বাণিজ্য ফাঁদে পাচার ১৬৮১ কোটি টাকা, ২৫ মামলার প্রস্তুতি
আমদানি ও রপ্তানির ফাঁদ পেতে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ১৬৮১ কোটি টাকার বেশি অর্থ। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে এলসি খুলে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি কিংবা পণ্য রপ্তানির জাল নথিপত্র দেখিয়ে হয়েছে এমন অপকর্ম।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে চিহ্নিত হয়েছে শক্তিশালী এমন সিন্ডিকেটের। এরই মধ্যে ৬ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ব্যাংক কর্মকর্তাসহ অন্তত ৬৮ জন আসামির বিরুদ্ধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে মিলেছে ২৫ মামলার অনুমোদন।
যেকোনো সময় শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃক পর্যায়ক্রমে দায়ের হতে যাচ্ছে মামলাগুলো। আসামির তালিকায় রয়েছে ব্যবসা সংশ্লিষ্টরাও। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের বিভিন্ন সূত্র বিষয়টি রাইজিংবিডিকে নিশ্চিত করেছে।
এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. সহিদুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে মামলার অনুমোদনের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও বিস্তারিত জানাতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, এনবিআর থেকে মামলাগুলোর অনুমোদন মিলেছে। মামলা দায়ের করার পর আপনারা এমনিতেই জানতে পারবেন।
পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ও ৬টি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- এগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপি ৪৩৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা, হেনান আনহুই এগ্রো এলসি ৪৪০ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, রূপালী কম্পোজিট লেদাওয়্যার লিমিটেড ৩৭৮ কোটি ৯ লাখ টাকা, হেব্রো বাঙ্কো ২৯২ কোটি ২৩ লাখ টাকা, এস বি এক্সিম বাংলাদেশ ৯২ কোটি ১০ লাখ টাকা ও আইমান টেক্সটাইল অ্যান্ড হোসিয়ারী লিমিটেড ৪৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
অনুসন্ধান প্রতিবেদনের বিষয়ে এনবিআর সূত্রে জানা যায়, এগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপির ৯টি বি অব এন্ট্রির বিপরীতে ৪৩৩ কোটি ৬২ লাখ টাকার মানিলন্ডারিং অপরাধের প্রমাণ পাওয়ায় দায়ের হচ্ছে পৃথক ৯টি মামলা। যেখানে আসামির তালিকায় রয়েছে ১১ জন।
অন্যদিকে হেনান আনহুই এগ্রো এলসির ১১ জনের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে ছয়টি বিল অব এন্ট্রি অনুযায়ী পৃথক ৬টি মামলা করার অনুমোদন দিয়েছে এনবিআর।
সূত্র জানায়, রূপালী কম্পোজিট কর্তৃক অপরাধে মানিলন্ডারিংয়ের এক মামলায় ১৫ জন আসামি হয়েছে। অন্যদিকে হেব্রো বাঙ্কোর ১৪ জনের বিরুদ্ধে ৭টি বিল অব এন্ট্রি অনুযায়ী পৃথক আরো ৭টি মামলার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে তিন মামলায় পৃথক ৪৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা ও চার মামলায় ৩৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয়েছে।
