ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নতুন প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৭, ১২ এপ্রিল ২০২২   আপডেট: ১০:৫৪, ১২ এপ্রিল ২০২২

‘দেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না’-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই প্রত‌্যয়ে তার আবেগের প্রকল্প ‘আশ্রয়ণের’ মাধ্যমে দুই ধাপে ঘর পেয়েছেন এক লাখ ২৩ হাজার ২৪৪টি গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবার। তৃতীয় ধাপে ঘর পাবে আরও ৬৫ হাজার ৪৭৪টি পরিবার। এতে দুই শতক জমির মালিকানাসহ সেমিপাকা ঘর করে দেওয়া হচ্ছে। একইভাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মতো সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন‌্যও রয়েছে ঘর দেওয়ার প্রকল্প। এতে বদলে যাচ্ছে তাদের জীবনযাত্রার মান। উঠে আসছে সমাজের মূলস্রোতে।

রুপকল্প-২০৪১ কে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর সুদুরপ্রসারী ও অভূতপূর্ব এসব কর্মসূচির মাধ্যমে কীভাবে উপকারভোগী হচ্ছেন নিঃস্ব এই মানুষগুলো, বদলে যাচ্ছে তাদের জীবন তা সরেজমিনে দেখেছেন রাইজিংবিডির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এসকে রেজা পারভেজ। রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, সাভারের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে এসে পরিবর্তনের সেসব গল্পের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব।

আশ্রয়ণ প্রকল্পে সেলাইয়ের কাজ করছেন এক নারী

একশ দশ বছরের পেয়ারুল বানু একধ‌্যানে পুতা দিয়ে সুপারি বাটছেন। কানে একটু কম শুনলেও কথা বলতে পারেন খুব ভালোভাবে। এই যে ঘর এটা কে দিয়েছে জানতে চাইলে তার উত্তর, ‘হাসিনা দিছে বাবা, হাসিনা। আল্লাহ তারে হায়াত বাড়ায় দিক, সবকিছুতে বরকত দিক।’

ইসমাইল হোসেন। ক্লাস টেনে পড়েন। স্বপ্ন দেখেন একদিন অনেক বড় হবে। বাবা মো. ইবাদুল হক আর রোজিনা বেগমের সঙ্গে আশ্রয়ণের একটি ঘরে থাকে সে। জীবনের পরিবর্তনটা এখানে কেমন, প্রশ্ন করতেই ইসমাইলের উত্তর, ‘বিদ‌্যুৎ আছে, মাথার ওপর ছাদ আছে, এখানকার পরিবেশও খুব ভালো। এটা আগে পাইনি। আগের থেকে পড়াশোনা অনেক ভালো হচ্ছে। অনেক বড় হতে চাই।’

পেয়ারুল বানু এবং ইসমাইল হোসেন-দুই প্রজন্মের এই দুজনের সুখে-শান্তিতে থাকা কিংবা স্বপ্ন দেখার সাহস যুগিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্প। পেয়ারুল বানু ও ইসমাইলের মতো এমন লাখো গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষকে একটি ঠিকানা দিয়েছে এই প্রকল্প।

সম্প্রতি রাজশাহী ও সিরাজগঞ্জ এলাকা ঘুরে উপকারভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই একটি ঘরই তাদের জীবনই বদলে দিয়েছে। প্রত‌্যেকেই কোনো না কোনো কর্ম করে এখন স্বাবলম্বী। সন্তানদের পড়াশোনা করাচ্ছেন। এক সময়ে অবহেলিত, নিঃস্ব মানুষগুলো এখন সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখছেন। এজন‌্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

