ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বাণিজ্যের নামে অর্থপাচার : অভিনব কৌশলীদের খুঁজছে দুদক

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪৪, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাণিজ্যের নামে অর্থপাচার : অভিনব কৌশলীদের খুঁজছে দুদক

চট্টগ্রাম বন্দরে বিভিন্ন সময় পণ্য আমদানির আড়ালে কখনো আসছে বালুর বস্তা, ইট কিংবা ঘোষণার বাইরে ভিন্ন কোনো পণ্য। আবার অনেক সময় আমদানির নামে আসছে খালি কন্টেইনার।

বেশ কিছুদিন ধরেই এমন আজব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। মিথ্যা ঘোষণায় অর্থ পাচারের ঘটনা নতুন নয়। এসব ঘটনায় হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। এর মাঝে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে অ‌্যান্টি মানিলন্ডারিং শাখা গঠন করা হলেও উন্নতির লক্ষণ নেই।

ওভার ইনভয়েসিং ও মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার রোধে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের ব্যর্থতা সনাক্ত করতে এবার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মাঠে নেমেছে। এরই মধ্যে দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা বেশ কিছু নথি-পত্র সংগ্রহ করেছেন। সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র রাইজিংবিডিকে এ তথ‌্য নিশ্চিত করেছে।

ওভার ইনভয়েসিং ও মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার প্রতিরোধ ও এন্টি মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত কার্যক্রম গ্রহণে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের ব্যর্থতার অভিযোগ শীর্ষক একটি চিঠির সূত্র ধরে জানা যায়, অভিনব কৌশলের সঙ্গে কোন কোন দপ্তরের কর্মকর্তা জড়িত তা খুঁজে বের করতে দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক সোমা হোড়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি দুদকের মানিলন্ডারিং শাখা হতে ইস্যুকৃত চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, দুদক আইন ২০০৪ ও দুদক বিধিমালা ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা অনুযায়ী অনুসন্ধান কাজ সম্পন্ন করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য কমিশন থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বিদেশে অর্থ পাচার রোধে দুদকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের দেশে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার একমাত্র এনবিআরের। আমাদের লক্ষ্য হলো চট্টগ্রাম বন্দরে এন্টি মানিলন্ডারিং শাখা গঠিত হওয়ার পরও কেনো এসব ঘটনা আটকানো যাচ্ছে না এবং কাদের ব্যর্থতা রয়েছে তাদের খুঁজে বের করা।’

দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘ট্রেড বেইজড মানিল্ডারিং প্রতিরোধে সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যান আমার সাথে দেখা করেন। তিনি আমার সহযোগিতা চেয়েছেন। আমরা অনেক বিষয়ে একমত। এ বিষয়ে একত্রে কাজ করতে হবে।’

চট্টগ্রাম বন্দরে ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর সর্বপ্রথম কন্টেইনার ভর্তি বালু আটকের ঘটনা ঘটে। এর কিছুদিন পর ৯ অক্টোবর চীন থেকে আমদানি করা আরেকটি কন্টেইনারেও বালু এবং মাটি পাওয়া গেছে। একই বছরের ২২ অক্টোবর চীন থেকে আমদানিকৃত ৩০ লাখ টাকা মূল্যের তুলার বদলে এসেছে বালু। এ ঘটনায় মোটা অঙ্কের অর্থ পাচার হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি চীন থেকে আসা সাড়ে ২৩ হাজার কেজি সুতা আমদানির পরিবর্তে কনটেইনার খুলেও পাওয়া যায় বালুর বস্তা। সর্বশেষ ৪ ফেব্রুয়ারি চীন থেকে ৪০ ফুট লম্বা কনটেইনার ভর্তি বালুর বস্তা আসে। অথচ এসব কন্টেনারে ৪৯ হাজার ৬৯৭ ডলারের সুতা আসার ঘোষণা ছিল।

এ বিষয়ে জানতে চট্রগ্রাম বন্দর কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলমকে মুঠোফোনে কল দিলেও জবাব পাওয়া যায়নি। তবে আটকের ঘটনায় সম্প্রতি তিনি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘অনিয়ম প্রতিরোধ করা আমাদের দায়িত্ব। সম্প্রতি বেশ কিছু এমন ভূয়া চালান আটক করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের এই কার্যক্রম অব্যহত থাকবে।’

কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, অর্থ পাচারের সঙ্গে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট বেশ সক্রিয়। যার সঙ্গে সিএন্ডএফ এজেন্ট, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও কাস্টমসের অসাধু কিছু কর্মকর্তা রয়েছেন। মূলত ওভার ইনভয়েসিং ও মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করতেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়।

এসব ঘটনায় মামলা হলেও কেবল কোম্পানিকে জরিমানা করেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে অধিকাংশ সময়। এছাড়া ফৌজদার অপরাধের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে তেমন অগ্রগতি নেই।

আমদানি বাণিজ্যের আড়ালে টাকা পাচার ঠেকাতে ২০১৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের এক ডেপুটি কমিশনারকে প্রধান করে ৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটির মাধ্যমে অ্যান্টি মানিলন্ডারিং শাখা গঠন করা হয়েছিল।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় পাচারকৃত অর্থের ৮০ শতাংশেরও বেশি বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে পাচার হয়। বিএফআইইউ সূত্রানুযায়ী আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে অর্থ পাচারের হার সবচেয়ে বেশি।

আমদানিযোগ্য পণ্য বা সেবার মূল্য বৃদ্ধি করে বিশেষত যে সকল পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কম যেমন মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, কম্পিউটার সামগ্রী ইত্যাদি বা যে সকল পণ্য বা সেবার দাম নির্ধারণ কঠিন সেসকল পণ্য বা সেবা আমদানির মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়ে থাকে।

সর্বশেষ গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) কর্তৃক অর্থ পাচার বিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী ট্রেড মিসইনভয়েসিং এর মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ বাইরে চলে গেছে এমন প্রথম ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৮তম।

একইভাবে উক্ত রিপোর্টে ট্রেড মিসইনভয়েসিং-এর মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ দেশে প্রবেশ করেছে এমন প্রথম ৫০টি দেশের তালিকায়ও রয়েছে বাংলাদেশের নাম।


ঢাকা/এম এ রহমান/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়