৫ বছরেও শেষ হয়নি হলমার্ক নন-ফান্ডেড কেলেঙ্কারির অনুসন্ধান
এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম
দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে চলছে আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারি নন-ফান্ডেড ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা লোপাটের অনুসন্ধান। এরই মধ্যে নন-ফান্ডেড অংশের দুটি মামলা হলেও অনুসন্ধানের তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র বলছে, ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে ৩৭টি দেশি-বিদেশি ব্যাংকের শতাধিক শাখার কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য রয়েছে। যদিও ২০১৪ সালের ৭ এপ্রিল অজ্ঞাত কারণে হলমার্ক কেলেঙ্কারির নন-ফান্ডেড অংশের দুর্নীতি অনুসন্ধান না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুদক।
তবে, বিভিন্ন বিতর্কের পর সোনালী ব্যাংকের তদন্ত রিপোর্টের সূত্র ধরে ২০১৫ সালের ১৩ আগস্ট অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এরপরই পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে ৮ সদস্যের টিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এর মাঝে বেশ কয়েকবার টিম গঠন ও পুর্নগঠন করা হয়েছে। সর্বশেষ পুর্নগঠিত টিমের সদস্যরা হলেন—উপপরিচালক এস এম আক্তার হামিদ ভূঁইয়া, মশিউর রহমান ও সেলিনা আক্তার মনি, সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন ও সিলভিয়া ফেরদৌস এবং উপসহকারী পরিচালক সহিদুর রহমান ও আফনান জান্নাত কেয়া।
এ বিষয়ে দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘হলমার্কের নন-ফান্ডেড অংশ অনুসন্ধানের জন্য কমিশনের পরিচালক মীর মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে একটি কমিটি পুর্নগঠন করা হয়েছে। যদিও এটিকে নন-ফান্ডেড বলা হয়েছিল, কিন্তু এর পুরোটাই ফান্ডেড। ইতোপূর্বে দুদক এই অংশের ওপরে মামলাও দায়ের করেছিল। নতুন টিম অনুসন্ধান শেষ করে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেবে।’
প্রসঙ্গত, সোনালী ব্যাংকের শেরাটন শাখা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে হলমার্ক গ্রুপ ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মে পর্যন্ত জালিয়াতির মাধ্যমে ২ হাজার ৯৬৪ কোটি ৮১ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। এঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর অনুসন্ধানে নামে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি। অনুসন্ধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৪ সালে ফান্ডেড মোট ১ হাজার ৯৫৪ কোটি ৮৩ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৩ টাকা আত্মসাতের দায়ে ৩৮ মামলার চার্জশিট দেয় দুদক। তবে নন-ফান্ডেড প্রায় ১ হাজার ৭১০ কোটি টাকার দুর্নীতি অনুসন্ধান এখন পর্যন্ত শেষ করতে পারিনি সংস্থাটি।
দীর্ঘ ছয় বছর বিরতির পর হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় নন-ফান্ডেড অংশের মানিলন্ডারিং আইনে প্রথম মামলা দায়ের করে ২০১৮ সালের ১১ ডিসেম্বর। মামলায় ঢাকা ব্যাংকের ১৪টি হিসাব ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ১টি হিসাবে সন্দেহজনকভাবে ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা হস্তান্তর ও স্থানান্তর করার দায়ে হলমার্কের গ্রুপের এমডি তানভীরের ভায়রাভাই ও গ্রুপের প্রাক্তন জেনারেল ম্যানেজার (কমার্শিয়াল) তুষার আহমেদ, এক সময়ের জিএম মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিন ও তুষার আহমেদের আত্মীয় সুমন ভূইয়া। দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদিন বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
এরপর সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক জালিয়াতির ঘটনায় নন-ফান্ডেড দ্বিতীয় মামলা করে ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি। মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ১ কোটি ৯ লাখ ৬৬ হাজার ৭৬১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। হাজারীবাগ থানায় মামলাটি করেন দুদকের উপরিচালক সেলিনা আকতার মনি। মামলায় আসামি করা হয়েছে সোনালী ব্যাংকের বরখাস্ত হওয়া এজিএম সাইফুল হাসান, ভেনারেবল এক্সপোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দীন সেলিম, এমডি সঞ্জীবন রায়, ড্রেস মি ফ্যাশনের চেয়ারম্যান জিনাত ফাতেমা, এমডি তাওহীদ হোসেন ও পরিচালক তসলিম হাসানকে।
