ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘আবরারের বাঁচার আকুতিতে মন গলেনি ঘাতকদের’

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:২৯, ৬ অক্টোবর ২০২০  
‘আবরারের বাঁচার আকুতিতে মন গলেনি ঘাতকদের’

গত বছরের ৬ অক্টোবর ‘শিবিরের কর্মী’ আখ‌্যায়িত করে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ রাব্বীকে (২২)। আবরারের বাঁচার আকুতিতে মন গলেনি ঘাতকদের। 

আবরার হত্যা মামলাটি তদন্ত করে বুয়েটের ২৫ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন ডিবি পুলিশের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. ওয়াহিদুজ্জামান। চার্জশিটে আবরারকে পিটিয়ে হত‌্যার বর্ণনা দেন তদন্ত কর্মকর্তা।

চার্জশিটে বলা হয়েছে, আবরার এবং আসামিরা বুয়েটের শেরেবাংলা আবাসিক হলে থাকতো। আবরারের রুমমেট মামলার এজাহারবর্হিভূত মিজানুর রহমান হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ও সূচনাকারী। মিজান গত বছরের ২ থেকে ৪ অক্টোবরের মধ্যে যেকোনো সময়ে মেহেদী হাসান রবিনকে বলে, ‘আবরারকে তার শিবির বলে সন্দেহ হয়।’ এর পরিপ্রেক্ষিতে মেহেদী হাসান বিষয়টি তাদের ‘এসবিএইচএসএল, ১৫+১৬’ গ্রুপের সব সদস‌্যসহ অপর আসামিদের ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে জানায়। ৪ অক্টোবর হলের ক্যান্টিনে মেহেদী হাসান ও ইশতিয়াক মুন্নার নেতৃত্বে অমিত সাহা, ইফতি মোশাররফ, আকাশ, তাবাকখারুল, মনিরুজ্জামান, মেফতাহুল ইসলামসহ অন্য আসামিরা বৈঠক করে। ওই বৈঠক চলাকালে আবরার রুমে আছে কি না, তা জানতে একাধিক আসামিকে তার রুমে পাঠানো হয়। আবরার গ্রামের বাড়িতে থাকায় পরদিন মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে হোসেন মোহাম্মদ তোহা, আকাশ, মাজেদুর রহমান, মোর্শেদ অমর্ত‌্য ইসলাম, মোয়াজ গেস্ট রুমে বৈঠক করে আবরারকে পিটিয়ে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় মুজতবা রাফিদ তার সহযোগী ইফতি মোশাররফ সকাল ও মেহেদী হাসান রবিনকে বলে, ‘আবরারকে আজই ধরতে হবে।’ একটু পর তোহা ও সামছুল আরেফিন সকালকে জানায়, আবরার গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরেছে। এ খবর পেয়ে রাত ৮টার পর আসামিরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করে হলের ২০১১ নম্বর রুমে একত্রিত হয়।

মেহেদী হাসান ও ইফতি মোশাররফের নির্দেশে এহতেশামুল রাব্বি, মুনতাসির আল জেমী, নাজমুস সাদাত আবরারের রুমে যায়। তারা গিয়ে দেখে, আবরার ঘুমাচ্ছে। তানিম আবরারকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বলে, ‘বড় ভাইয়েরা তোকে ডাকছে, ২০১১ রুমে যেতে হবে।’ আবরার জানতে চায়, ডাকছে কেন? তখন তানিম বলে, ‘গেলেই দেখতে পাবি।’ এই বলে আসামিরা আবরারকে সঙ্গে নিয়ে তার ব্যবহৃত ল্যাপটপ, দুটি মোবাইল ফোনসহ ২০১১ নম্বর রুমে যায়। তাবাখখারুল ইসলাম, ইফতি মোশাররফ, মুজতবা রাফিদ আবরারের মোবাইল ও ল্যাপটপ চেক করতে থাকে। তারা আবরারের মোবাইল ফোনে শিবিরের তথ্য পেয়েছে বলে অভিযোগ করে। মেহেদী হাসান ক্ষিপ্ত হয়ে আবরারকে চোখ থেকে চশমা সরানোর নির্দেশ দেয়। আবরার চোখ থেকে চশমা সরিয়ে নেওয়া মাত্র মেহেদী হাসান তার মুখে কয়েকটি থাপ্পড় মারে। এরই মধ্যে মোর্শেদ অমর্ত্য কাঠের স্ট্যাম্প নিয়ে আসলে ইফতি মোশাররফ আবরারকে পেটাতে থাকে। এতে স্ট্যাম্পটি ভেঙে যায়। তখন এহতেশামুল রাব্বি আরেকটি স্ট্যাম্প নিয়ে এলে অনিক সরকার স্ট্যাম্পটি নিয়ে আবরারের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ৫০-৬০ টি আঘাত করে। আবরার মেঝেতে পড়ে গেলে মুজাহিদুল ইসলাম, শামীম বিল্লাহ স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে আঘাত করে। আবরার বাঁচার আকুতি জানালেও তাতে আসামিদের মন গলেনি। বরং মেফতাহুল জিয়ন স্ট্যাম্প দিয়ে আবার আবরারকে পেটায় এবং জিজ্ঞেস করে যে, সে শিবির করে কি না।

