ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ঋণ পরিশোধে সুবিধা চান ব্যবসায়ীরা, অর্থনীতিবিদদের দ্বিমত

জুনায়েদ শিশির || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৩৪, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ২০:৩৭, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১
ঋণ পরিশোধে সুবিধা চান ব্যবসায়ীরা, অর্থনীতিবিদদের দ্বিমত

এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, আহসান এইচ মনসুর ও খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

চীনের উহান অঞ্চল থেকে যাত্রা শুরু করা করোনভাইরাস বিশ্বব্যাপী তাণ্ডব চালাচ্ছে। গরিব-ধনী নির্বিশেষে সব দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক সংকট তৈরি করেছে এ মহামারি। করোনার প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দ্বিতীয় ঢেউয়ের কবলে পড়েছে ইউরোপের দেশগুলো। অঞ্চলটি বাংলাদেশি পণ্যের প্রধান রপ্তানিবাজার হওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। রপ্তানি আয়ে দেখা দিয়েছে খরা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়োপযোগী পদক্ষেপে গত বছর (২০২০) ব্যবসায়ীরা কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও চলতি বছর বিশ্ব বাণিজ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে লোকসানে পড়তে হবে বলে মনে করছেন তারা। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত ঋণ পরিশোধের সুবিধা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনগুলো।   

চলতি বছর বাংলাদেশ ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মেয়াদি ঋণ ছাড়া অন্য কোনো ঋণের ক্ষেত্রে কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট নন বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তারা। তারা মেয়াদি ঋণ ও চলতি মূলধনের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা তিন বছর বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন। এ লক্ষ্যে গভর্নর বরাবর চিঠিও পাঠানো হয়েছে। অন‌্যদিকে, ব্যবসায়ীদের এ দাবি পুরোপুরি সঠিক নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষক ও গবেষকরা। তবে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণ পরিশোদের কিস্তির সংখ্যা বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন তারা। রপ্তানি আয় কমলেও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাণিজ্য পরিস্থিতি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে আছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষক সংস্থা মুডি’স বলেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া গত বছরের সুবিধা অব্যাহত থাকলে তা অর্থনীতির জন্য আরও সুফল বয়ে আনবে। তা না হলে রপ্তানির শ্লথ গতির কারণে ব্যাংকের ওপর চাপ বাড়বে।

সার্বিক বিষয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেছেন কয়েকজন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক। তাদের মধ‌্যে আছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার গণমাধ্যমকে দেওয়া বক্তব্য তুলে ধরা হলো। তিনি বলেছেন, ‘ইউরোপে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সেখানকার খুচরা বাজারও বন্ধ। এর প্রভাব পড়ছে রপ্তানি খাতে। এরইমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া পদক্ষেপগুলো ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে করোনার সংক্রমণ পুরোপুরি কেটে গেছে, এখনই তা ভাবার সুযোগ নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আগামীতে আরও পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে ভাবতে হবে। বিজিএমইএ ও অন্যান্য বাণিজ্য সংগঠন আমাদের কাছে বেশকিছু দাবি জানিয়েছে। এসব বিষয়েও উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংককে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানানো হয়েছে।’

বিএবি সূত্রে জানা গেছে, ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই চলতি মূলধনের অর্থ মেয়াদি ঋণে রূপান্তর করে তিন বছরের জন্য পুনঃতফসিল এবং মেয়াদি ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও তিন বছর করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে কিছুটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। শুধু বাংলাদেশে না, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও করোনার কারণে অর্থনীতি ক্ষতির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কিছু সমস্যা আছে। এজন্য সরকার তাদের কয়েকটি সুবিধা দিয়েছে, যা ব্যবসার জন্য সহায়ক। রপ্তানিকারকরা অনেক সুবিধা পাচ্ছেন। বিষয় হচ্ছে, আমাদের ব্যবসায়ীদের সব সময় সুবিধা দরকার। তারা সুবিধা চাইতেই থাকবে। এগুলো যেন মামার বাড়ির আবদার হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এখন বিবেচনা করা দরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের বিষয়ে। তাদের জন্য যে প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে, তার মাত্র ৪০ শতাংশ বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রে বলব, তাদের ঋণের কিস্তির সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। এতে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উপকৃত হবে।’ 

আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘উভয় সংকটের মধ‌্যে দিয়ে সময় পার করছি। দুই পক্ষকে ম্যানেজ করে চলতে হবে। ব্যবসায়ীদের বাদ দিয়ে তো অর্থনীতির বিষয় চিন্তা করা যায় না। আবার ব্যাংকের বিষয় আছে। দুই পক্ষই একে অপরের পরিপূরক।’

রপ্তানিবাজারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রপ্তানি কমার বিষয় আজকের না। অনেকে মনে করছেন, কোভিডের কারণে রপ্তানি খারাপ হচ্ছে। এটি একটি কারণ। তবে এর আগের দুই বছরও বাণিজ্য তেমন ভালো হয়নি। আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজন আছে। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় পদক্ষেপ জরুরি। এজন্য উৎপাদন বাড়াতে হবে, প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহযোগিতার মনোভাব রাখতে হবে।’

২০২১ সালের বাজার পরিস্থিতি কেমন হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে এ অর্থনীতির বিশ্লেষক জানান, গত বছরের মতোই এ বছরও আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি তেমন একটা স্বাভাবিক হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, উন্নত দেশগুলোতে এখনও করোনার টিকা দেওয়ার কার্যক্রম শেষ হয়নি। দ্বিতীয় ঢেউয়ের যে প্রভাব, তা কাটিয়ে উঠতে আরও সময় লাগবে। মনে হচ্ছে, ইউরোপ পরবর্তী শীত মৌসুম আসার আগেই একটি ভালো পরিস্থিতিতে ফিরবে। এর জন্য জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ঠান্ডা শুরু হওয়ার আগেই তারা হয়ত একটি কার্যকর বা স্থায়ী সমাধানে পৌঁছাতে পারবে।’

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বাংলাদেশ অনেক আগেই করোনা পরিস্থিতিকে নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচনা করে অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) প্রথম সাত মাসে রপ্তানি আয় কিছুটা কমলেও আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণে বোঝা যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত আমাদের বাণিজ্য পরিস্থিতি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে আছে।’

তিনি মনে করেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র বড় পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ফলে বিশ্ব পরিস্থিতি খুব দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন, তাতে আশা করা যায়, দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোতে ব্যাপক হারে করোনার টিকা দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে শিগগিরই বড় দুই বাজারের (যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ) মানুষজন স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সেটি হলে অর্থনীতিও ইতিবাচক ধারায় ফিরবে।

ব্যাংক ঋণের প্রসঙ্গে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘ব্যাংকের মেয়াদি ঋণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা সুবিধা পাবেন। তবে মধ্যম ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য চলতি মূলধন ঋণের কিস্তির সময়সীমা বাড়ানো যেতে পারে।’

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের সপ্তম মাস জানুয়ারিতে রপ্তানির আয় লক্ষ্যমাত্রার থেকে ১০ শতাংশ কম হয়েছে। এ মাসে ৩৪৩ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে রপ্তানি হয়েছিল ৩৬১ কোটি ডলারের পণ্য। এ সময়ে রপ্তানি কমেছে ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত। অন্যদিকে, অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ২ হাজার ২৬৭ কোটি ডলারের পণ‌্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১ দশমিক ০৯ শতাংশ কম। উল্লিখিত সময়ে তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্যের রপ্তানি আয় কমলেও পাটজাত পণ্য, রাসায়নিক, হস্ত শিল্পের রপ্তানি বেড়েছে।

ঢাকা/শিশির/রফিক

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়