদ্ধে রয়েছে হাজারো দুর্নীতির অভিযোগ।

বিভিন্ন অজুহাতে বৃদ্ধি পাওয়া সর্বশেষ প্রকল্পে ব্যয় ছিল ১৯৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। অভিযোগ রয়েছে প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণার সময় বাস্তবায়ন অগ্রগতি ছিল ৮৫ শতাংশ। এছাড়া দরপত্র ছাড়াই ঠিকাদার নিয়োগ, সড়ক পুনর্নির্মাণ খাতে বরাদ্দ অর্থের সঠিক ব্যবহার না করা, নিম্নমানের কাজ এবং সমন্বয়হীনতায় আর্থিক অপচয়সহ নানা অনিয়ম।

সরকারের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) রিপোর্টেও মিলেছে এর সত্যতা। প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে দুদকের  অনুসন্ধানেও। যদিও ২০১৭ সালের প্রথম দিকে আমলে নেওয়া এমন অনুসন্ধান কাজ এখনো শেষ করতে পারেনি সংস্থাটি।

এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান রাইজিংবিডিকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে নেয়া ওয়াসার ওই প্রকল্পের দুর্নীতির অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। অগ্রগতি সময় হলেই দেখতে পাবেন। অনুসন্ধান কর্মকর্তার সাথে কথা না বলে এ মুহূর্তে আমার পক্ষে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের একজন   কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, প্রকল্পের নথিপত্র, আইএমআইডির প্রতিবেদন ও ওয়াসার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বক্তব্য যাচাই-বাছাই করে বেশ অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। তবে আরো যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন রয়েছে। সবশেষ দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-২ এর পরিবর্তে বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-৩ থেকে বিষয়টি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুসারে অনুসন্ধান কর্মকর্তাও নতুন করে নিয়োগ হবে।

দুদকে দেয়া চিঠিতে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার তাকসিম এ খান অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

এর আগেও দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওয়াসার প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়া, বিভিন্ন অজুহাতে প্রকল্প ডিজাইন, বাস্তবায়নের সময়সীমা ও ব্যয় বাড়ানো ইত্যাদিসহ অন্তত ১১ অনিয়মের উৎস চিহ্নিত করেছিল। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা ও পরিচালকসহ প্রকল্প বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্টরা বড় সুবিধা ভোগ করে থাকেন এমন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ১২টি সুপারিশ আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠিয়েছিল দুদক।

ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণ শীর্ষক প্রকল্পের দুর্নীতি ও অনিয়ম খতিয়ে দেখতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশও করেছিল আইএমইডি।

আইএমইডি ও দুদক সূত্র জানায়, ২০১০ সালের জুলাই থেকে শুরু হওয়া ‘ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণ (ফেজ-২)’ শীর্ষক প্রকল্পটি জুন ২০১৪ সালে শেষ হওয়ার কথা। দুই বছর মেয়াদের প্রকল্পটির সর্বশেষ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৯৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। কিন্তু ব্যয় হয় ১৬৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা। প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণার সময় বাস্তবায়ন অগ্রগতি ছিল ৮৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

আইএমইডির প্রতিবেদন জানায়, কোনো কারণ ছাড়া  মোটা অঙ্কের অতিরিক্ত বিল পরিশোধ হয়েছে প্রকল্পে। মোট ১১টি প্যাকেজে কাজ সম্পন্ন করার অনুমোদন থাকলেও প্যাকেজ হয়েছে তা দুই শতাধিক। ৮০টি ঠিকারদার প্রতিষ্ঠানকে চুক্তি বহির্ভূত অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মিয়া অ্যান্ড মিয়া বিল্ডার্সকে ৪৭ লাখ ২১ হাজার টাকার কাজ দেয়া হয়েছে ৫৩ লাখ ২৮ হাজার টাকায়, মোল্লা ট্রেড অ্যান্ড কমার্সকে ৪৭ লাখ ২১ হাজার টাকার স্থলে ৫২ লাখ ৯৪ হাজার, ইউনিক এন্টারপ্রাইজকে ৪৭ লাখ ২১ হাজার টাকার স্থলে ৫৩ লাখ ৩২ হাজার টাকা, মক্কা ট্রেডার্সকে ২১ লাখ ৯৬ হাজার টাকার স্থলে ২৫ লাখ ১৬ হাজার টাকা এবং এইইচএ কনস্ট্রাকশনকে ৭৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকার স্থলে দেয়া হয়েছে ৮৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। 

মানা হয়নি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ক্রয় কার্যক্রম। ছোট ছোট লটে বিভক্ত করে সংস্থার রুটিন কাজের আদলে সরাসরি ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। ক্রয় কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মিরপুর কাজীপাড়া রোকেয়া সরণিতে ক্যাচপিট নির্মাণ, ধানমন্ডি দুই নম্বর রোডে ৬০০ মিমি ব্যাসের স্টর্ম স্যুয়ার লাইন, আগারগাঁও গ্রামীণ ব্যাংক রোডে ম্যানহোল উঁচুকরণ, পল্লবী এলাকায় দুয়ারীপাড়া খাল পুনঃখনন, সবুজবাগ মান্ডা মেইন রোড এলাকায় ক্যাচপিট তৈরি, হাজারীবাগ খালে ইউ চ্যানেল নির্মাণের জন্য সিকদার মেডিক‌্যাল কলেজ অংশ ও কালু নগর অংশে সাব-সয়েল ইনভেস্টিগেশন।

নিম্নমানের কাজ প্রসঙ্গে প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, মোহাম্মদপুর-আদাবর এলাকায় নির্মিত সড়ক ক্রসিংয়ে আরসিসি বক্স কালভার্টের নির্মাণ কাজ নিম্নমানের হয়েছে। আরসিসি বক্স কালভার্টের স্লাবের রড বের হওয়া এবং সঠিক অনুপাতে কাস্টিং করা হয়নি। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় পুনঃখননকৃত খালে আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ ও স্থাপন যথাযথ হয়নি। ফলে খালের ধারে কোথাও কোথাও ওয়াল বাঁকা হয়ে গেছে। ছিল পর্যাপ্ত মনিটরিংয়ের অভাব।

এছাড়া প্রকল্পের আওতায় ঢাকা ওয়াসার পাইপ ও ড্রেন স্থাপনের সময় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণে ২৭ কোটি টাকা ব্যয় হলেও সিটি করপোরেশন মানসম্মত কাজ না করায় সুফল পাওয়া যায়নি বলেও আইএমইডি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। 



ঢাকা/এম এ রহমান/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়