চার্জশিটে আরও বলা হয়, রাত ১১টার পর এস এম সেতু রুমে ঢুকেই আবরারকে মারার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে। তখন অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ এবং মুজাহিদুল ইসলাম সেতু তাকে বলে, ‘আবরার কোনো তথ্য দিচ্ছে না।’ তখন সেতু তাদের বলে, ‘মারতে থাক।’ এ নির্দেশের ফলে আসামিরা আবার স্ট্যাম্প, স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে মারতে থাকে। অনিক সরকার ও ইফতি মোশাররফ স্ট্যাম্প দিয়ে আঘাত করা ছাড়াও কনুই দিয়ে আবরারের পিঠে আঘাত করে। অপর আসামিরা আবরারকে এলোপাথারি কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড় ও লাথি-গুঁতো মারে। মেহেদী হাসান রবিন ও অনিক সরকার রুম থেকে বের হওয়ার সময় উপস্থিত আসামিদের বলে, ‘তোরা ওর কাছ থেকে তথ্য বের।’ মনিরুজ্জামান মোবাইল চেক করে শিবিরের তথ্য পেয়েছে বলে আবরারকে স্ট্যাম্প দিয়ে আঘাত করা শুরু করে। তাবাখখারুল, নাজমুস সাদাত, এহতেশামুল রাব্বি, জেমি আবরারকে থাপ্পড় মারে। অনিক সরকার পুনরায়  রুমে এসে দ্বিতীয় দফায় স্ট্যাম্প দিয়ে আবরারের পিঠে, নিতম্বে, পায়ে, হাতেসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ৪০-৫০ টি আঘাত করে। একপর্যায়ে আবরার বমি ও প্রস্রাব করে ফেলে এবং ইশারা-ইঙ্গিতে বাঁচার আকুতি প্রকাশ করে। আসামিরা আবরারকে বাথরুমে নিয়ে পরিষ্কার করিয়ে জামা-কাপড় বদলে দেয়। ইফতি মোশাররফ ও মেহেদী হাসানের হুকুমে নাজমুস সাদাত, শামীম বিল্লাহ, সামছুল আরেফিন রাফাত, আকাশ হোসেন, মোয়াজ আবু হোরায়রা, জেমি, এহতেশামুল রাব্বি আবরারের নিথর দেহ ধরাধরি করে ২০০৫ নম্বর রুমে নিয়ে যায়। ইফতি মোশাররফ সে সময় জাহিদ হাসান জনিকে ডেকে ২০১১ নং রুমটি পরিষ্কার করায়।

৬ অক্টোবর দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে মোয়াজ, ইফতি মোশাররফ, মুজাহিদুল ইসলাম, মাজেদুর রহমান, তাবাখখারুল ইসলাম ও তোহা আবরারকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির ল্যান্ডিং স্থানে রাখে। এর মধ্যেই আবরারের মৃত্যু হয়। আবরারের সাড়া-শব্দ না পেয়ে আসামিরা তাকে হাসপাতালে পাঠানোর জন‌্য বুয়েটের চিকিৎসক ও অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আনে। চিকিৎসক এসে আবরারের দেহ পরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ঢাকা/মামুন/রফিক

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়