ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বোরহানুদ্দীন কলেজ

আবু বকর ইয়ামিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৭, ১৪ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বোরহানুদ্দীন কলেজ

জমি কেনা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, সরঞ্জাম কেনাকাটা এবং মিটিং-সিটিংয়ের নামে অর্থলুটসহ নানা অভিযোগ উঠেছে রাজধানীর শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজের ব‌্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে।

বিস্তর আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়ম, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি ও অধ্যক্ষের মধ্যে চরম বিরোধের খবর এখন প্রকাশ‌্যে এসেছে। এসব বিষয় ওই কলেজের শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাজীবনকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে।

পুরান ঢাকার চাঁনখারপুলে ৫৪ শতাংশ জমির উপর ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এ কলেজ।

কলেজের নিজস্ব ক্যাম্পাসের জন্য জায়গা কেনায় বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কলেজটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে ও রাইজিংবিডির অনুসন্ধানে এ অভিযোগের বিষয়ে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কলেজ থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে কেরানীগঞ্জে এক বছর ধরে ছয় একর জায়গা কেনার প্রক্রিয়া চলছে। মূল সমস্যাটা সেখানেই। বিষয়টি নিয়ে কলেজের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও অধ্যক্ষসহ সবার মাঝে বিরাজ করছে সন্দেহ এবং চাপা ক্ষোভ।

কলেজ ফান্ডের অর্থ থেকে জমি কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ছয় একর কেনার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কেনা হয়েছে মাত্র সাড়ে চার একর জমি।

কলেজ সংশ্লিষ্ট ব‌্যক্তি ও জমির মূল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কৃষক মিনহাজ উদ্দিনের কাছ থেকে ২৭ শতাংশ জমি কেনা বাবদ দেয়া হয়েছে ৩৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। অথচ দলিলে কলেজের জমি কেনা বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ৫৮ লাখ ৫৯ হাজার টাকা।

আব্দুর রহিম ও তার বোনের ওয়ারিশগণ কলেজের কাছে বিক্রি করেছেন ৫৮ শতাংশ জমি। এ বাবদ তারা পেয়েছেন ৮৭ লাখ টাকা। অথচ কলেজের দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা।

আরেক জমির মালিক সলিমুল্লাহ, কলিমুল্লাহ, হাবিবুল্লাহ, অলিউল্লাহ চার ভাই। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা জমি বিক্রির ব্যাপারে কিছুই জানে না। অথচ একটি দলিলে দেখানো হয়েছে ওই চার ভাইয়ের কাছ থেকে ৪৫ শতাংশ জায়গা ক্রয় বাবদ কলেজের ব্যয় হয়েছে ১ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে, সাইদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে ওই চার ভাই পাওয়ার অব অ‌্যাটর্নি দিয়েছেন তারা। অথচ জমির মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা কাউকে পাওয়ার অব অ‌্যাটর্নি দেননি। তাদের জমিও কারো কাছে বিক্রি করেননি।

এসব অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে জমি কেনার দায়িত্বে থাকা গভর্নিং বডির (জিবি) সভাপতি ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের দিকে।

তবে এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন আখ‌্যায়িত করেছেন জিবির সভাপতি মো. হারুনর রশীদ খান। উল্টো তিনি কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন।

মো. হারুনর রশীদ খান বলেন, আমি কলেজের সভাপতি হওয়ার পর থেকে আগের মতো শতকরা হারে অর্থ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ দাঁড় করানো হচ্ছে। একটা চক্রের স্বার্থে আঘাত লাগায় তারা আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ দিচ্ছে।

তিনি বলেন, এ পর্যন্ত নানাভাবে কলেজের ফান্ড থেকে প্রায় ৫০ লাখ টাকা অপচয় করেছেন অধ্যক্ষ। নিজ বাড়িতে থেকেও ৪৫ হাজার টাকা বাসাভাড়া গ্রহণ, একটি গাড়ির জন্য দুজন চালক ও মাসিক ৩০ হাজার টাকার তেল বাবদ গ্রহণ করেন অধ্যক্ষ। অথচ অডিটে মাসিকের পরিবর্তে বাৎসরিক ৩০ হাজার হিসেবে গ্রহণের মিথ্যা তথ্য দেয়া হয়েছে।

জমি কেনায় গরমিলের বিষয়ে তিনি বলেন, অধ্যক্ষ চেকে সই করার পর আমি সই করি। তাহলে উনিই এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।

এ বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রহমান বলেন, আমার বিরুদ্ধে যা যা অভিযোগ সবই মিথ্যা। আমাকে সব সময় হুমকি-ধামকির মধ্যে রাখা হয়। কলেজের জিবি সভাপতি নিজের পছন্দের লোকদের দিয়ে জমি ক্রয় কমিটি করেছে। তারা সবাই আমাকে নানাভাবে প্রেসার দিয়েই চেকে সই করতে বাধ্য করেছে।

কলেজের সহযোগী অধ্যাপক বদরুল ইসলাম জানান, জমি কেনার সাথে সংশ্লিষ্ট একজন হচ্ছেন আবু নাঈম রাফি। যে প্রশাসনই ক্ষমতায় আসুক না কেন তিনি সেটিকে কাজে লাগিয়ে কলেজের সকল আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির কার্যক্রম পরিচালনা করেন। অত্যন্ত সুবিধাভোগী মানুষ তিনি। এখানে ওনার একটা বড় সিন্ডিকেট আছে, যাদের কাজে লাগিয়ে তিনি এসব কাজকর্ম করে থাকেন।

গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বিপ্লবী শিখা বলেন, জমির রেজিস্ট্রি ঠিক আছে কি না, তা আবু নাঈম রাফি নিজে যাচাই-বাছাই করেছেন। আনিসুর রহমান নামের একজন আছে ওনার সহযোগী। সব কাজ উনি তাকে নিয়েই করেছেন। আমরা কিছুই জানি না।

আপনি তো জমি ক্রয় কমিটির সদস্য ছিলেন, এ কথার জবাবে তিনি বলেন, আমি কিছুই জানি না। সব নাঈম রাফি ও আনিসুর রহমান করেছেন। ওনাদের যখন এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করতাম, তারা বিরক্ত হতো।

হিসাববিজ্ঞান সহযোগী অধ্যাপক আবু নাঈম মোহাম্মদ রাফি বলেন, ২০১৬ সাল থেকে প্রিন্সিপাল নিজে জায়গা দেখছেন। জমি ক্রয় কমিটি হয়েছে ২০১৮ সালে। তার কাছ থেকে জোর করে সই নেব? উনি আইডিয়াল কলেজের প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষার নামে ৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন। সেটা নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেন জিবি সভাপতি। তারপর থেকে তিনি নানা ভিত্তিহীন অভিযোগ করে আসছেন।

কলেজের অন্য শিক্ষকরা বলছেন, কলেজের ফান্ড কুক্ষিগত করার জন্য একটি মহল নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কলেজটিকে নানাভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছে। জমি কেনার নামে কলেজের ফান্ড শেষ করার নানা পাঁয়তারা করছে।

কলেজ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত তাদের অর্থলুটের বনিবনা না হওয়ায় এখন তাদের বিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে। আমরা পড়াশুনার সুষ্ঠু পরিবেশ চাই। কিন্তু কলেজে যে নোংরামি শুরু হয়েছে তাতে কলেজটির দীর্ঘদিনের অর্জিত সুনাম চরমভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আমরা অতি দ্রুত এর সমাধান চাই।

 

ঢাকা/ইয়ামিন/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়