ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বইমেলায় ব্যর্থ হয়ে বাসায় গিয়ে ব্লগার নিলয়কে খুন করা হয়

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪৩, ১০ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৬:৫১, ১০ অক্টোবর ২০২০
বইমেলায় ব্যর্থ হয়ে বাসায় গিয়ে ব্লগার নিলয়কে খুন করা হয়

ব্লগার নিলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় নীল (ফাইল ফটো)

ব্লগার নিলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় নীলকে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলায় খুন করার পরিকল্পনা করেছিল জঙ্গিরা। এতে তারা ব্যর্থ হয়। পরে সাত মাস ধরে অনুসরণ করার পর বাসায় গিয়ে নিলয়কে হত‌্যা করা হয়।

খাইরুল ইসলাম নামের এক আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বরাত দিয়ে চার্জশিটে এসব তথ্য জানিয়েছেন নিলয় হত‌্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) রমনা জোনাল টিমের পরিদর্শক শাহ মো. আকতারুজ্জামান ইলিয়াস। সম্প্রতি ১৩ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে এ চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।

মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন—বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ মো. জিয়াউল হক জিয়া, মো. মাসুম রানা, সাদ আল নাহিন, মো. কাওসার হোসেন খাঁন, মো. কামাল হোসেন সরদার, মুফতি আব্দুল গফ্ফার, মো. মর্তুজা ফয়সলে সাব্বির, মো. তারেকুল আলম ওরফে তারেক, খায়রুল ইসলাম ওরফে জামিল ওরফে রিফাত ওরফে ফাহিম ওরফে জিসান, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাহাব, মোজাম্মেল হোসেন সায়মন, মো. আরাফাত রহমান ও মো. শেখ আব্দুল্লাহ ওরফে জুবায়ের। তদন্তে নাম পাওয়া শাহরিয়ার, মাহবুব, ওমর ফারুক, মুক্তা, আরমান, কাইয়ুম, সায়মন, মুকুল, সেলিম, আব্দুর সবুর, ফেরদৌস, সালমান, আলী, আদনান, হাসান, তালহা, মাসুদ, ফাহিম আমজাদ, ফারুক, হারুন, জাবেদের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা পাওয়া যায়নি। ঠিকানা পাওয়া গেলে বা গ্রেপ্তার করতে পারলে পরবর্তী সময়ে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়ার কথা জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা।

খাইরুল ইসলামের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি তুলে ধরে চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘তার সাংগঠনিক নাম জামিল ওরফে রিফাত ওরফে ফাহিম ওরফে জিসান। চট্টগ্রামের একটি মসজিদে আমজাদ নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে খাইরুলের পরিচয় হয়। আমজাদ খাইরুলকে উমর ফারুকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। উমর ফারুক তাকে কিছু বই দিয়ে সেসব পড়তে বলে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর/অক্টোবরের দিকে মসজিদে ফারুক মাহবুব নামে আরেক ব্যক্তির সাথে খাইরুলের পরিচয় হয়। মাহবুব তাকে কিছু জিহাদি বই দেয়। সেগুলো পড়ার পর মাহবুব খাইরুলকে বলে, ‘‘আজ আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মিয়ানমার, ফিলিস্তিনে মুসলিমদের ওপর নির্যাতন চলছে। তারা তো আমাদের বোন-ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই। আল্লাহ যদি আমাদের এসব মজলুমের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে, তাহলে আমরা কী জবাব দেব?’’

