ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

আজিমপুর মাতৃসদনে দ্বিগুণ মূল্যের কারসাজি

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫১, ২৮ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আজিমপুর মাতৃসদনে দ্বিগুণ মূল্যের কারসাজি

রাজধানীর আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। নাম শুনলে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট মনে হলেও এটি একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল। নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেয়ার লক্ষ্যে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আওতাধীন হাসপাতালটি ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ ২০০০ সালে পুনরায় শুরু হয় এর যাত্রা। 

অথচ এই প্রতিষ্ঠানটিতে চলছে হরিলুট। বাজার থেকে দ্বিগুণ দামে চলছে কেনাকাটা। ওষুধ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নির্ধারিত মূল্য তালিকা থাকলেও পকেট ভারি করতে ওষুধ, সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি ও প্যাথলজি আইটেম ক্রয় হচ্ছে দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে।

২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি সরকারি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে এই প্রক্রিয়ায়। আত্মসাতের বিষয়টি হালাল করতে অনেকক্ষেত্রে নেয়া হয়নি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন। অথচ সরকার নির্ধারিত মূল্যের বাইরে ওষুধ কেনার প্রয়োজন হলে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়ার বিধান রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানেও পাওয়া গেছে এসব তথ্যের সত্যতা।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছর বাজারদরের চেয়ে উচ্চ মূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী কেনা হয়। যেমন- ৮২ টাকা মূল্যের পলিস ক্যাথেটার ক্রয় করা হয়েছে ২২৭ টাকায়, ৩১৭ টাকার সার্জিক্যাল সুচের মূল্য ধরা হয়েছে ৮৭৬ টাকা, ১০৭ টাকার এট্রোমেটিক ক্রোমিক ক্যাটগাটের ক্রয়মূল্য ৩৮২ টাকা, ৩২ টাকার সেলাই সেট ক্রয় হয়েছে ১৪২ টাকায়, প্রতিটি ব্লাড গ্লুকোজ এস্টিমেশন কিটের নির্ধারিত মূল্য তিন হাজার ৯৬০ টাকা হলেও কেনা হয় সাত হাজার ৫৯২ টাকায়।

প্রতিটি এক্স-রে ডেভেলপার অ্যান্ড ফিক্সারের মূল্য এক হাজার ১০০ টাকা, কেনা হয় দুই হাজার ৫৮২ টাকায়, সলিউশন ফর হিউমেলিজারের নির্ধারিত মূল্য এক হাজার ৫৯২ টাকা, কেনা হয় তিন হাজার ৮০৬ টাকায়, প্রতিটি ডিসপোজেবল সিরিঞ্জের নির্ধারিত মূল্য ছয় টাকা ৬০ পয়সা, কেনা হয় ১২ টাকায়, সনি টাইপের ইউএসজি পেপারের নির্ধারিত মূল্য এক হাজার ৩২০ টাকা, কেনা হয় দুই হাজার ৪২২ টাকায়।

এভাবে শতাধিক আইটেমে ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কেনাকাটায় আত্মসাৎ করা হয় পাঁচ কোটি ২৮ লাখ টাকার বেশি। যার পিছনের কারিগর প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী ঠিকাদার। যারা রাজনৈতি পরিচয়কে ব্যবহার করে স্বার্থ উদ্ধার করতে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

ঠিকাদার হিসেবে ওষুধ সরবরাহ প্রতিষ্ঠাগেুলো হলো- মনার্ক এস্টাবলিশমেন্ট, মেসার্স নাফিসা বিজনেস কর্নার,সান্তনা ট্রেডার্স, মেসার্স মোস্তাকিম এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স তসলিম এন্টারপ্রাইজ।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি সভাপতি ডা. ইসরাত জাহান কথা বলতে অস্বীকার করেন।

হাসপাতালটির কেনাকাটায় দুর্নীতির এ অভিযোগ অনুসন্ধানে গত ১১ নভেম্বর ডা. ইশরাত জাহানকে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও দুদক উপপরিচালক মো. আবুবকর সিদ্দিক  জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এছাড়া বক্তব্য নেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট আরো কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার।

অনুসন্ধানে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় কমিশনের অনুমোদনক্রমে যে কোনো সময় মামলা দায়ের হতে পারে। যেখানে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি, ঠিকাদার ও বিভিন্ন সময় প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ ১২ থেকে ১৫ জন আসামি হতে পারে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। দুদক অভিযুক্তদের বিরেুদ্ধে দণ্ডবিধি ৪০৯/৪২০/১০৯ ধারা তৎসহ ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অনুসন্ধান প্রতিবেদন তৈরি করছেন। চলতি সপ্তাহে অনুসন্ধান প্রতিবেদন কমিশনের উপস্থাপন হতে পারে বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র জানিয়েছে।

এ বিষয়ে দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই। যেহেতু অনুসন্ধান চলছে, তাই এ অবস্থায় কোনো বক্তব্য দেওয়া যায় না। অনুসন্ধান শেষে কমিশন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর আজিমপুরের এই মাতৃসদনে রেজিস্ট্রেশন না করার অজুহাতে যন্ত্রণায় কাতর ছিন্নমূল পারভীনকে রাস্তায় বের করে দেওয়া হয়েছিল। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে অবশেষে রাস্তার ওপরেই বাচ্চা প্রসব করেন। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ব্যাপক ঝড় উঠেছিল। ওই সময় হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে ছিলেন ডা. ইশরাত জাহান।

ওই ঘটনা উচ্চ আদালতের নজরে আনা হলে আদালত তদন্তপূর্বক দায়ীদের ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশ দেন।

হাইকোর্টের নির্দেশনায় বলা হয়, ‘এ ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। এটা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সভ্যতার ওপর কালিমা লেপন করেছে। রাষ্ট্র লাখ লাখ আশ্রয়প্রার্থীকে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। অথচ রাষ্ট্রের ভেতরে কী হচ্ছে? গরিব জনগোষ্ঠী আজ নিগৃহিত। হাসপাতাল থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে দেওয়া হচ্ছে। রাস্তায় প্রসব করছে। এটা দুঃখজনক। সরকারের এ বিষয়ে আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন।’


ঢাকা/এম এ রহমান/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়