ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

অনলাইন কেনাকাটায় হয়রানি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৯:২৩, ২৯ নভেম্বর ২০২০
অনলাইন কেনাকাটায় হয়রানি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা

চাকরি, ব্যবসা কিংবা ঘর-সংসার সামলে সশরীরে বাজার-শপিংমলে গিয়ে প্রয়োজনীয় পণ‌্য কেনার সময় হয় না অনেকেরই। এছাড়া, করোনা-সংক্রমণ এড়ানোর জন‌্যও কেউ কেউ অনলাইনের ওপর ভরসা করছেন। এই মাধ‌্যমে কেনাকাটার তালিকায় যেমন রয়েছে চাল, ডাল, তেল, নুন; তেমনি রয়েছে বই, জামা-কাপড়, আসবাব, জুতো-স‌্যান্ডেল, গহনা, মাছ, ফল, মিষ্টি, তৈরি খাবারও। কিন্তু অনলাইনে এসব পণ‌্য কিনতে প্রতারণা শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন ক্রেতারা। 

একাধিক অনলাইন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্রেতাদের অভিযোগ—যথাসময়ে পণ্য পৌঁছানো হয় না। থাকে না গুণগতমান। ন‌্যায‌্যমূল‌্যের চেয়ে বেশি নেওয়া ছাড়াও এক পণ‌্য দেখিয়ে অরেকটা দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। নষ্ট-ছেঁড়া-পচা পণ্য গছিয়ে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। আকার ও পরিমাণ ঠিকমতো না থাকার পাশাপাশি ভেজাল পণ্য সরবরাহেরও অভিযোগ রয়েছে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

অনলাইনে কেনাকাটা করে প্রতারণার শিকার হয়েছেন চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউটের শিক্ষক মাইনুল এইচ সিরাজী। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘না দেখে পণ্য কেনা মানে ঠকার আশঙ্কা। অনলাইনে আম কিনে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। চার বারই ঠকেছি। সমস্যা হচ্ছে, ফেসবুক ব্যবহার করে যে কেউ অনলাইন বিক্রেতা হয়ে যেতে পারেন। এই ক্ষেত্রে তদারকি ও নজরদারি দরকার বলে মনে করি।’

প্রায় একই অভিযোগ রাজধানীর গৃহিনী মাফরুহা অদ্বিতীরও। তিনি বলেন, ‘করোনার প্রথম দিকে পাঁচ মাস চাল-ডালসহ সব বাজার করেছি অনলাইনে। নাম করা অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা ভালো পণ্যের সঙ্গে মিলিয়ে খারাপ পণ্যও দেয়। বিছানার চাদর কিনেছিলাম, কাপড়ের মান ভালো হয়নি। খুব কম প্রতিষ্ঠানেরই কথায়-কাজে মিল থাকে।’

ক্ষোভের সঙ্গে অভিজ্ঞতার কথা জানালেন এনজিও কর্মকর্তা ফারহানা রুমা। তিনি বলেন, ‘এখন তো অনলাইনে কেনাকাটায় সুবিধা। যদিও ক্রেতাদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি সব অনলাইন শপ। ক্যাশ অন ডেলিভারি সিস্টেম ও কুরিয়ারের লোকের সামনে প্যাকেট খুলে পণ্য বুঝে নিতে হয়। পরে রিপোর্ট করলে একথা-সেকথা বলে ঘোরায়।’ 

অনলাইনে কেনাকাটা করে প্রতারণার শিকার হয়েছেন আইনজীবী কল‌্যাণী গুহ দত্ত। তিনি বলেন, ‘আইনজীবী হয়েও কয়েকবার ধরা খেয়েছি। ব্লাউজের কাপড় কিনে এক সপ্তাহও পরতে পারিনি, ছিঁড়ে গেছে। কিছু পেজে নক করলে কোনো রেসপন্সতো করেই না, উল্টো বাজে ব্যবহার করে।’  তিনি আরও বলেন, ‘আবার কিছু অনলাইন পেজ থেকে কিনে সন্তুষ্টও হয়েছি। যেমন বলেছে, ঠিক তেমন পণ্যই দিয়েছে তারা।’ 

ক্রেতাদের বিভিন্ন অভিযোগের জবাবে ‘ইভ্যালি.কম লিমিটেড’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মো. রাসেল বলেন, ‘যেকোনো ই-কমার্স লেনদেনে বিশ্বব্যাপী ৫ শতাংশ পর্যন্ত কমপ্লেইন গ্রহণযোগ্য। আলীবাবার মতো প্রতিষ্ঠানেও কমপ্লেইন আছে। এটা কখনো শূন‌্য শতাংশ হবে না। তবে, বাংলাদেশে যেসব কোম্পানি এই ব্যবসায় অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছে, তারা ক্রেতাদের অভিযোগের প্রতি যথেষ্ঠ গুরুত্ব দেয়। যেটা ফেসবুক পেজের নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানগুলো দেয় না।’ 

ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী জোর দিয়ে বলেন, ‘আমাদের পণ্যের মান নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। তবে, নানা কারণে ডেলিভারি কখনো কখনো সঠিক সময়ে দিতে পারি না, এটা ঠিক। কোনো কারণে ডিলিভারি দেওয়ার সময় বা পরে, কোনো পণ্য নিয়ে ক্রেতা কমপ্লেইন করলে পণ্য বদলে দেই। ক্রেতা চাইলে পুরো মূল্যও ফেরত দেই।’

