ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘আমি যে ওর মা…’

কেএমএ হাসানত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:০৩, ১ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ১৩:৪৮, ২৮ আগস্ট ২০২০
‘আমি যে ওর মা…’

রাবেয়া ও তার প্রতিবন্ধী ছেলে রাকিব

এমনিতেই আশ্রয়হীন, তার ওপর ঈদের দিন সকালের বৃষ্টি ভাসিয়ে নিয়েছে রাবেয়ার (৬০) সব ঈদ আয়োজন। প্রতিবন্ধী ছেলেটার মুখে দেওয়ার জন্য একটু ডাল-চালের খিচুড়ি রান্নার আয়োজন করেছিলেন তিনি। কিন্তু বৃষ্টি তার সে আশা পূরণ করতে দেয়নি। অনাহারে থাকা ছেলেটার মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলেন রাবেয়া।

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে জাতীয় চার নেতার মাজারের পাশে একটু খালি জায়গা। সেখানেই প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে আশ্রয় গড়েছেন রাবেয়া। প্যারালাইজড স্বামী আবুল হোসেন, ১৯ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী ছেলে রাকিব আর ছোট এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। অসুস্থ স্বামী আর ছেলেকে রেখে কোথাও কাজ করতে যাওয়ার সুযোগও নেই। একটি কাঠের ট্রলিতে ছেলেকে নিয়ে ভিক্ষা করেন। মানুষের দয়ায় যা জোটে, তা দিয়েই সবার মুখে আহার তুলে দেন রাবেয়া।

ঈদের নামাজ শেষে হাইকোর্ট মাজারের সামনে ভিক্ষা করতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন রাবেয়া। খোলা আকাশের নিচে তিনটি ইট দিয়ে তৈরি চুলায় তখন ডাল-চাল তুলে দিয়েছিলেন। হঠাৎ বৃষ্টি এসে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। রাবেয়াদের ঈদের আয়োজন এভাবেই নষ্ট হয়ে যায় মুহূর্তে মধ্যে।

রাবেয়া এ প্রতিবেদককে জানান, ফরিপুরের চরদলিল জিরা এলাকায় তাদের বাড়ি ছিল। বহু আগে পদ্মা নদীর ভাঙনে সব বিলীন হয়ে যায়। তার কিছু দিন আগেই রাকিবের জন্ম। সব হারিয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমান রাবেয়া। স্বামী আবুল হোসেন মিস্ত্রী ছিলেন। এখন তিনি প‌্যারালাইজড। ছেলে বড় হতে থাকলে বোঝা যায়, সে প্রতিবন্ধী। যখন চিকিৎসা করাতে গেছেন, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফলে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবন্ধী ছেলের ভার তাকে বয়ে চলতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘ভিক্ষা করতে ভালো লাগে না। মানুষজন নানা কথা বলে, সেগুলো আর কত শোনা যায়। তবু ছেলে-স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে সব সয়ে যাচ্ছি। পরের দয়ায় বাঁচতে হলে কিছু কথা সহ্য করতেই হবে।’

অসহায় ওই নারী বলেন, ‘শুনেছি, সরকার প্রতিবন্ধীদের নানা ধরনের সাহায্য করছে। আমি আমার ছেলের জন্য অনেক ঘুরেছি, কারো কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাইনি। কিছু দিন আগে মগবাজারে এক অফিসে নাম লিখিয়ে এসেছি। জানি না, তারা কিছু করবেন কি না।’

তিনি আরো বলেন, ‘আপনারা তো সাংবাদিক। আমাদের শেখের বিটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার ছেলেটির কথা একটু বলবেন। আমি আর পারছি না। এই প্রতিবন্ধী ছেলেকে কোথায় ফেলব। আমি যে ওর মা। সবাই ছেড়ে গেলেও আমার পক্ষে তো সম্ভব না।’

বৃষ্টিতে ঈদ আয়োজন নষ্ট হয়ে গেলে আগের রাতের সামান্য পান্তা ভাত ছিল ছেলের মুখে তুলে দিচ্ছিলেন রাবেয়া। রাকিব বার বার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল। আর অস্পষ্ট ভাষায় যা বলছিল, সেটা বোঝা যায় না। তার মা রাবেয়া বলেন, ‘ও বলছে, আজ ঈদ আমাকে মাংস-খিচুড়ি দাও। বলেন, আমি এখন কোথা থেকে ওকে মাংস-খিচুড়ি এনে দেব?’

ছিন্নমূলদের ঈদ-২:

শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটের উল্টো দিকে জাতীয় জাদুঘরের দেয়াল ঘেঁষে এক টুকরো পলিথিনের ওপর ঘুমাচ্ছিল ছিল ৩/৪ বছরের এক শিশু। আশপাশে কেউ ছিল না। শিশুটাকে দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। একটু পর তিন মাস বয়সের আরেকটি শিশুকে কোলে নিয়ে মধ্য বয়সী এক নারী এলেন। জানলাম, ওটাও তার সন্তান।

লাভলী (২৫) ও তার স্বামী সোহেল। দুজনেই ছিন্নমূল। বাড়ি কোথায় ও মা-বাবা কে কিছুই বলতে পারেন না লাভলী। সোহেলের সঙ্গে অনেক দিন আগে পথে পরিচয়, এরপর বিয়ে। তারা রাজধানীতে যখন যেখানে জায়গা পান, সেখানেই রাত-দিন কাটান। এরমধ্যে একটি সন্তান হয়। তার বয়স এখন ৪ বছর। স্বামী সোহেল মাদকসেবী। লকডাউনের আগে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। এখন তিনি জেলে আছেন। স্বামী জেলে যাওয়ার পর লাভলীর আরেকটি সন্তান জন্ম নেয়। এখন দুই শিশু সন্তান নিয়ে দিশেহারা লাভলী।

ঈদ কেমন কাটছে? এ প্রশ্নের জবাবে অশ্রুসজল চোখে লাভলী বলেন, ‘স্যার, ঈদ তো আপনাদের জন্য। দুই সন্তানের গায়ে কাপড় নাই। তাদের মুখে একটু খাবারই দিতে পারি না।’

তিনি আরো বলেন, ‘কোথাও স্থায়ীভাবে থাকতে পারি না। পুলিশ আর দুষ্টু লোকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। তবে এই জায়গাটা ছাড়তে পারছি না। কারণ, অন্য কোথাও গেলে ওদের বাপ এসে খুঁজে পাবে না।’

লাভলীর সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন দুপুর ১টা। তিনি তখন পর্যন্ত না পেরেছেন সন্তানদের মুখে কিছু তুলে দিতে, না পেরেছেন নিজে কিছু খেতে।

ঢাকা/হাসনাত/রফিক

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়