ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

মহামারিতে রূপ নিয়েছে ধর্ষণ

মাকসুদুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫১, ২২ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মহামারিতে রূপ নিয়েছে ধর্ষণ

লাগাম টানা যাচ্ছে না ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ। ধর্ষকদের টার্গেটে পরিণত হচ্ছে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী থেকে কোমলমতি অবুঝ শিশু পর্যন্ত। সামাজিক অবক্ষয় এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ধর্ষণ মহামারি রূপ নিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত শনিবার রাতে শাহজাহানপুরে ধর্ষকের লালসার শিকার হয়েছে ছয় বছরের এক শিশু। চকলেটের লোভ দেখিয়ে ওই শিুশুকে ডেকে নিয়ে যায় বাসার দারোয়ান। শিশুটির ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায় পাষণ্ড দারোয়ান। অসুস্থ হয়ে পড়লে শিশুটিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

পুলিশ কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘ধর্ষকের নির্যাতনে মেয়েটি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ধর্ষককে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে।’

এর আগে কেরানীগঞ্জের এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। কামরাঙ্গিরচরে বাবা নিজেই তার কিশোরী কন‌্যাকে আবুল হোসেন নামে এক ধর্ষকের হাতে তুলে দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে ওই নরাধম মেয়েটির ওপর লালসা মিটিয়ে এসেছে।

কিশোরীর বাবা আবুলের কাছ থেকে ছয় হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন। সময় মতো টাকা শোধ দিতে না পেরে মেয়েকে তুলে দেন তার হাতে।

এছাড়া বাড্ডা, শনির আখড়া, মিরপুর, কাফরুলে ধর্ষকদের লালসার শিকার হয়েছে শিশু ও কলেজছাত্রী। এর মধ্যে রাজধানীর কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় ফুঁসে ওঠে পুরো দেশ। এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে রাজধানীর ৫০টি থানায় ৪৯৮টি যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করা হয়। ভুক্তভোগীদের এক অংশ শিশু হলেও স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি।

বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে ৯০২ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর আগের বছর ছিল ৩৫৬ জন। ধর্ষণের শিকার ৪৮ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছর এবং ৩৯ শতাংশের বয়স সাত থেকে ১২ বছরের মধ্যে।

অন্যদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা হয়েছে এক হাজার ৯২৪টি। এর মধ্যে ৫১.৬২ শতাংশই ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে।

সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) সোহেল রানা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার ৮৪ শতাংশ চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। দুয়েকটি ঘটনায় বিচ্যুতি থাকতে পারে। বেশিরভাগ ঘটনা ৯৯৯ এর মাধ্যমে জানতে পেরেছে পুলিশ।’

আইন ও সলিশ কেন্দ্র (আসক) এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ১৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৭৩২ জন। আবার ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮১৮ জন। ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শহীদুল হক বলেন, ‘নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের ঘটনার পেছনে বহুমুখী কারণ রয়েছে। ধর্ষণের ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে ঘটে আসছে। বিচারহীনতার কারণে জনসম্মুখে বলার কিংবা দৃষ্টান্তস্থাপনের মতো কিছুই হচ্ছে না। আবার আইনের ফাঁক গলে পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। এ কারণে ধর্ষণের মতো ঘটনা বেড়েই চলেছে।’

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার বিচার ১৮০ দিনের মধ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে শেষ করতে হবে। কিন্তু নির্দিষ্ট এই দিনে একটি মামলা শেষ হয়েছে বলে কোনো নজির নেই। পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ, দুর্বল তদন্ত সর্বোপরি সাক্ষীর অভাবে মামলাগুলোর বেশিরভাগই বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে। অনেক মামলা আছে যেগুলো এক যুগ পার হলেও শেষ হয়নি।

মূলত এসব কারণেই ধর্ষণের ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক।

তিনি বলেন, ‘দেশের যে সামাজিক বলয়, তাতে বিচারহীনতা ও নিরাপত্তাহীনতার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ধর্ষণকে ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা সমাজের অনেক জায়গায়ই নেই। ধর্ষণ যে একটা নৃশংস ও জঘন্য অপরাধ সে সম্পর্কেও সমাজে বিশেষ প্রচারণা নেই। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিও এখন অনেকাংশে দায়ি।’


ঢাকা/মাকসুদ/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়