চার্জশিটে আরও বলা হয়, ‘একদিন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করে মাহবুব খাইরুলকে বলে, ‘‘দেখো, আজ মুসলিমপ্রধান দেশে ইসলাম, আল্লাহ-রাসুল, কিতাব ও ইসলামের মৌলিক জিনিসগুলো নিয়ে কিছু লোক ব্যঙ্গ ও হাসি-তামাশা করে।’’ এরপর মাহবুব ইসলাম নিয়ে ব্লগার রাজীব হায়দারের উক্তির ওপর একটা লিফলেট দেয় খাইরুল। তারপর বলে, ‘‘এসব নাস্তিকের বিরুদ্ধে জিহাদ কি ফরজ নয়?’’ এরপর সে খাইরুলকে একটি পিটি আইডি খুলে দিয়ে সেটার মাধ্যমে যোগাযোগ করতে বলে। তখন থেকে আইডির মাধ্যমে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ হতো। এরপর মাহবুব খাইরুলকে জানায়, তার নাম জিহাদের খাতায় দেওয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসের দিকে একটি বাসায় জিয়ার সঙ্গে খাইরুলের সাক্ষাৎ হয়। তার সাথে মেজর জিয়া যোগাযোগ রাখে পিটি আইডির মাধ্যমে। মেজর জিয়া তাকে তিন দিনের জন্য ঢাকায় যেতে বললে রাজি হয় খাইরুল। ঢাকায় আসার পর সালমান শেওড়াপাড়া থেকে তাকে একটি বাসায় নিয়ে যায়। ওই বাসায় হারুন, হাসান, জাবেদ ও সালমান ছিল। কীভাবে নেট ব্রাউজ করতে হবে, নিরাপত্তাসহ মেইল পাঠাবে হবে এবং কীভাবে নিজেকে নিরাপদ রাখতে হবে, এ নিয়ে তিন দিনের একটি দাওয়া ক্লাশ হয়। দাওয়া শেষে প্রত্যেকে আলাদা হয়ে চলে যায়। এরপর থেকে পিটি আইডির মাধ্যমে খাইরুলের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল। ২০১৫ সালের জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারিতে তাকে আবার ঢাকায় যাওয়ার জন্য বলা হয়। খাইরুল প্রথমে রাজি না হলে হুমকি দেওয়া হয়।’

‘ঢাকার কাটাবন আসে খাইরুল। সেখান থেকে হাসান ও সাকিব তাকে এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাসায় নিয়ে যায়। বাসায় সালমান, শাহরিয়ার, সাকিব, হাসান ও তালহা ছিল। ওই বাসায় তাদের কম্পিউটার ব‌্যবহার শেখানো হয়। তাছাড়া নিরাপত্তা এবং জিহাদ সংক্রান্ত বই নিয়ে আলোচনা হতো। ৫/৬ দিন পর খাইরুল চট্টগ্রামে চলে যায়। যাওয়ার সময় শাহরিয়ার তাকে একটি মেইল আইডি দিয়ে বার বার চেক করতে বলে। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের জাবেদের সাথে তার দেখা হলে সে জানায়, ওই মারকাজ থেকে অভিজিৎ রায়ের কাজটির জন্য ইন্টেলিজেন্স বিভাগের ভাইরা কাজ করছিল। এরপর খাইরুল তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালের মার্চে তাকে আবার ঢাকায় যাওয়ার জন‌্য বলা হয়। মার্র্চের শেষের দিকে সে দক্ষিণখান এলাকায় যায়। ওইখানে ৭/৮ দিন থাকার পর ঢাকার সেন্টার পয়েন্টে বাসা ভাড়া নেওয়ার জন্য সালমান শাহরিয়ার ও সাকিব বাসা খুঁজতে ব্যস্ত থাকে। বাসা রেডি না থাকায় খাইরুল চট্টগ্রামে চলে যায়। এপ্রিলের দিকে খাইরুল ঢাকার শেখেরটেক মোহাম্মদপুর নতুন মারকাজে দুই মাসের মতো ছিল। শেখেরটেক মোহাম্মদপুর মারকাজের আগে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে এ্যালিফ্যান্ট রোডে ইন্টেলিজেন্স শাখার মারকাজ থেকে ব্লগার নিলাদ্রী নিলয়কে ফলো করার নির্দেশনা দেয় জিয়া। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী ইন্টেলিজেন্স শাখার সদস্য হাসান ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা থেকে নিলয়কে অনুসরণ করতে থাকে। কিন্তু মহাখালী পর্যন্ত যাওয়ার পর তাকে হারিয়ে ফেলে। পরবর্তীতে শেখেরটেক মারকাজে থাকা অবস্থায় খাইরুল, হাসান, শাহরিয়ার সালমান নিলয়ের বাসার খোঁজ নিতে থাকে। যেহেতু নিলয়কে হাসান মহাখালী মোড় থেকে হারিয়ে ফেলে সেহেতু খাইরুল ও হাসানকে মহাখালী মোড়ে পাঠানো হয়। খাইরুল ও হাসান ৫/৬ দিন মহাখালী যায়, কিন্তু নিলয়কে খুঁজে পায়নি। কারণ, তার কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা তাদের কাছে ছিল না।’

তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিটে বলেছেন, ‘পরে সালমান একটি মেয়ের আইডি খুলে নিলয়ের ফেসবুক ফ্রেন্ড হয়। এই ফেসবুক আইডির মাধ্যমে সালমান নিলয়ের বাসার ঠিকানা সংগ্রহ করে। সে অনুযায়ী খাইরুল ও হাসান গোড়ান টেম্পু স্ট্যান্ডে যায়। নিলয় সেখানে এলে হাসান তাকে দেখে বলে, এটাই নিলয়। সেদিন নিলয়কে ফলো করে পরীবাগ পর্যন্ত যাওয়ার পর তাকে হারিয়ে ফেলে। এরপর খাইরুল, শাহরিয়ার সালমান ও সাকিব খোঁজ নিয়ে নিলয়ের বাসা ও  অফিসের ঠিকানা জেনে জিয়াকে জানায়। নিলয়ের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড ও যাতায়াতের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। যাবতীয় তথ্য সংগঠনের আসকারি শাখার দায়িত্বশীলদের কাছে জমা দেয় শাহরিয়ার। এরপর একদিন শাহরিয়ার ব্লগার ও লেখক ফয়সাল আরেফিন দীপন সম্পর্কে বলে, ‘‘সে অভিজিতের বই প্রকাশ করে অন্যায় করেছে। এর শাস্তি সে পাবে।’’ জিয়ার নির্দেশে খাইরুল ও হাসান একদিন আজিজ সুপার মার্কেটে যায় দীপনকে খুঁজতে। কিন্তু ওই দিন তাকে পায়নি। এরপর একদিন শাহরিয়ার ও তালহা দীপনের দোকান থেকে অভিজিতের বই কিনে আনে। তারপর খাইরুল, সাকিব ও হাসান দীপনের গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। শাহরিয়ার সমস্ত তথ্য সংগঠনের দায়িত্বশীলদের দেয়, যারা আসকারি শাখায় কাজ করে। খাইরুল সংগঠনের ইন্টেলিজেন্স শাখার সদস্য ছিল। তাদের কাজ ছিল টার্গেটের ডিটেইল তথ্য সংগ্রহ করে আসকারি শাখায় জমা দেয়া। তাদের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সংগঠনের অপারেশন শাখা অভিযান পরিচালনা করে। ইন্টেলিজেন্স শাখার রিপোর্টের ভিত্তিতে ২০১৫ সালের ৭ আগস্ট সংগঠনের অপারেশন শাখার সদস্যরা ব্লগার নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয়কে তার বাসায় গিয়ে খুন করে।’

তদন্ত কর্মকর্তা জানান, আসামিরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামক জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। তাদের দলনেতা বহিষ্কৃত মেজর জিয়া। তাদের কাজ হচ্ছে বিভিন্ন ব্লগার ও ইসলামবিরোধীদের হত্যা করা। জিয়ার নির্দেশেই তারা এসব করে থাকে।

ব্লগার নিলয়ের স্ত্রী আশামনি বলেছেন, ‘নিলয়কে খুনের পাঁচ বছর পর মামলাটির তদন্ত শেষ হয়েছে। আমরা বিচার চাই, কিন্তু বিচার তো পাচ্ছি না। যে চলে গেছে তাকে তো আর ফিরে পাবো না। তবে অপরাধীদের যেন দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয়। সরকার যেন মামলাটির বিচার দ্রুত শেষ করে।’

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর আজাদ রহমান বলেছেন, ‘মামলাটির তদন্ত শেষে ১৩ জনের বিরুদ্ধে ঢাকা সিএমএম আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এক আসামি পলাতক থাকায় তাকে গ্রেপ্তার করতে পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। আরও কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে মামলাটি মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হবে। সেখানে চার্জ গঠন করে বিচার শুরু করা হবে।’

ঢাকা/মামুন/রফিক

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়