অভিযোগের জবাবে ‘ঘরের বাজার.কম’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নজরুল সেলিম বলেন, ‘ঢাকার ট্রাফিক সিস্টেমের কারণে সরবরাহে দেরি হয়। এটা হতে পারে। আমরা সবসময় পণ্যের গুণগতমান ঠিক রাখার চেষ্টা করি। আমাদের সব ভোগ্যপণ্য। এগুলোর গায়ে দাম লেখা থাকে, তাই দাম বেশি নেওয়ার সুযোগই নেই। বরং ক্রেতাদের জন্য আমরা মাঝে-মাঝে ডিসকাউন্ট অফার দেই।’

একই অভিযোগের বিষয় স্বীকার করেছেন ‘চালডাল’-এর চিফ অপারেটিং অফিসার জিয়া আশরাফ। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার অর্ডার সরবরাহ করে থাকি। হঠাৎ কোনো কারণে অর্ডারের সংখ্যা বেড়ে গেলে বা ডেলিভারিম্যানের গাফিলতিতেও ডেলিভারিতে দেরি হতে পারে। প্যাকেটজাত সব পণ্য আমরা সরাসরি কোম্পানি থেকে সংগ্রহ করি। তাই এর মান নিয়ে সাধারণত কোনো কমপ্লেইন পাই না।’ 

পণ‌্যের গুণগত মান ঠিক না থাকার অভিযোগ স্বীকার করে জিয়া আশরাফ বলেন, ‘ফ্রোজেন আইটেম ডেলিভারি দিতে দেরি হলে কখনো কখনো গুণগতমানের তারতম্য ঘটতে পারে। শাক-সবজি লোকাল বাজার থেকে সংগ্রহ করা হয়। সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে গ্রাহকের হাতে পৌঁছানোর লম্বা সময়ে কোয়ালিটি একটু খারাপ হতে পারে। আমরা সবসময় মার্কেট প্রাইস রাখার চেষ্টা করি। বেশি দাম রাখার সুযোগ নেই। বরং মাঝে মাঝে গ্রাহকদের স্পেশাল ডিসকাউন্ট দেই আমরা।’  

ঠিক সময়ে বই সরবরাহ না করা, কখনো বা একেবারেই সরবরাহ না করার অভিযোগ স্বীকার করেছেন রকমারি.কমের জনসংযোগ কর্মকতা কিংকর হালদার মিশু। তিনি বলেন, ‘বই ডেলিভারি করতে আমাদের ঢাকার মধ্যে ৩ থেকে ৫ দিন এবং ঢাকার বাইরে ৫ থেকে ৭ দিন সময় লাগে। কারণ পাঠকের অর্ডার পাওয়ার পর বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে সংগ্রহ করতে হয়। তাই দেরি হয়। পোস্ট অফিসের মাধ্যমে কাউকে বই পাঠালে আরও বেশি সময় লাগে। তবে, এই দেরি হওয়ার অভিযোগ আমাদের মোট অর্ডারের দশমিক শূন‌্য তিন শতাংশ। তারপরও বেশি দেরি হলে কিংবা বই দিতে না পারলে এসএমএস করে জানিয়ে দেই।’

ফেসবুক পেজ খুলে যারা বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছেন, তাদের একজন ফারহানা জেবীন। তার পেজের নাম ‘মুদিতা’। ক্রেতাদের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যেসব প্রতিষ্ঠান অন্যদের কাছ থেকে পণ্য কিনে বিক্রি করে, তারাই সময়মতো ডেলিভারি করতে পারে না। অভিযোগ পেলে পণ্য আমরা বদলে দেই। এমনকী চাইলে টাকাও ফেরত দেই। বড় উদ্যোক্তা বা বেশি পুঁজি না থাকায় অল্প করে পণ্য তৈরি করতে হয়। ফলে খরচও বেশি পড়ে। তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হয়।’

দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পণ্য সংগ্রহ করে বাজারজাত করেন ত্রিদিব বর্মণ। তার পেজের নাম ‘দেশীঘর’। তিনি বলেন, ‘ছোট উদ্যোক্তাদের নিজস্ব ডেলিভারি ব‌্যবস্থা না থাকায় সময়মতো ডেলিভারি দিতে পারে না। ছোট উদ্যোক্তাদের পুঁজি কমের কারণে অল্প পণ্য সংগ্রহ করতে হয়। ফলে দাম বেশি পড়ে। তবে, আমাদের পণ্যের মানের ক্ষেত্রে কোনো আপস করি না।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (তদন্ত) শাহনাজ সুলতানা বলেন, ‘এ রকম অভিযোগ পেলে সেগুলো অভিযোগ আমলে নেই। প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দেই। নির্দিষ্ট দিনে দুই পক্ষকে হাজির থাকতে বলি। এরপর তাদের উপস্থিতিতে শুনানি হয়। ’ শুনানিতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দোষী প্রমাণিত হলে তার জরিমানা করা হয় বলেও তিনি জানান।

এনই/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়