এদিকে সোনালী ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, সোনালী ব্যাংকের নিকট (নন-ফান্ডেড) অন্তত ৩৫টি বেসরকারি ব্যাংকের পাওনা প্রায় ১ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। ঘটনার পর বাংলাদেশ ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ৮৯২ কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ অন্যান্য ব্যাংকের এলসি বিল বাবদ পরিশোধ করে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত সোনালী ব্যাংকের হিসাব থেকেই এ টাকা পরিশোধ করা হয়।
দুদকের কার্যক্রম ও সোনালী ব্যাংকের বিভিন্ন উদ্যোগে এখন পর্যন্ত হলমার্ক গ্রুপের কাছ থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ৫৬৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর ফান্ডেড (সোনালী ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ) ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৭ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২৭ জনকে আসামি করে ১১ মামলা এবং ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ফান্ডেড প্রায় ৩৭২ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আরও ২৭ মামলা দায়ের করে দুদক। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালের বিভিন্ন সময়ে ফান্ডেড মোট ১ হাজার ৯৫৪ কোটি ৮৩ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৩৮ মামলার চার্জশিট দেয় সংস্থাটি। যেখানে মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব মামলায় হলমার্ক গ্রুপের এমডি মো. তানভীর মাহমুদ, তার স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, তানভীরের ভায়রাভাই ও গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ এবং হলমার্ক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন শীর্ষ কর্তাদের আসামি করা হয়।
দুদকের দায়ের করা মামলার মধ্যে মাত্র একটি মামলার রায় হয়েছে। ওই মামলায় ২০১৬ সালের ২৪ মে সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাসহ তিন জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার পাঁচ নম্বর বিশেষ জজ আদালত এ রায় দেন। সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন হলমার্ক গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান প্যারাগন নিট কম্পোজিটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম রাজা, পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন ও সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন শাখার কর্মকর্তা সাইফুল হাসান। আসামিদের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখায় দুই কোটি ২২ লাখ ৭৮ হাজার ৬১০ টাকা ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। দুদকের সহকারী পরিচালক নাজমুচ্ছাদাত ২০১৩ সালের ২৮ মে ঢাকার রমনা থানায় এই মামলা করেন।
হলমার্ক গ্রুপের মোট কারখানার সংখ্যা প্রায় ৪৩। এর মধ্যে ২১টিকে ঘিরেই সোনালী ব্যাংকের সব পাওনা রয়েছে। এগুলো হলো হলমার্ক ফ্যাশন, হলমার্ক ডিজাইন ওয়্যার, ওয়াল মাট ফ্যাশন, ইসলাম ফ্যাশন, ডন অ্যাপারেল, ফারহান ফ্যাশন, মাহমুদ অ্যাপারেল, হলমার্ক স্পিনিং, ববি ফ্যাশন, হলমার্ক ডেনিম কম্পোজিট, ববি ফ্লাট বেড প্রিন্টিং, হলমার্ক এক্সেসরিজ, হলমার্ক নিট কম্পোজিট, ববি ডেনিম কম্পোজিট, হলমার্ক স্টাইল, পারফেক্ট এমব্রয়ডারি, হলমার্ক প্যাকেজিং, জিসান নিট কম্পোজিট, হলমার্ক নিটিং অ্যান্ড ডায়িং, আনোয়ার স্পিনিং ও ম্যাক্স স্পিনিং। শেষের দুটি কারখানা মূলত হলমার্কের সৃষ্টি করা বেনামি প্রতিষ্ঠান। এ দুটি কারখানার কাছ থেকে অর্থ আদায়ের জন্য দেওয়ানি আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ঢাকা/এম এ রহমান/এনই
আরো পড়ুন