ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে কী বলছেন তারা? 

মেসবাহ যাযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৬, ২ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৯:০৭, ২ ডিসেম্বর ২০২০
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে কী বলছেন তারা? 

কুষ্টিয়া ডিসি অফিসের সামনে শিল্পী রিঙকু অনিমিখ ও সঞ্জয় পালের তৈরি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য (ফাইল ছবি)

ঢাকার ধোলাইপাড় চত্বরে  জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য তৈরির পরিকল্পনা করেছে সরকার। এই ভাস্কর্য তৈরি থেকে সরকারকে সরিয়ে আনার লক্ষ‌্যে চলতি বছরের অক্টোবর মাসের শুরু থেকেই ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দল বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে আসছে। আর বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচনায় আসে গত ১৩ নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত খেলাফত মজলিশের সম্মেলনে দলের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যের পর।

সম্মেলনে খেলাফতের আমির অধ‌্যক্ষ মুহাম্মদ ইসহাক ও মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের বলেন, ‘ভাস্কর্য নির্মাণ পরিকল্পনা থেকে সরকার সরে না দাঁড়ালে আরেকটি শাপলা চত্বরের ঘটনা ঘটবে। ওই ভাস্কর্য ছুড়ে ফেলবো।’ 

এরপর গত শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে একই কথার প্রতিধ্বনি করেন হেফাজত ইসলামীর আমির জুনায়েদ বাবুনগরী। তিনি বলেন, ‘কোনো ভাস্কর্য তৈরি হলে তা টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে ফেলা হবে।’

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধী এসব বক্তব‌্যের পর দেশব‌্যাপী প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, আলেম সমাজ ও শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী মহলে নিন্দার ঝড় ওঠে। তারা বলেন, ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে ধর্মীয় সম্পর্ক নেই। এর পেছনে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিদ্বেষ। যারা দেশের স্বাধীনতার প্রতি আস্থা রাখে না, তারাই এই ধরনের আন্দোলনে নেমেছেন। 

ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব‌্যের প্রতিক্রিয়ায় প্রবীণ সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, ‘যারা এই দেশকে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করছেন, তারা ডিসেম্বরকে বেছে নিয়েছেন। এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মাস। তারা যেকোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধসহ আমাদের সব অর্জনকে বিতর্কিত করতে চায়। কাজেই বাবুনগরীকে কোনো গুরুত্ব দেওয়া যাবে না। তাদের বিরুদ্ধে পরিষ্কারভাবে রাষ্ট্রীয়, ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংসের অপচেষ্টা করার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা হওয়া উচিত।’

ঢাকা বিশ্ববিদ‌্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন বলেন, ‘তারা তো আসলে ভাস্কর্যবিরোধী নন। তারা বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের স্বাধীনতাবিরোধী। আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি চলছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী চলছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এই এগিয়ে যাওয়াই তাদের গাত্রদাহের কারণ। এজন‌্য তারা সরকারকে বিব্রত করতে চায়। তাই এইরকম ইস্যু নিয়ে সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি দিচ্ছে।’

এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘আরেকটা ব্যাপার আছে। সেটা হলো—আল্লামা শফী মারা যাওয়ার পর হেফাজতের বিশাল সম্পত্তি নিয়েও তাদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ চলছে। সেটা থেকে সবার নজর অন্যদিকে ফিরিয়ে নেওয়ারও পাঁয়তারা এই ভাস্কর্যবিরোধী প্রচারণা।’

জানতে চাইলে নাট‌্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব‌্য দিয়ে তারা সরকারকে বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো। আমরাও বিভিন্নভাবে তার প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাতাদের একজন শিল্পী রিঙকু অনিমিখ। ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আন্দোলনকালীরা কেবল ধর্মীয়ভাবে  ব্যাখ‌্যা দিচ্ছেন।  আমাদের বেশিরভাগ মানুষ ধর্মভীরু। তাই তাদের কথায় সাধারণ মানুষ গুরুত্ব দেয়। তাৎক্ষণিকভাবে সেটা মেনেও নেয়। এর আগেও তারা ভাস্কর্য নিয়ে কথা বলেছেন। তবে, এবারই সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে বলাটা সন্দেহ সৃষ্টি করছে।’

চারুকলার শিক্ষক হামিদুজ্জামান খান বলেন, ‘আমরা মানুষকে শ্রদ্ধা করলে ভাস্কর্যকেও শ্রদ্ধা করবো। বিষয়টিকে শিল্প হিসেবে দেখলে আর কোনো বিরোধ থাকে না। ভাস্কর্য একটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শিল্প। দুনিয়াজুড়ে পেইন্টিং আর ভাস্কর্য আছে। থাকবে। সুতরাং এই শিল্পকে অশ্রদ্ধা করার কিছু নেই।’
 
মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব‌্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ‘ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব‌্যের অন্যতম কারণ অশিক্ষা। তারা কোনো কিছু মানে না। আবার নিজের ছবি পাসপোর্টে ব্যবহার করে। টেলিভিশনের পর্দায় নিজের চেহারা দেখায়। পত্রিকায় ছবি ছাপায়। তাদের কথা অনুযায়ী ছবিটাও তো বিদয়াত। ছবিও তো একটা আকৃতি-প্রতিকৃতি। তাহলে সেটাও তো নিষিদ্ধ হতে হবে। কুশিক্ষিত, ধর্মান্ধ, মৌলবাদ মানবতার শত্রু। এই ধরনের মৌলবাদকে এখনই সমূলে উৎপাটিত করতে হবে।’

ভাস্কর্যবিরোধী চলমান আন্দোলন প্রসঙ্গে ইসলামি ঐক্যজটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘এই ব্যাপারে দুটি কথা বলতে চাই। প্রথমত, সারা দুনিয়া যখন করোনা মোকাবিলায় ব্যস্ত, তখন এই যে ভাস্কর্য নিয়ে হল্লা আর চিৎকার করা, তার মানে হলো দেশের স্থিতিশীলতা নষ্টের জন্য পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র করা। দ্বিতীয়ত, উমাইয়া ও আব্বাসীয়সহ সব মুসলিম শাসক আমলে আরববিশ্বে ভাস্কর্য ছিল। আর ভারত উপমহাদেশে মুঘল আমলে অনেক ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে। এই ব্যাপারে কখনো কোনো প্রতিবাদ হয়নি। বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়নি। আমাদের দেশেও ব্রিটিশ আমল থেকে অনেক ভাস্কর্য রয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও অনেক ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে।’
 
ইসলামি ঐক্যজটের চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘আমি এটুকু জানি, সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ভাস্কর্য আছে। ওআইসিতে একটা কমিটি আছে, যারা বিভিন্ন বিষয়ে ফতোয়া নিয়ে আলোচনা করে। আজ পর্যন্ত ওআইসির কোনো মিটিংয়ে আলোচনায় আসেনি যে ভাস্কর্য অবৈধ।’ হঠাৎ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনের পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে বলেও তিনি মনে করেন।

মেসবাহ/এনই

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়