এস বি এক্সিম বাংলাদেশের মালিক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের সাবেক এমডিসহ ৯ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও তিন সিএন্ডএফ এজেন্টসহ ১৩ জনকে আসামি করে আরো একটি মামলার অনুমোদন মিলেছে। এছাড়া আইমান টেক্সটাইলের চার মালিকের বিরুদ্ধে মামলার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে মেসার্স হেনান আনহুই এগ্রো এলসি ও মেসার্স এগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপি নামে দুইটি প্রতিষ্ঠানের নামে ১৭টি চালানে ৯০টি কনটেইনারে পণ্য আমদানিতে মূলধনী যন্ত্রপাতি ঘোষণা দিলেও পাওয়া যায় সিগারেট, এলইডি টেলিভিশন, ফটোকপিয়ার মেশিন ও মদ। এছাড়া দুইটি প্রতিষ্ঠান গত তিন বছরে ১৫টি এলসির মাধ্যমে ৭৮টি কনটেইনারে পণ্য আমদানি করেছে। তবে কি পণ্য আমদানি করেছে তার তথ্য পাওয়া যায়নি। এগ্রো বিডি প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজার খোরশেদ আলমের নামে ২০১৬ ও ১৭ সালে ৯টি এলসিতে ৪৬টি কনটেইনারে পণ্য আমদানির আড়ালে ৪৩৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা পাচার করেছে। দুই প্রতিষ্ঠানের যেমন অস্তিত্ব নেই, তেমনি এলসি খোলা থেকে শুরু করে পণ্য খালাস প্রতিটি পর্যায়ে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তার প্রমাণ মিলেছে।
রূপালী কম্পোজিটের প্রতিবেদনে বলা হয়, রূপালী কম্পোজিট ক্রিসেন্ট গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি পণ্য রপ্তানির আড়ালে ৩৭৮ কোটি ৯ লাখ টাকা পাচার করেছে। এ ঘটনার মূল হোতা চেয়ারম্যান এমএ কাদের এবং তার স্ত্রী ও কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুলতানা বেগম। এছাড়া পাচারের সঙ্গে জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ করপোরেট শাখার ১৩ কর্মকর্তাও জড়িত। ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলার অনুমতি মিলেছে। ১৯২টি রপ্তানি বিলের মধ্যে ১৯০টি বিলের প্রাপ্য বিল ৩৭৮ কোটি ৯ লাখ টাকা দেশে আসেনি। এর আগেও রূপালী কম্পোজিটসহ ক্রিসেন্ট গ্রুপের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে পৃথক মামলা হয়েছে।
হেব্রো বাঙ্কোর প্রতিবেদনে বলা হয়, হেব্রো বাঙ্কো ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সাত এলসিতে ৩১ কনটেইনার পণ্য আমদানি করেছে। এ প্রতিষ্ঠানও মূলধনী যন্ত্রপাতি ঘোষণায় জাল কাগজপত্র ব্যবহার করে মদ, সিগারেট, টেলিভিশন আমদানি করে ২৯২ কোটি ২৩ লাখ টাকা পাচার করেছে বলে অনুসন্ধানে প্রমাণ মিলেছে।
ঝিনাইদহের প্রতিষ্ঠান এসবি এক্সিমের মালিক শাহজাহান বাবলু প্রকৃতপক্ষে কোনো রপ্তানি না করে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তায় ভুয়া রপ্তানি দলিল দাখিল করে অর্থপাচার ও আত্মসাৎ করেছে। যেখানে ব্যাংক কর্মকর্তা ও পরিচালনা বোর্ডের প্রত্যক্ষ যোগসাজশ ও সহায়ক ভূমিকা ছিল। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিএন্ডএফ এজেন্টদের বিরুদ্ধেও মানিলন্ডারিং অপরাধ সংগঠিত করেছেন। প্রতিষ্ঠানটি কর্মাস ব্যাংকের সহায়তায় মাটির তৈরি টেরাকোটা রপ্তানির নামে প্রায় ৯২ কোটি টাকা পাচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন সূত্রে আরো জানা যায়, কালিয়াকৈর চন্দ্রা এলাকার বন্ডেড প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল পণ্য তৈরি না করে খোলাবাজারে বিক্রি করে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করেছে। তিন বছরে প্রতিষ্ঠানটির খোলাবাজারে প্রায় ৫৬ কোটি টাকার কাঁচামাল বিক্রির মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ২৮ কোটি টাকার শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে। একই সময়ে প্রায় ৪৪ কোটি ৬০ হাজার টাকার পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে কোন অর্থ ফেরত আসেনি।
ঢাকা/এম এ রহমান/সাইফ
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন