‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়া কতটা সম্ভব হলো’
শিহাবুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম
রায়ের বাজার বধ্যভূমি
পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মতা নির্যাতন, লুট, ধর্ষণের হাত থেকে শুধু নয়, দেশের প্রতিবাদী জনতা দেশ স্বাধীন করার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল মূলত চার নীতিতে। সেগুলো হলো গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন সামনে রেখে এ প্রশ্ন তুলেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা জানাতে আসা সাধারণ মানুষ। তারা বলছেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এখনো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।
সোমবার (১৪ ডিসেম্বর) শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাজধানীর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। শ্রদ্ধা জানাতে আসা অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা মনে করেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ ও বুদ্ধিজীবীদের স্বপ্ন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এখনো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এর কারণ উল্লেখ করে তারা বলেন, দেশে এখনো রাজাকার, আলবদর, আলসামসদের চেতনা অনেকেই ধারণ করেন। আর তাদের আশকারায় মৌলবাদ শক্তিকে নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। একই সঙ্গে শহীদদের স্বপ্ন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টাও সফলতার মুখ দেখছে না।
বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানাতে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে এসেছিলেন তৃণমূল নারী উদ্যোগতা সোসাইটির সদস্য শাহিদা কামাল। তিনি বলেন, ‘আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এখনো পাইনি। স্বাধীনতা পেয়েছি কিন্তু তা ধরে রাখতে পারছি না। এখন দেশের যে অবস্থা হচ্ছে তার জন্য আমরা খুবই মর্মাহত। যেমন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর, স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারের সময় যে আন্দোলন এগুলো- আমরা আশা করিনি। স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে কিন্তু আমাদের সেই স্বপ্নপূরণ করতে পারিনি। দীর্ঘসময় স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি দেশে ক্ষমতায়, কিন্তু সেই যে আলবদর, রাজাকার তাদের চেতনা এখনো নির্মূল হয়নি। অপশক্তি এখনো বিস্তৃত অবস্থায় আছে। তাদের নির্মূল করা দরকার’।
একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. অরুনাবো পোদ্দার। তিনি বলেন, ‘আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ করতে পারিনি। আমরা পিছিয়ে আছি। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের যে চার মূলনীতি ছিল তা থেকে অনেকটাই আমরা পিছিয়ে গেছি। আমরা মনে করি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের সেই মূলনীতিতে ফিরে আসতে হলে আমাদের অনেক পথ পেরুতে হবে। এজন্য আমাদের সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার, আগামী প্রজন্মকে সচেতন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই’।
সম্প্রতি কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়। অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে স্বাক্ষর রাখতে বাংলাদেশে ভাস্কর্য নির্মিত হয়ে আসছে। শ্রদ্ধা জানাতে আসা অনেকেই মনে করেন, ভাস্কর্য নির্মাণে বাধা দেওয়া মানে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন জিন্নাতুন নাহার প্রধান। শ্রদ্ধা জানাতে এসে তিনি বলেন, ‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়নি, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেই লক্ষে কাজ করছেন। তিনি কতটা কার্যকর করতে পারবেন সেটা সময়ের ওপর নির্ভরশীল।’
প্রসঙ্গত, পাকিস্তানী বাহিনী পরাজয় নিশ্চিত জেনে, স্বাধীনতার মাত্র দুই দিন আগে বাংলাদেশকে মেধা শূন্য করতে, রাজাকার-আলবদর, আলশামস ও তাদের সহযোগীদের সহায়তায় বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাংবাদিক, লেখক, চলচ্চিত্র পরিচালকদের নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় রচনা করে। নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, শহীদুল্লাহ কায়সার, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, সাংবাদিক সেলিনা পারভিন, অধ্যাপক আনোয়ার পাশাসহ অনেককে। মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের কয়েকদিন পর রায়ের বাজারের বর্তমান স্মৃতিসৌধের স্থানটিতে পাওয়া যায় অনেকের ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জানাতে এই স্থানে নির্মাণ করা হয় বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ।
শিহাবুল/সাইফ
আরো পড়ুন