ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

ছেলে ইউরোপে, মায়ের ঈদ বৃদ্ধাশ্রমে

আসাদ আল মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৭, ১৪ মে ২০২১   আপডেট: ১৬:৫৩, ১৪ মে ২০২১
ছেলে ইউরোপে, মায়ের ঈদ বৃদ্ধাশ্রমে

‘সবকটা রোজা রাখলাম। কাল রাত ৩ টায় ঘুম ভাঙলো। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করলাম। ফজর পড়ে ঘর সাজিয়ে সেমাই খেয়েছি। ঘর সাজানোর পর কলিজাটা মুচড়ে উঠলো। থেকেও যে আমার সন্তান নেই । তখনই নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় মনে হলো!’

শুক্রবার (১৪ মে) রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাসে এভাবেই নিজের জীবন কাহিনি শোনাচ্ছিলেন ৬৫ বছর বয়সী সাফিয়া বেগম।

সন্তান ও আত্মীয়দের পরিচয় গোপন রেখে তিনি বলনে, স্বামী সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। ১০ বছর আগে মারা যান। একমাত্র ছেলে  ইউরোপে তার পরিবার নিয়ে থাকে। মাসে টাকা পাঠায়। কিন্তু তাকে দেখি না বছরের পর বছর।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আমার ছেলেটা ছোটবেলা ঈদের আগে কত রকম দাবি করত। ওর জন্য কেনা শার্ট, জুতা, গেঞ্জি পছন্দ না হলে কান্নাকাটি করতো।  বারবার শপিংয়ে গিয়ে চেঞ্জ করে আনতাম। ওর বাবা একটু বেশি রাগী ছিল। তাই গোপনে সবকিছু করতাম। আজ স্বামী নেই। আর ছেলে থেকেও নেই। এখন ছেলের অনেক টাকা। মাসে টাকা দেয়। কিন্তু সেই টাকা তো শুধু তাকে জন্ম দিয়েছি বলে পাঠায়! মুখে কাপড় দিয়ে কষ্ট চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন সাফিয়া বেগম।

ছেলের নাম পরিচয় কিছুই বলতে রাজি হননি মমতাময়ী মা। বললেন, এটা মিডিয়ায় প্রচার হলে ছেলে সমাজের কাছে ছোট হবে। ওর সুখই আমার সুখ। কিসের ঈদ? ছেলের জন্য প্রতিদিন চোখের জল ফেলি। এখনো ওর জন্য মনভরে দোয়া করি।’    

এমন জীবনের গল্প শুধু সাফিয়া বেগমের নন, আরও অনেকের। বৃদ্ধাশ্রমে কথা হয় ময়না খাতুনের (৭০) সঙ্গে। ছয় বছর আগে তার স্বামী মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর ছয় মাস পরে সন্তানেরাও ঘরে জায়গা দেয়নি। ময়না খাতুন বলছিলেন, ২০১৫ সালে জানুয়ারিতে স্বামী মারা যাওয়ার ৬ মাস পর সন্তানের অত্যাচারে কিছু না বলে  বাড়ি ছাড়ি। একদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে অসুস্থ হয়ে পড়ি।  এরপর এখানে আশ্রয় মেলে। এরপর দিন-মাস বছর পেরিয়ে গেল। এমনকি ঈদের দিনেও এখন সন্তানরা কেউ খোঁজ নেয় না।

আশ্রমে থাকা রাজধানীর একটি কলেজের সাবেক অধ্যাপক বলেন, স্ত্রীর মৃত্যুর পর ছেলের বউদের অবহেলার কারণে ৩ বছর ধরে এখানে থাকি। দুই মেয়ে তাদের বাসায় নিয়ে রাখতে চায় কিন্তু আমি না বলে দিয়েছি। মেয়েরা খোঁজ নেয় এবং খরচও দেয়। কিন্তু ছেলেটা আসে না। কোনদিন খোঁজও নিল না। আজ ভোরে  মেয়ে ফোন দিয়ে বলেছে দুপুরে খাবার নিয়ে  আসবে। শুনে ভালোই লাগছে। দুপুরে একসঙ্গে মেয়ের সঙ্গে খাবো।

৬১ বছরের সেলিনা আক্তার বলেন, ১৭ বছর আগে স্বামী মারা গেছে। দুই ছেলের মধ্যে ছোট ছেলের সাথে থাকতাম। ছোট ছেলেটা দুই বছর আগে মারা গেছে। এক বছর ধরে এখানে থাকি। বড় ছেলে যুক্তরাষ্ট্র থাকে। টাকা পাঠায় কিন্তু দেখতে আসে না। অভিমানী গলায় এই ভদ্রমহিলা বলছিলেন, বিদেশে মা-ছেলে যে যার মতো করে চলে। জীবনের শেষ বয়সে এসে তাদের অনুসরণ করতে হলো। এই দুঃখ নিয়ে মরতে হবে।  

একবুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তিনি বলেন, সন্তানের জন্য অভিযোগ নাই, আমি ভালো আছি। পেটে ধরেছি সন্তান। যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক, আল্লাহর কাছে এই দোয়াই করি।

ঈদের দিকে বৃদ্ধাশ্রমের এই বাসিন্দাদের কেউ মোবাইল হাতে নিয়ে অপেক্ষায় আছেন। আবার কেউ ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। যদি কোন ফোন কল আসে। যদি চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়ে কেউ বলে-মা, ঈদ মোবারক।

প্রবীণ নিবাসের জিএম (জেনারেল ম্যানেজার) আব্দুর রহমান সুমন বলেন, এখানে যারা তারা আমাদের বাবা-মা। আমরা এটা মনে করে তাদের খেদমত করি। এখানে যারা থাকেন সবাই সুখে থাকুক, শান্তিতে থাকুক সেই চেষ্টা করি। অনেক প্রবীণ নিরবে একা একা কাঁদেন। কিন্তু সন্তানদের জন্য বদদোয়া করেন না। সব সময় দোয়া করেন তারা যেন ভালো থাকুক।

আসাদ/ই

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়