ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

পুঁজিবাজারের ৯১ কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড ফেস ভ্যালুর নিচে

নুরুজ্জামান তানিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:১৬, ৭ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পুঁজিবাজারের ৯১ কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড ফেস ভ্যালুর নিচে

কয়েক বছর ধরে পুঁজিবাজারে মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করায় অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিট প্রতিদিন একটু একটু করে দর হারিয়েছে। সম্প্রতি দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিটের দর তলানিতে ঠেকেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তালিকাভুক্ত এক চতুর্থাংশের বেশি বা ৯১টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিটের দর অভিহিত মূল্য (ফেস ভ্যালু) ১০ টাকার নিচে নেমে এসেছে।

একাধিক বিনিয়োগকারীর অভিযোগ, পুঁজিবাজারে দুর্বল ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। কোম্পানিগুলো কয়েক বছর ভালো মুনাফা দেখিয়ে পরে লোকসানিতে রূপ নিচ্ছে। এরপর চলে যাচ্ছে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে। মৌল ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি পুঁজিবাজারে না আসায় বারবার প্রতারিত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

এছাড়া, নানা অনিয়মের কারণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ওপর আস্থা হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। যে কারণে এমন করুণ দশা বিরাজ করছে কোম্পানিগুলোর শেয়ার ও ইউনিটে। বিশেষ করে, ব্যাংক খাতের শেয়ার দামের দুরবস্থার কারণে সার্বিক শেয়ার বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ার বাজারে ধারাবাহিক দরপতন করোনারভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে তা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে।

তবে শেয়ার বাজার ভয়াবহ দরপতনের কবলে পড়লে গত ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে পতন ঠেকাতে কোম্পানিগুলোর শেয়ার ও ইউনিট দরের সার্কিট ব্রেকারের ফ্লোর প্রাইসের (যে দরের নিচে নামতে পারবে না) সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করে নির্দেশনা জারি করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। এ ইতিবাচক সিদ্ধান্তে গত ২২ থেকে ২৫ মার্চ এ ৪ কার্যদিবসে শেয়ার বাজারে কিছুটা উত্থানের দেখা মেলে। মূলত ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণের ফলে বড় পতন থেকে শেয়ার বাজার রক্ষা পেয়েছে বলে মনে করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীসহ বাজার সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা স্টক একচেঞ্জে (ডিএসই) ডিবেঞ্চার, করপোরেট বন্ড ও ট্রেজারি বন্ড বাদে ১৯টি খাতে মোট তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের সংখ্যা ৩৫৮টি। এর মধ্যে ১০টি খাতে মোট ৯১টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের শেয়ার এবং ইউনিটের দর অভিহিত মূল্যের নিচে সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে, যা মোট তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও ফান্ডের ২৫ শতাংশের অধিক।

গত বছরের ৫ ডিসেম্বর তালিকাভুক্ত ৩৪৬টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৭২টির শেয়ার এবং ইউনিট দর অভিহিত মূল্য নিচে লেনদেন হয়েছে। আর এর আগে ৫ নভেম্বর ৩৫৬টি কোম্পানির মধ্যে ৫২টি অভিহিত মূলের নিচে কেনাবেচা হয়েছে।

অভিহিত মূলের নিচে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে ১০টি কোম্পানির শেয়ার। এসব কোম্পানির শেয়ার বর্তমানে ৩ টাকার নিচে লেনদেন হচ্ছে। সে হিসেবে বর্তমানে কোম্পানিগুলোর শেয়ার চকলেটের চেয়েও কম দরে পাওয়া যাচ্ছে।

কোম্পানিগুলোর মধ্যে- ইউনাইটেড এয়ার ১.৪০ টাকায়, ফ্যামিলিটেক্স (বিডি) ও সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইলস ১.৮০ টাকায়, তুং হা নিটিং অ্যান্ড ডাইং ২ টাকায়, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনস ২.২০ টাকায়, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ২.৪০ টাকায়, কেয়া কসমেটিকস ২.৬০ টাকায়, তাল্লু স্পিনিং মিলস ২.৭০ টাকায়, অ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্স ২.৯০ টাকায়, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ৩ টাকায় সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে।

বাজার পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, ডিএসইতে বিভিন্ন খাতের মধ্যে বর্তমানে মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ইউনিট অভিহিত মূল্যের নিচে লেনদেন হয়েছে। এ খাতে তালিকাভুক্ত মিউচ্যুয়াল ফান্ডের সংখ্যা ৩৭টি। এর মধ্যে ৩৫টি বা ৯৫ শতাংশ মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিটের দর অভিহিত মূল্যের নিচে রয়েছে। ফান্ডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম দরের ইউনিটের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে আছে ফার্স্ট বাংলাদেশ ফিক্সড ইনকাম ফান্ড। ফান্ডটির ইউনিট ৩.৩০ টাকায় সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে। এরপরে কম দরের ইউনিটের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ফার্স্ট জনতা মিউচ্যুয়াল ফান্ড ও ইবিএল ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড। ফান্ডগুলোর ইউনিট ৪.১০ টাকায় সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে। তৃতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে এবি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, এক্সিম ব্যাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, পিএইচপি ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড ও পপুলার লাইফ ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিট ৪.২০ টাকায় সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে।

