করোনায় কর্মহীন, ক্ষুধার জ্বালায় পথে পথে
কাজ নেই। করোনাভাইরাসের কারণে কাজ হারিয়ে সাহায্যের আশায় রাস্তায় বসে আছেন। ছবিটি ঢাকার পল্টন থেকে তোলা (ছবি: শাহীন ভূঁইয়া )
‘আমি ৪ জনের বাসায় রান্না কইরা দিতাম। এক বাসার বাচ্চা স্কুলে নিয়ে যেতাম। করোনার কারণে কাজে যাইতে নিষেধ করছে। বলছে করোনা গেলে কাজে আসতে। মার্চ থেকে কাজ বন্ধ। ঘরে খাবার নেই, রাস্তায় নেমেছি। ’
এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন করোনায় কষ্টে থাকা মগবাজারের কুলসুম। শুধু কুলসুমই নয়, ঢাকার বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে দেখা গেছে, দ্ররিদ্র, দিনমজুর ও নিম্নবিত্তরা পড়েছেন বিপাকে। দিন এনে দিন খাওয়া লোকদের সংসার চলছে টেনে টুনে। দীর্ঘদিন এমন সংকট চলার শঙ্কাও রয়েছে তাদের। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার চেয়ে তাদের কাছে তিনবেলা খাবার খেতে পাওয়াটা বড় চিন্তা।
বৃহস্পতিবার (২১ মে) পল্টন, মতিঝিল, মগবাজার, শান্তিনগর ও সাতরাস্তা ঘুরে দেখা গেছে, কয়েকজন শিশু, নারী, পুরুষ, বৃদ্ধকে। কেউ কেউ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, আবার কেউ দূরত্ব না মেনেই বসে আছেন। কারও মুখে মাস্ক আছে, কারও নেই। নারীরা শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকেছেন। দেখে মনে হবে অলস বসে সময় কাটাচ্ছেন। কিন্তু তা নয়। অপেক্ষা তাদের ত্রাণের জন্য।
কাজ হারানো অনেক মানুষকে সাহায্যের জন্য রাস্তায় নামতে দেখা যায়। ছবিটি ঢাকার বিজয়নগর থেকে তোলা ( ছবি : শাহীন ভূঁইয়া )
পল্টন, মতিঝিল, মগবাজার ও সাতরাস্তার রোডের সড়কের চিত্রও একই। এদিন সড়কে যান চলাচল সীমিত ছিলো। মোটরসাইকেল চলাচল তুলনামূলক বেশি ছিল। তবে কিছু প্রাইভেটকার দেখা গেছে। সড়কে অবস্থান নেওয়া অসহায় মানুষগুলোর চোখ তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো সেসব প্রাইভেটকারের দিকে চেয়ে থাকতে দেখা যায়। আবার প্রায় ফাঁকা সড়ক ধরে ছুটে আসা কোনও গাড়ি যদি গতি কমায়, তখনই তারা গাড়িটির দিকে ছুটে যাচ্ছে, আশা কিছু একটা সাহায্য হয়তো জুটবে।
সুলতানা খাতুন। মতিঝিলে সড়কে বসে আছেন। মুখে কাপড় মাস্ক হিসেবে ব্যবহার করছেন। তিনি জানান, বাসায় বুয়ার কাজ করতেন। করোনার কারণে অনেকেই বাড়ি চলে গেছে। কাজ নেই। তাই সড়েক এসে ত্রাণের জন্য দাঁড়িয়েছেন।
জালাল উদ্দীন। পল্টন সড়কে সাহায্যের আশায় অপেক্ষা করছেন। তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করতাম। করোনার কারণে এখন বেকার। বয়সও বেড়েছে। আগের মতো পরিশ্রম করতে পারি না। অপেক্ষায় আছি, নিশ্চয়ই আল্লায় ভালো কিছু করবেন।’
পল্টনে রহিম মিয়া বলেন, ‘ভাই, শহরের মানুষের দয়া-মায়া নাই। চাইতে চাইতে মুখ ব্যথা হয়ে যায়। ৩০ জনের কাছে চাইছি, একজনে সাহায্য দিয়েছে। করোনার কারণে কেউ কাজ দেয় না।’
সাহায্যের আশায় রাস্তায় নিম্নবিত্তরা। ছবিগুলো মতিঝিল ও তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে তোলা ( ছবি : শাহীন ভূঁইয়া )
সাতরাস্তা এলাকার কথা হয় মমতাজ বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সাতরাস্তার ফুটপাতে বিভিন্ন ধরেন পিঠা বিক্রি করে তিন মেয়ে নিয়ে সংসার চলতো। করোনার কারণে পিঠা নিয়ে রাস্তায় বসতে পারি না। মার্চ মাস থেকে কাজ নেই। রোজগারও নেই। ঘরে খাবার নাই। একটু সাহায্য করলে আমার তিন মেয়ে নিয়া খাইতে পারতাম। নিজের জন্য না, কষ্ট হইতাছে তিন মেয়ের জন্যে। অগো মুখের দিকে তাকাইয়া রাস্তায় হাত পেতেছি। ’
মতিঝিল এলাকায় দেখা হয় রহিমা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ম্যাচে খাবারের বিক্রি করতাম। মার্চে ভাইরাস আসার পর অনেকেই বাড়ি চলে গেছে। এক মাস জমানো টাকা ভেঙে খেয়েছি। স্বামী রিকশা চালাতো। জানুয়ারি মাস থেকে অসুস্থ। ঘরে ছোট ছোট দুটি বাচ্চা। বিপদে পড়ে এখন রাস্তায় সাহায্য চাইতেছি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুই নম্বর ওয়ার্ডের (খিলগাঁও-গোড়ান) কাউন্সিলর মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন, করোনায় নিম্ন আয়ের মানুষকে সাহায্য করছে ডিএসসিসি। এছাড়া সরকারি-বেসরকারিভাবে সহায়তা করা হচ্ছে। কেউ যদি না পেয়ে থাকে, কাউন্সিলর অফিসে যোগাযোগ করলে সাহায্য দেওয়া হচ্ছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, করোনার কারণে কত মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছে কিংবা প্রতিদিন না খেয়ে থাকছে—সে হিসাবও কারও কাছে নেই। জনপ্রতিনিধিদের অনেকে সহায়তা করেছে। এর বাইরেও অনেককেই আছেন, যারা সহায়তা পাননি। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে বিত্তবানদের।
করোনায় কর্মহীন, ক্ষুধার জ্বালায় পথে পথে। ছবিটি পল্টন থেকে তোলা (ছবি: শাহীন ভূঁইয়া )
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী রাইজিংবিডিকে বলেন, নগরবাসীর জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। লোকলজ্জার ভয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে খাদ্যসামগ্রী গ্রহণে বিব্রতবোধকারীদের জন্য সিটি করপোরেশনের হটলাইনের মাধ্যমে বাসায় খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হচ্ছে। তারপরেও কিছু মানুষ সাহায্যের জন্য রাস্তায় দাঁড়ায়। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এদের মধ্যে অনেকেই সচ্ছল। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন জেলা থেকে আসছে। সমাজকল্যাণ অধিপ্তরের একটি টিম বিভিন্ন সড়েকে ঘুরে ভাতা কার্ড করাসহ বিভিন্ন সহায়তা করছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য অফিসার ও জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ আলম বলেন, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় পথশিশু ও ভিক্ষুকদের ত্রাণসহ আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে।
আসাদ/সাইফ
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন