ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান: ১৬ মামলায় চার্জশিট, তদন্তাধীন ৯টি

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২৪, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৮:৩৫, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান: ১৬ মামলায় চার্জশিট, তদন্তাধীন ৯টি

ওপরে এনু-রুপন, মনজু, মিজান ও রাজীব; মাঝে সম‌্রাট ও আরমান; নিচে শামীম, খালেদ, সেলিম, লোকমান ও ফিরোজ

গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের যৌথ সভায় দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা দলের ভেতর শুদ্ধি অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর সপ্তাহখানেক পর ক্ষমতাসীন দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। সমালোচনা করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের দুই নেতার।

এর পাঁচ দিন পর গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে। এরপর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে একে একে গ্রেপ্তার করা হয় ১২ জনকে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের তৎকালীন সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট।

তাদের বিরুদ্ধে মাদক, অস্ত্র ও মানিলন্ডারিং আইনে ২৫টি মামলা দায়ের করা হয়। ইতোমধ‌্যে ১৬টি মামলায় চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এখনো তদন্তাধীন আছে ৯টি মামলা। এসব মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এদিকে ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেপ্তার করা ১২ জনের মধ্যে দুজন জামিনে এবং বাকিরা কারাগারে আছেন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় করা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আদালতের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। সব চাঞ্চল্যকর মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রসিকিউশনকে তাগিদ দিচ্ছে আইন মন্ত্রণালয়।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ‘সরকারের স্বার্থেই এসব প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর তদন্ত ও বিচার দ্রুত শেষ করা উচিত। মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হলে সরকারের অবস্থান আরও পরিষ্কার হবে। পাশাপাশি সরকারের ওপর জনগণের আস্থাও বাড়বে।’

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল বলেছেন, ‘জিকে শামীমের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা ও খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে মাদক মামলায় বিচার শুরু হয়েছে। অস্ত্র ও মাদক মামলায় সম্রাটের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিলেও তিনি চিকিৎসাধীন থাকায় কারা কর্তৃপক্ষ তাকে আদালতে হাজির করছে না। ফলে এসব মামলার বিচার এখনও শুরু করা যায়নি। তবে শিগগিরই এসব মামলার বিচার শুরু হবে। ক্যাসিনো সংক্রান্ত অন্য মামলাগুলোতে চার্জশিট দেওয়া হলেও বিচারের জন্য তা এখনো এ আদালতে আসেনি। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এসব মামলায় অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।’

গ্রেপ্তার ১২ জনের মামলার বর্তমান অবস্থা:
খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া: ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে প্রথম গ্রেপ্তার হন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। রাজধানীর ইয়ংমেনস ক্লাবের ক্যাসিনোর মালিক ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে একটি, মাদক আইনে দুটি ও মানিলন্ডারিং আইনে একটি মামলা আছে। এর পাশাপাশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। অস্ত্র ও মাদক আইনের মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হলেও মানিলন্ডারিং ও দুদকের মামলা তদন্তাধীন। মাদক মামলায় ইতোমধ্যেই তার বিচার শুরু হয়েছে। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।

জিকে শামীম : খালেদা মাহমুদ ভূঁইয়ার পর গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর গুলশানের নিজ কার্যালয়ে সাত দেহরক্ষীসহ গ্রেপ্তার হন কথিত যুবলীগ নেতা ও প্রভাবশালী ঠিকাদার এসএম গোলাম কিবরিয়া শামীম (জিকে শামীম)। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও মানিলন্ডারিং আইনে তিনটি মামলা করা হয়। মামলাগুলোর মধ্যে অস্ত্র ও মাদক মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই অস্ত্র মামলায় সাত দেহরক্ষীসহ জিকে শামীমের বিচার শুরু হয়েছে। এছাড়া, গত বছরের ২১ অক্টোবর জিকে শামীমের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা করে দুদক। বাকি মামলাগুলো তদন্তাধীন। বর্তমানে জিকে শামীম কারাগারে আছেন। তবে এর মাঝে নিজের পরিচয় লুকিয়ে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেন জিকে শামীম। বিষয়টি নজরে এলে হাইকোর্ট তার জামিন বাতিল করেন।

শফিকুল আলম ওরফে ফিরোজ: ২০ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগের নেতা শফিকুল আলম ওরফে ফিরোজ। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনের মামলা ছাড়াও অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ের দুদকের মামলা আছে। অস্ত্র ও মাদক আইনের মামলায় তার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। মামলা দুটি বিচারের জন্য অপেক্ষমান আছে। দুদকের মামলাটি তদন্তাধীন। তিনি জামিনে আছেন।

লোকমান হোসেন ভূঁইয়া: ক্যাসিনোর সন্ধান পাওয়ার পর ২৫ সেপ্টেম্বর আটক করা হয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেডের ডিরেক্টর ইনচার্জ ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকে। চার বোতল বিদেশি মদ উদ্ধারের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মাদক আইনের মামলা করা হয়। এছাড়া, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। মাদক মামলায় তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। মামলাটি বিচারের জন্য অপেক্ষমান আছে। দুদকের মামলাটি তদন্তাধীন। তিনি জামিনে আছেন।

