ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

যেসব কারণে রোহিঙ্গারা ভাসানচরে 

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৩৫, ৯ ডিসেম্বর ২০২০  
যেসব কারণে রোহিঙ্গারা ভাসানচরে 

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে শরণার্থী হিসেবে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে আসছে সরকার। কিন্তু রোহিঙ্গাদের কিছু কার্যক্রমের কারণে কক্সবাজারে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। উজাড় হয়ে গেছে বিপুল পরিমাণ বনাঞ্চলও। পাশাপাশি মিয়ানমারের অসহযোগিতার কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন-প্রক্রিয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এসব কারণে দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের লক্ষ‌্যে তাদের ভাসানচরে নেওয়া হচ্ছে। 

রোহিঙ্গাদের প্রথম দল শুক্রবার (৪ ডিসেম্বর) ১ হাজার ৬৪২ রোহিঙ্গা ভাসানচর গেছেন। এর মধ্যে ৩৬৮ জন পুরুষ, ৪৬৪ জন নারী ও ৮১০ জন শিশু। 

ভাসানচরে নেওয়ার আগে রোহিঙ্গাদের কমিউনিটি নেতারা  আশ্রয়ণপ্রকল্প পরিদর্শন করেন। এনজিও ও গণমাধ্যম-কর্মীরাও ভাসানচর পরিদর্শন করেছেন। ওই জায়গা এখন পুরোপুরি সুরক্ষিত। রোহিঙ্গাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ভাসানচরে বাসস্থান, খাদ্য, চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।  

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্টরা বলছেন,  রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। তবে, তাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়াই এই সংকটের একমাত্র টেকসই সমাধান।

নিরাপত্তাবিশ্লেষক ও কূটনীতিকরা বলছেন, মিয়ানমারের অতীত কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে তাদের কোনো সদিচ্ছা নেই। নানা টালবাহানা করে তারা মূল ইস্যু থেকে সরে গেছে। এখনো যাচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। এই চাপ আরও বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে জাতিসংঘ ও শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। মিয়ানমার আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ও উপেক্ষা করছে। এ অবস্থায় দেশটির ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই। 

কূটনীতিকরা বলছেন, একদিকে রোহিঙ্গাদের স্বচ্ছন্দ জীবন নিশ্চিত করা, অন্যদিকে তাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে। 

এদিকে, রোহিঙ্গা বসতি জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীলা। জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিল (ইউএনডিপি) রোহিঙ্গা শিবির স্থাপন নিয়ে তাদের ‘দ্রুত পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন’ প্রতিবেদনে বলেছে, রোহিঙ্গা শিবিরগুলো প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন তিনটি এলাকার প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছে। এগুলো হচ্ছে,  টেকনাফ উপদ্বীপের উপকূল এলাকা, সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও সোনাদিয়া দ্বীপ। এছাড়া রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর কাছাকাছি রয়েছে দুটি সংরক্ষিত এলাকা। এগুলো হলো, টেকনাফের অভয়ারণ্য ও হিমছড়ির ন্যাশনাল পার্ক। সম্প্রতি প্রস্তাবিত ইনানি ন্যাশনাল পার্কও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে উল্লেখ করে উদ্বেগ জানিয়েছেন তারা। 

রোহিঙ্গাদের যেসব শিবিরে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, সেসব এলাকা মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে এগোচ্ছে। কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় এসব শিবির এলাকায় ৮৩ শতাংশ পানি দূষিত হয়েছে। ভূগর্ভের পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নেমে যাচ্ছে। এছাড়া, পাহাড় কেটে সমান করার ফলে দীর্ঘ মেয়াদে সেখানকার ভূমির প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে।

বন, ভূমি, পানি, প্রাণবৈচিত্র্য, পরিবেশ, প্রজাতি, মানুষের স্বাস্থ্য, জলবায়ুর পরিবর্তন, এসব বিষয়ে ইউএনডিপি ২৮টি উচ্চমাত্রার ঝুঁকি চিহ্নিত করে বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ৫৪টি সুপারিশ করেছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারকে পর্যাপ্ত সম্পদের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে, যেন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শেষ হওয়ার পর ধ্বংস হওয়া পরিবেশ দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়। তবে, রোহিঙ্গা শিবির করায় বন ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের দায় শুধু বাংলাদেশের একার নয় বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, পুরো বিশ্বকেই এ ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে হবে।  
প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদের দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শের পাশাপাশি বলা হয়েছে, রোহিঙ্গারা সরে গেলে ওইসব অঞ্চলে বনায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।

এই বিষয় জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন। এটা বিশ্বের দায়িত্ব। রোহিঙ্গাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে। বাংলাদেশ ১০ বছর মেয়াদি কোনো পরিকল্পনা চায় না। আগামীকালই রোহিঙ্গারা চলে গেলে বাংলাদেশ খুশি।’  

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘কুতুপালংয়ের উপচেপড়া জনাকীর্ণ পার্বত্য অঞ্চলে ভূমি ধস ও অন্যান্য অপ্রীতিকর ঘটনার ফলে মৃত্যু ও দুর্ঘটনা এড়ানো ছাড়াও উন্নত জীবনমানের ব্যবস্থা করতে পর্যায়ক্রমে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করা হবে। এছাড়া কুতুপালং ক‌্যাম্প এলাকায় মাদক ব্যবসার প্রসার ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিও ঘটছে।’ তিনি বলেন,  ‘আন্তর্জাতিক সংস্থা রোহিঙ্গা শিবির ও ভাসানচরের সুবিধা নিয়ে উচ্চস্বরে কথা বলছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের নিরাপদে মর্যাদার সঙ্গে স্বদেশে প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে মিয়ানমারের কাছে যাওয়ার সাহস বা আন্তরিকতা কারও নেই।’

রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের এই সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শে নেওয়া হয়েছে বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এটি প্রধানমন্ত্রীর  ‘বিচক্ষণ ও দৃঢ়’ পদক্ষেপ বলেও তিনি মন্তব‌্য করেন। 

হাসান/এনই

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়