ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

অবৈধ বৈধ হয় ক্ষুধার জ্বালায়  

খায়রুল বাশার আশিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫২, ১২ অক্টোবর ২০২১  
অবৈধ বৈধ হয় ক্ষুধার জ্বালায়  

সকালে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তারা পৌঁছে যান নদী-সাগরের মোহনায়। শুরু হয় দিনের কাজ। যদিও নিষিদ্ধ রেণু পোনা আহরণ, ক্রয়, পরিবহণ, বিপণন। তবুও ক্ষুধার জ্বালায়, পেটের তাগিদে লুকিয়ে কাজটি করেন তারা। এ সময় অনেকে উচিত-অনুচিত চিন্তা করেন না। এ যেন উভয় সঙ্কট। একদিকে পরিবারে অনাহারী মুখ, অন্যদিকে আইনের নিষেধাজ্ঞা। এ সঙ্কট মেনে নিয়েই উপকূলীয় তটরেখায় বাগদা ও গলদা চিংড়ির রেণু পোনা  ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন হাজারো জেলে।

বাগদা ও গলদা রেণুকে সাধারণত বলা হয় পোস্ট লার্ভিয়া (পিএল)। গলদা ও বাগদা চিংড়ির রেণু খুব সূক্ষ্ম। রেণুগুলোর দৈর্ঘ্য আধা ইঞ্চি থেকে এক ইঞ্চি, প্রস্থ সুতার মতো। প্রতিটি রেণু এতটাই সূক্ষ্ম যে, সাদা একটি ঝিনুকের সাহায্যে রেণুগুলোকে আলাদা করতে হয়। এগুলো আহরণে ব্যবহার হয় নিষিদ্ধ মশারি ও ঠেলা জাল। চিংড়ির পোনা বাছাইয়ের সময় বাইলা, সুরকা, পোয়া, পাঙাশ, বাতাসি, পাবদাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের ডিম ও পোনা নষ্ট হয়। এতে করে মাছ শূন্য হয়ে যাচ্ছে আমাদের নদ-নদী ও সাগর। এসব কারণে ২০০০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে চিংড়ির রেণু আহরণ নিষিদ্ধ করে।

ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কোনো প্রাকৃতিক উৎস, প্রজনন ক্ষেত্র, নদী, খোলা জলাশয় থেকে রেণু আহরণ করা যাবে না। সেই থেকে বছরজুড়েই কাজটি অবৈধ। 
দেশের উপকূলীয় ৭১০ কিলোমিটার তটরেখাজুড়ে চিংড়ি রেণুর বিচরণ। এ অঞ্চলের জেলেরা সব জেনেও কাজটি করতে বাধ্য হন। এই সুযোগ নেন মহাজনেরা। তারা জেলেদের ঋণ দেন। জেলে ঋণ পরিশোধ করেন রেণু পোনার বিনিময়ে। এভাবে মহাজনরা রেণু ধরতে বাধ্য করেন।

এ ছাড়াও দারিদ্র্য এ কাজের পেছনে অন্যতম কারণ। এমনিতেই অভাবের মধ্যে জীবন কাটে উপকূলীয় নিম্নবিত্তদের। অভাবগ্রস্ত জনপদে নতুন সমস্যা তৈরি করেছে এই করোনাকাল। এ সময় পুরুষরা কাজ হারিয়েছে,  নারীরা কাজের পারিশ্রমিক কম পাচ্ছে। ফলে বাড়তি আয়ের জন্যও অনেকে রেণু ধরার কাজ করছে নিষেধাজ্ঞার কথা জেনেও।

কিন্তু যারা চিংড়ির রেণু ধরছেন তারাই অপরাধী নন, এই অপরাধের পেছনে রয়েছে বড় অঙ্কের লেনদেন। নদী বা সমুদ্রের গলদা চিংড়ির রেণু দ্রুত বড় হয়। এ জন্য যশোর, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ দেশের চিংড়ি ঘের মালিকদের কাছে এসব রেণুর কদর স্বর্ণের মতো। জেলেদের কাছ থেকে ঘের মালিকরা এগুলো কিনে নেন। এ ব্যবসায় অগণিত ঘের মালিক লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে। প্রতি বছর উপকূলে চিংড়ির রেণু কেনা-বেচায় কোটি টাকা লেনদেন হয়। শীত মৌসুমে এ অপরাধের পরিধি বেড়ে যায়।