সেলিম প্রধান: ৩০ সেপ্টেম্বর ব্যাংককগামী একটি ফ্লাইট থেকে গ্রেপ্তার করা হয় অনলাইন ক্যাসিনো জুয়ার আন্তর্জাতিক গডফাদার সেলিম প্রধানকে। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তার গুলশানের কার্যালয় ও বনানীর বাসায় অভিযান চালায় র‌্যাব। অভিযানকালে ৪৮ বোতল বিদেশি মদ, ২৯ লাখ টাকা, ২৩টি দেশের মুদ্রা, ১২টি পাসপোর্ট, দুটি হরিণের চামড়া, তিনটি ব্যাংকের ৩২টি চেক ও অনলাইন গেমিংয়ের সার্ভার জব্দ করা হয়। সেলিম প্রধানে বিরুদ্ধে চারটি মামলা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে ইতোমধ্যেই বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ এর ৩৪ (খ) ধারায় ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেছেন তিনি। মাদক ও অর্থপাচার আইনের মামলা ছাড়াও তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনে অভিযোগে দুদকের মামলা রয়েছে। মাদক মামলায় চার্জশিট দেওয়া হলেও বাকি দুটি মামলা তদন্তাধীন। তিনি কারাগারে আছেন।

সম্রাট-আরমান: ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর আত্মগোপন করেন সম্রাট। ৬ অক্টোবর ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের কুঞ্জশ্রীপুর গ্রাম থেকে সম্রাট ও যুবলীগ নেতা এনামুল হক আরমানকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। সম্রাটের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা আছে। তিনি ইতোমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের দেওয়া সাজা ভোগ করেছেন। অস্ত্র ও মাদক আইনের মামলায় আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। মামলা দুটি বিচারের জন্য অপেক্ষমান আছে। মানিলন্ডারিং আইনের মামলা ও দুদকের করা অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা দুটি তদন্তাধীন। গ্রেপ্তারের সময় আরমান মাদক সেবনরত অবস্থায় থাকায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ তাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। সম্রাটের পাশাপাশি মাদক মামলার আসামি আরমান। তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেছে দুদক। সম্রাট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। আরমান আছেন কারাগারে।

কাউন্সিলর মিজান: গত বছর ১১ অক্টোবর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানকে। ওই সময় তার কাছ থেকে একটি পিস্তল, চার রাউন্ড গুলি, একটি ম্যাগজিন এবং নগদ ২ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় শ্রীমঙ্গলে এবং অর্থ উদ্ধারের ঘটনায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় অর্থ পাচার আইনে দুটি মামলা করা হয়। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুদক আরেকটি মামলা করে। তিনি কারাগারে আছেন।

কাউন্সিলর রাজীব: গত বছরের ১৯ অক্টোবর রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিল মো. তারেকুজ্জামান রাজীবকে গ্রেপ্তার করা হয় । ওই সময় তার কাছ থেকে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করা হয়। অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়। এ দুই মামলায় ইতোমধ্যেই তার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এরপর গত বছরের ৬ নভেম্বর ২৬ কোটি ১৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ১২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় রাজীবের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে আরেকটি মামলা করে সিআইডি। ওই মামলা তদন্তাধীন। রাজীব কারাগারে আছেন।

কাউন্সিলর মনজু: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ময়নুল হক মনজুকে গত বছরের গত ৩১ অক্টোবর দুপুরে রাজধানীর টিকাটুলিতে নিজ কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে নিয়ে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় দুটি মামলা হয়। ওই দুই মামলায় চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। মনজু কারাগারে আছেন।

এনু-রুপন: ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পুরান ঢাকার ওয়ারীতে এনামুল হক এনুর বাসায় তল্লাশি চালিয়ে ২৬ কোটি টাকা, বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা ও সাড়ে ১২ কেজি সোনা জব্দ করে র‌্যাব। এ ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে এনামুল হক এনুর বিরুদ্ধে রাজধানীর ওয়ারী থানায় একটি মামলা করা হয়। এর আগে গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রথমে এনু ও রুপনের বাড়িতে এবং পরে তাদের এক কর্মচারী ও এক বন্ধুর বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে পাঁচটি সিন্দুক থেকে প্রায় ৫ কোটি টাকা, ৮ কেজি সোনা ও ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এরপর সাতটি মামলা করা হয় এনু ও রুপনের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পৃথক দুটি মামলা করে দুদক। এছাড়া, আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিককে মারধরের অভিযোগে আরও একটি মামলা হয় তাদের বিরুদ্ধে। গত ১৩ জানুয়ারি সকালে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে এনু ও রূপন এবং তাদের সহযোগী সানিকে ৪০ লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার করে সিআইডি। মামলাগুলোর মধ্যে মানিলন্ডারিং আইনের চার মামলায় ইতোমধ্যেই আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। চার্জশিটে এনু ও রুপনের আরও তিন ভাইকে আসামি করা হয়েছে। মামলাগুলো বিচারের জন্য অপেক্ষমান আছে। বর্তমানে এনু ও রুপন কারাগারে থাকলেও তার তিন ভাই—শহিদুল হক ভূঁইয়া, রশিদুল হক ভূঁইয়া ও মেরাজুল হক ভূঁইয়া পলাতক আছেন।

ঢাকা/মামুন/রফিক

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়