ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বইমেলা

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৬, ১২ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ০৭:০৭, ১৩ এপ্রিল ২০২১
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বইমেলা

প্রতিবছর অমর একুশে গ্রন্থমেলা হয় ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে। এবার বইমেলা নিয়ে শুরুতে ছিল দোটানা। বইমেলা হবে কি না, সে নিয়ে প্রকাশক, লেখক, পাঠক ও আয়োজকদের মধ্যে ছিল অনিশ্চয়তা। অনিশ্চয়তার মধ‌্যে কেটে যায় অনেকগুলো দিন। তবে, শেষ পর্যন্ত ফেব্রুয়ারির বদলে মার্চের ১৮ তারিখে বইমেলা শুরু হয়। বইমেলা চলার কথা ছিল ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। মেলার প্রতিদিনের সময়সূচি নির্ধারিত হয় বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা এবং ছুটির দিনে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা।

তিন-চার দিন চলার পর বইমেলার সময়সূচিতে পরিবর্তন আসে। রাত ৯টার বদলে ৮টা পর্যন্ত মেলার সময় নির্ধারণ করা হয়। ১৪ এপ্রিলের বদলে ১৩ এপ্রিল মেলা শেষ হবে বলে জানিয়ে দেয় বইমেলা কমিটি। ইতোমধ্যে দুর্ভাগ্যজনকভাবে করোনার সংক্রমণ এবং মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে দিনে দিনে। ক্রমে মেলায় ক্রেতা-দর্শনার্থীর সংখ্যাও কমতে থাকে। এর মধ্যে আরও কয়েকবার পরিবর্তন হয় মেলার সময়। ৩টা থেকে ৮টা, ৩টা থেকে সাড়ে ৬টা এবং সবশেষে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত করা হয় মেলার সময়সূচি।

বারবার মেলার সময় পরিবর্তন হওয়ায় বেকায়দায় পড়েন ক্রেতা-দর্শনার্থীরা। ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রকাশকরা। এর মধ্যে করোনার প্রকোপ মারাত্মকভাবে বাড়তে থাকে। দেশব্যাপী ৫ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন ঘোষণা করা হয়। প্রকাশক, লেখক, পাঠকদের অসন্তোষ ও ক্ষোভের ভেতর লকডাউনেও মেলা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেয় মেলা কমিটি। গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরও বইমেলার সময় বেঁধে দেওয়া হয় দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। এবারও সময়সীমা নিয়ে প্রকাশকদের সঙ্গে মেলা কমিটি কোনো আলোচনা করেনি।

প্রকাশকদের দেওয়া তথ‌্যের বরাত দিয়ে বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্র জানিয়েছে, এবারের মেলায় নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে প্রায় ৩ হাজার। এর মধ্যে উপন্যাস ৮০০টি, গল্প ও গল্প সংকলন ৬০০, কবিতার বই ১ হাজার, প্রবন্ধ ৩০, শিশুতোষ ৪০, সায়েন্স ফিকশন ২০০, ভ্রমণ ৩০ এবং অন্যান্য ৩০০টি।

করোনা, লকডাউন ও সময়সূচির কারণে দিন দিন ক্রেতা-দর্শনার্থীশূন্য হয়ে পড়ে বইমেলা। অথচ বই প্রকাশের পেছনে প্রকাশকদের বড় অঙ্কের টাকা লগ্নি হয়ে যায়। অনেক প্রকাশকের স্টলে সারা দিনের স্টল খরচের টাকার বইও বিক্রি হয়নি। তারপরও স্টল খোলা রাখতে হয়েছে তাদের।

এবারের মেলায় বাংলা একাডেমি এবং প্রকাশকদের মধ্যে ভালো সমম্বয় দেখা যায়নি। প্রকাশকরা বলছেন, বাংলা একাডেমি নিজেদের মতো করে সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমনকি সরকারের সঙ্গেও তাদের (মেলা কমিটির) সমন্বয়হীনতা আছে বলে দাবি করেছেন কয়েকজন প্রকাশক। বার বার মেলার সময় পরিবর্তনের বিষয়ে প্রকাশকদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়নি। অনেক বিষয়ে প্রকাশকদের জানানোও হয়নি বলেও অভিযোগ করেছেন দুই প্রকাশনা সমিতির নেতারা।

অন্যদিকে, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী এবং পরিচালক ও মেলা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ বিভিন্ন সময়ে মেলার বিষয়ে জানিয়েছেন, তাদের কিছু করার নেই। সরকারের তরফ থেকে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তারা কেবল সে সিদ্ধান্ত প্রতিপালন করেন। এবারের মেলার সার্বিক বিষয়ে তাদের নিজস্ব কোনো মতামত বা সিদ্ধান্ত ছিল না বলেও জানান বাংলা একাডেমির এই দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

এবারের মেলা, সময়সূচি প্রসঙ্গে ম্যাগনাম ওপাস-এর কর্ণধার আনোয়ার ফরিদী বলেন, 'প্রকাশকরা অক্টোবর থেকে বলেছিলেন, ফেব্রুয়ারিতেই মেলা করার জন্য। বাংলা একাডেমি সেটা না শুনে মার্চে করলো। বারবার সময় পরিবর্তন করে বাংলা একাডেমি এবারের বইমেলা নিয়ে প্রকাশক, লেখক, পাঠকদের সঙ্গে খেলা করেছে। বাজে সময়ে মেলা করা এবং মেলার সময়ের জন্য পাঠক-দর্শনার্থীরা মেলায় আসেনি। ফলে এবারের মেলা থেকে প্রকাশক, লেখক, পাঠক সবার প্রাপ্তিই শূন্য।'

ইংলিশম্যান-এর স্বত্বাধিকারী আনিসুর রহমান বলেন, 'বাংলা একাডেমি নিজেরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। অসময়ে মেলার আয়োজন করেছে। এতবার মেলার সময় পরিবর্তন করেছে যে, প্রকাশক, লেখক, পাঠক—সবাই বিভ্রান্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও মেলা প্রথম দিন থেকে ৩টায় শুরু করে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা রাখলে সবারই সুবিধা হতো। প্রকাশকরা তাদের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারতেন।'

বাংলানামার স্বত্বাধিকারী কবির আলমগীর বলেন, ‘এবারের বইমেলা যে প্রত্যাশা নিয়ে শুরু করেছিলাম, করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় তা পূরণ হয়নি। বিশেষ করে, পাঠকরা মেলায় আসতে পারেনি। লোকসান হয়েছে। তবে পাঠকরা যদি বই যেকোনো মাধ্যমে সংগ্রহ করেন, তাহলে লোকসানটা কিছুটা হলেও পূরণ হবে।'

মেলায় আসা কয়েকজন পাঠক-দর্শনার্থী বলেন, ‘বইমেলার অপর নাম প্রাণের মেলা। কিন্তু এবারের মেলায় প্রাণ ছিল না। পাঠক, লেখক, প্রকাশক সবার প্রাণই ওষ্ঠাগত এবার। প্রকাশকদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য, মেলা শেষ হলে প্রকাশকদের উদ্যোগে অনলাইনে হলেও বই বিপণনের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলা একাডেমি দায়সারা কাজ করেছে। এবার প্রকাশকদের নিজেদের বাঁচাতে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে জড়িত ও ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি অনুদান না দিলে প্রকাশনা শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।’

লেখকরা বলছেন, এবারের মেলা আয়োজনের সময়টা ঠিক হয়নি। যে করোনার ভয়ে ফেব্রুয়ারির বদলে মার্চে মেলা হলো, সে করোনার প্রকোপ বরং মার্চেই বেশি হয়েছে। তার ওপর যে সময়ে মেলা খোলা রাখা হয়েছে, তার তেমন উপযোগিতা ছিল না। অফিসের কাজ সেরে মেলায় আসতে আসতেই মেলার সময় শেষ। ফলে পুরো সময় জুড়ে মেলায় পাঠক নেই, ক্রেতা নেই। এবারের মেলা প্রকাশনা শিল্পের অর্থনীতিতে বিশাল নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এটা থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা প্রকাশকদেরই বের করতে হবে। সরকারকেও প্রকাশকদের পাশে দাঁড়াতে হবে।

ঢ‌াকা/মেসবাহ/রফিক

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়