প্রতিদিন পাঁচশ থেকে সাতশ রেণু ধরতে পারে একজন জেলে। এসব রেণু জেলেদের থেকে কিনে নেন হকার। হকারদের কাছ থেকে কেনেন আড়তদার। তারা গোপন স্থানে ড্রামের মধ্যে রেণু জমাতে থাকে। এরই মধ্যে মোবাইলে পাইকার বা মহাজনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। ঘের মালিকদের প্রতিনিধি হয়ে পাইকাররা আসে একাকায়। তারা এগুলো দেখে দামদর করে টাকা বুঝিয়ে দেয়। এরপরই নির্ধারিত ঠিকানায় বিক্রয়কৃত রেণু পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেয় আরতদার।

আহরণকারীরা যে রেণুটি হকারদের কাছে দুই টাকায় বিক্রি করে, সেটি হাত বদল হতে হতে ঘের মালিকের কাছে পৌঁছায় কমপক্ষে পাঁচ টাকা দামে। মাঝখানে হকার আড়তদার ও পাইকার সবাই নির্দিষ্ট হারে কমিশন পায়।

রেণু পোনা ধরার কাজে কেবল দিনের আলো দরকার হয়। বাকি সব কাজ হয় রাতে। খুব সকাল আর ভর দুপুরে জেলেরা রেণু ধরে। এ সময় নদীতে মানুষের আনাগোনা থাকে কম থাকে। ফলে এ সময়কেই উপযুক্ত হিসেবে বেছে নেয় জেলেরা। তবে জেলেদের থেকে রেণু সংগ্রহ, জমা করা, পাইকারকে দেখানো, টাকার লেনদেন, ট্রাকে রেণু পরিবহণ- সবই হয় রাতের আঁধারে। জেলেদের অভিযোগ, মোটা টাকার বিনিময়ে পোনা পরিবহণের কাজে সহযোগিতা করে মৎস্য কর্মকর্তা, পুলিশ, সাংবাদিক, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালীরা।

পোনা ধরার বৈধতা না থাকায় ক্যামেরার সামনে নিজের ছবি তোলা তো দূরের কথা, নামটাই বলতে নারাজ তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন পোনা শিকারী ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘যেদিন মৎস্য কর্মকর্তারা আইবে (আসবেন) তা আমরা আগ থেকেই জানতে পারি।’
‘কীভাবে জানেন?’ প্রশ্নের উত্তরে একজন বলেন, ‘হকারদের মাধ্যমে খবর আসে। আড়তদাররাই খবর পাঠায়। শুধু বলে দেয়, আজ পানিত নামিস না। আমারা যা বোঝার বুইঝা যাই।’

তারা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘কেমনে আড়তদাররা আগে খবর পায়? এ কামে অনেকেই জড়িত। হুদাই পেপারে ছবি ওডে মোগো (জেলেদের)।  পারলে তাগোরে ধরান। মোরা ইনকাম করি প্রতিদিন ৫০০ থেইকা ৭০০ ট্যাহা। তারা ইনকাম করে লাখ লাখ ট্যাহা।’

এ বিষয়ে কথা হয় বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেবের সঙ্গে। তারা বলেন, ‘বছরজুড়ে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকে। ইতোমধ্যে নেট জালের ব্যবহার আমরা কমিয়ে ফেলেছি। তবে বলব না যে, আমরা শতভাগ এটি নিধন করতে পেরেছি। আমরা আইন বাস্তবায়ন করেছি। যার ফলে প্রাকৃতিক উৎস থেকে জেলেরা অনেক গলদা-বাগদা পাচ্ছে। তবে একটি নির্দিষ্ট গরিব মানুষ এখনও উপকূলীয় মোহনায় কোমড় বা গলা সমান পানিতে টানা জাল ব্যবহার করে রেণু ধরে। এমন জায়গায় এসব মানুষ বসবাস করে, সেখানে আমাদের অভিযান করা সম্ভব হয় না। ‘

এ কাজে জড়িত চক্র প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ’আগের মতো সিন্ডিকেট আর নেই। হতে গোনা গোপনে দু’একজন লুকিয়ে এগুলো চালাচ্ছে। আশা করছি আগামী দু’এক বছরের মধ্যে তারাও আর থাকবে না।’   

পোনা পরিবহণ প্রসঙ্গে এই মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, ’পরিবহণের ক্ষেত্রে অনেক সময় হ্যাচারির সিল মেরে নদীর পোনা পরিবহণ করে। সেক্ষেত্রে পোনাটা আসলে বৈধ বা অবৈধ কিনা বুঝতে পারা কষ্টকর হয়ে যায়। তবে, হ্যাচারির রশিদ, সিল ছাড়া কোনো পোনা পরিবহণ করা যাবে না বলে বিধান করা হয়েছে। এতে অবৈধ পোনা পরিবহণ অনেকটা কমে গেছে।  পোনা আহরণ সম্পূর্ণ বন্ধ হলে, এমনিতেই অবৈধ পরিবহণ বন্ধ হয়ে যাবে।’ 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়