অভিহিত মূল্যের নিচে কোম্পানিগুলো অবস্থান করা খাতের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে টেক্সটাইল খাত। এ খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ৫৬টি। এর মধ্যে ২৪টি বা ৪২ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার দর অভিহিত মূল্যের নিচে রয়েছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম দরের শেয়ারের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইলস ও ফ্যামিলিটেক্স (বিডি)। কোম্পানি দুটির শেয়ার দর সর্বশেষ ১.৮ টাকায় সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে তুং হাই নিটিং অ্যান্ড ডাইং। কোম্পানিটির শেয়ার দর সর্বশেষ ২ টাকায় সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে। আর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশান। কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ ২.২০ টাকায় লেনদেন হয়েছে।

তৃতীয় অবস্থানে আছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত। এ খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ২৩টি। এর মধ্যে ১১টি বা ৪৮ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার দর অভিহিত মূল্যের নিচে রয়েছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম দরের শেয়ারের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট। কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ ২.৪০ টাকায় লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি। কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ ২.৬০ টাকায় সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে। তৃতীয় অবস্থানে আছে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস। কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ ৩ টাকায় লেনদেন হয়েছে। তবে কোম্পানিটির অবসায়নের প্রক্রিয়া চলমান। তাই বর্তমানে কোম্পানিটির লেনদেন বন্ধ রয়েছে।

চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ব্যাংক খাত। এ খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ৩০টি। এর মধ্যে ৮টি বা ২৭ শতাংশ ব্যাংকের শেয়ার দর অভিহিত মূল্যের নিচে রয়েছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম দরের শেয়ারের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে আছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। ব্যাংকটির শেয়ার সর্বশেষ ৩ টাকায় সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যাংকটির শেয়ার সর্বশেষ ৭.২০ টাকায় সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে। তৃতীয় অবস্থানে আছে এবি ব্যাংক। ব্যাংকটির শেয়ার সর্বশেষ ৮ টাকায় লেনদেন হয়েছে।

পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে প্রকৌশল খাত। এ খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ৩৯টি। এর মধ্যে ৩টি বা ৮ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার দর অভিহিত মূল্যের নিচে রয়েছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম দরের শেয়ারের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে আছে অ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্স। কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ ২.৯০ টাকায় লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে গোল্ডেন সন। কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ ৫.৭০ টাকায় সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে অলিম্পিক এক্সেসরিজ। কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ ৬.৮ টাকায় লেনদেন হয়েছে।

এছাড়া, সিরামিকস, খাদ্য ও আনুষাঙ্গিক, বিবিধ, ওষুধ ও রসায়ণ এবং ভ্রমণ ও অবকাশ খাতের দুটি করে কোম্পানির শেয়ার অভিহিত মূল্যের নিচে অবস্থান করছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী রাইজিংবিডিকে বলেছেন, শেয়ার বাজারে দরপতন যখন দীর্ঘায়িত হয়, তখন নিশ্চিত করে বলা যায়, বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে আস্থা নেই।’

এদিকে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বিগত দিনে যেসব নিম্নমানের কোম্পোনি শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে, তাদের শেযার দর অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে গেছে। শেয়ার বাজারের ইতিহাসে এবারই প্রথম ১০ টাকা দামের শেয়ার দেড় বা দুই টাকায় লেনদেন হতে দেখা যাচ্ছে। ফলে ওই কোম্পানিগুলোর শেয়ারের মুল্যমানই প্রমাণ করে যে, কোনো ধরনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই তা শেয়ার বাজারে এসেছে। কোনোভাবেই ওই কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনের সত্যতা যাচাই কর হয়নি।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘যেকোনো কোম্পানির শেয়ার অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে যাওয়া শঙ্কার বিষয়। দীর্ঘদিন অভিহিত মূল্যের নিচে কেনাবেচা হওয়া ভালো লক্ষণ নয়। অভিহিত মূল্যের কোম্পানিগুলো ভালো ব্যবসা করতে না পারায় ভালো লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা ওইসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানে ব্যবসা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ প্রতিষ্ঠানিক সুশাসনের অভাব।’

 

ঢাকা/এনটি/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়