ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ফেরির সার্চ লাইট কেনায় দুর্নীতি

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০০:১৫, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০   আপডেট: ১০:২৯, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০
ফেরির সার্চ লাইট কেনায় দুর্নীতি

ঘন কুয়াশায় ফেরি চলাচল স্বাভাবিক রাখতে উচ্চ ক্ষমতার ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইট কেনার উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। ২০১৫ সালের জুন মাসে আরিচা ও মাওয়া ঘাটে ১০টি লাইট বসানো হয়।  কাগজপত্রে ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইট বসানোর কথা বলা হলেও বাস্তবে বসানো হয়েছে শুধু সার্চ লাইট। লোপাট করা হয়েছে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানে এই দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে এসেছে। জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ও পিএসআই কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইটের পরিবর্তে শুধু সার্চ লাইটসহ সংশ্লিষ্ট পণ্য কেনা হয়েছে।

২০১৫ সালের ৪ জুন থেকে ১২ জুন পর্যন্ত মোট ১০টি ফেরিতে ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইট বসানো হয়েছে বলে নথিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।  ফেরিগুলো হলো—আরিচায় চলাচলকারী খান জাহান আলী, জাহাঙ্গীর, এনায়েতপুরী, কপোতী ও কুমারী এবং মাওয়ায় চলাচলকারী ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমীন, আমানত শাহ, শাহ আলী, কাকলী ও ক্যামেলিয়া।

কিন্তু ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাস্তবে ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইটের অস্তিত্ব নেই। ওই তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন—বিআডব্লিউটিসির পরিচালক ড. মো. আশরাফুল ইসলাম ও সদস্য (ইঞ্জিনিয়ারিং) মোহাম্মদ মফিজুল হক।

২০১৪ সালে ৭ হাজার ওয়াটের রিমোট কনট্রোল উচ্চ ক্ষমতার (১০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত দেখার) ৬টি ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইট লাইট পরীক্ষামূলকভাবে কেনার সিদ্ধান্ত হয়। এর প্রতিটির দাম ধরা হয়েছিল ৫৫ লাখ ৮৭ হাজার ৪০০ টাকা। যেখানে স্থাপন করা সাধারণ সার্চ লাইটের দাম ১ থেকে ২ লাখ টাকা।

অন্যদিকে, দুদকের অভিযোগ, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ও পিএসআই কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইটের পরিবর্তে শুধু সার্চ লাইটসহ সংশ্লিষ্ট মালামাল কেনার মাধ্যমে ৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকার ক্ষতি করেছেন বিআইডব্লিউটিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

অনুসন্ধানের স্বার্থে এরই মধ্যে গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বিআইডব্লিউটিসির সাবেক চেয়ারম্যান ও পরিচালক (কারিগরি) ড. জ্ঞান রঞ্জন শীল ও সাবেক নৌ অধীক্ষক ক্যাপ্টেন শওকত সরদারসহ ১৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান।

এ বিষয়ে দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত বলেছেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই।  অনুসন্ধান যেহেতু চলছে,  তাই বক্তব্য দেওয়ার সময় এখনো আসেনি।’

এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিসির সচিব মো. আজমল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, সংযোজিত ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইটগুলো ঘন কুয়াশায় কাজ করছে না। গাড়ি বা যানবাহনে ব্যবহৃত  ফগ লাইটের আলো হলুদাভ। কিন্তু এসব লাইটের আলো এলইডি লাইটের মতো ধবধবে সাদা। ঘন কুয়াশায় এসব লাইটের আলো পড়লে প্রতিফলন হওয়ায় আনুমানিক ২০ গজের মধ্যেও কিছু দেখা যায় না। দেখা গেছে, লাইটের গায়ে ও কন্ট্রোল সুইচে  ‘সার্চ লাইট’ লেখা।  এসব ফগ লাইট নয়।  মূলত, এই সার্চ লাইটগুলো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন (বিআইডব্লিউটিসির ভাষ্যমতে, ৭০০০ ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন)।  যদিও বিআইডব্লিটিসির ক্রয় সংক্রান্ত নথিতে সার্চ অ্যান্ড ফগ লাইট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রত্যেক ফেরিতে ৩ হাজার ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন হলুদাভ সার্চ লাইট আছে। সেগুলোর সক্ষমতাও পরীক্ষা করা হয়েছে।  তাতে দেখা গেছে, হালকা কুয়াশায় সেগুলো ভালো কাজ করছে।

এর আগে ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনেও এরকম তথ্য মেলে। ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইটের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য তৎকালীন সহ-ব্যবস্থাপক (মেরিন) হারুনুর রশিদ,  ব্যবস্থাপক (মেরিন) মো. আব্দুস সাত্তার ও মো. আব্দুস সোবহানের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়। তাদের বক্তব্য ছিল—সংযোজিত ফগ ও সার্চ লাইটগুলো হালকা কুয়াশার মধ্যে কাজ করছে। কিন্তু ঘন কুয়াশায় কাজ করছে না।  ফলে ঘন কুয়াশায় ফেরি চলাচল সম্ভব হয় না।

যদিও ২০১৫ সালের ২৩ জুন তৎকালীন জিএম (মেরিন) ক্যাপ্টন শওকত সর্দার, জিএম (হিসাব) মো. নুরুল হুদা, ডিজিএম শেখ মো. নাসিম, এজিএম (ইঞ্জিনিয়ার) মো. এনামুল হক এবং ম্যানেজার (মেরিন) মো. আব্দুস সোবহানের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইট স্থাপনের পক্ষে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন।

দুদক ও বিআইডব্লিইটিসি সূত্র আরো জানা যায়, ফগ লাইট কেনার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান ও প্রকৌশলী ড. জ্ঞান রঞ্জন শীল, জিএম (মেরিন) ক্যাপ্টেন শওকত আলী সরদারসহ সংশ্লিষ্টরা জড়িত ছিলেন।  ক্রয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২০১৭ সালে একটি নির্দেশনা দেয় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। কিন্তু নানা অজুহাতে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি বিআইডব্লিউটিসি।

ঢাকা/এম এ রহমান/রফিক

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়