আশ্রয়ণ প্রকল্পে গরুর খামার 

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রানীনগরে দ্বিতীয় পর্যায়ে ঘর পেয়েছেন ৬০টি পরিবার। তৃতীয় পর্যায়ে পাবেন আরও পাঁচটি পরিবার। এই আশ্রয়ণের একজন উপভোগী মো. আশরাফুল ইসলাম।  নদীতে সব কেড়ে নেওয়ার পর ২০ বছর ধরে সরকারি জমিতে কোনো রকম মাথাগুজে থাকতেন। সেখানেই এখন আশ্রয়ণের ঘর পেয়েছেন তিনি। নিজে কৃষি কাজ করেন আর তার স্ত্রীকে ছোট একটা দোকান করে দিয়েছেন। 

‘আমরা খুব ভালো আছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিদ‌্যুতের ব‌্যবস্থা করে দিছেন, পানির ব‌্যবস্থা করে দিছেন। ঘর পেয়ে তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। এক ছেলে আছে। সেও আলাদা ঘর পেয়েছে। আমরা এখন সুখে শান্তিতেই আছি’, বলছিলেন আশরাফুল ইসলাম।

উপকারভোগীদের আরেকজন মো. তাসলিমা বেগম। এক ছেলে, এক মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে বসবাস। ভূমিহীন তসলিমার এখন একটাই স্বপ্ন ছেলে মেয়েদের মানুষ করা। স্বামী ভ‌্যান চালিয়ে, কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। আমরা ভালো আছি। ছেলে-মেয়েদের সুবিধা হয়েছে। তারা এখন বিদ‌্যুতের আলোয় পড়াশোনা করে।’

ইসমাইল হোসেরে ছেলে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। ছেলেকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। নিজে কষ্ট করেন, কৃষিকাজ করেন। কিন্তু ছেলে ওদিকে কখনও নেন না। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়ে এখন মাথা থেকে চিন্তা চলে গেছে তার। অন্তত মাথার ওপর ছাদটুকু তো আছে।

সেই কথা বলতে গিয়ে ইসমাইল স্মৃতিচারণ করেন পুরোনো দিনের, ‘আলিপুর গ্রামে আমরা থাকতাম। নদী ভাঙনে সব গেছে। অনেক দিন এখানে সেখানে থাকছি। ভাঙা টিন আর এটা ওটা দিয়ে ছাপরা করে থাকতাম।’

আশ্রয়ণ প্রকল্পে পেয়ারুল বানু সুপারি বাটছেন

‘প্রধানমন্ত্রী দুই শতক করে আমাদের নামে জায়গা দিছে। ঘর দিছে। দিনমজুরের কাজ করি আর যে যাই করুক, দিন শেষে নিজের ঘরে থাকতে পারছি। এটাই আনন্দ। এই সরকার যেন আবারো আসে। আমার মতো এমন আরও ভূমিহীন মানুষ ঘর পাক।’

সরেজমিনে রানীনগরের এই আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘুরে দেখা যায়, কেউ বসে নেই।  সবাই কিছু না কিছু করছেন। স্বাবলম্বী হওয়ার দারুণ প্রচেষ্টা আছে এখানকার বাসিন্দাদের। কেউ কেউ গরু পালছেন।  কেউ মহিষের খামার গড়েছেন, কেউ ছাগল পালন করছেন, আর কেউবা দোকান দিয়েছেন।

মোসাম্মত হাজেরা বেগমের তিন মেয়েই এখন স্কুলে যায়। নদীর করাল গ্রাসে সব হারানো হাজেরার এখন স্থায়ী ঠিকানা হয়েছে। স্বামী ইজিবাইক চালায় আর নিজে সরকারের দেওয়া সেলাই মেশিন দিয়ে জীবনের চাকা ঘোরাচ্ছেন।

‘আমরা নদী ভাঙনের সব হারাইছি। এখানে সরকার পানি, কারেন্ট দিছে। সব সুযোগ-সুবিধা পাইছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের ঘর দিয়েছে। ভাবতে পারিনি আমাদের বাড়িঘর হবে। শেখ হাসিনার জন‌্য এই ঘর পাইছি। উনি যেন ভালো থাকেন’, বলেন হাজেরা।

প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ঘর হস্তান্তরের পর উপকারভোগীদের জীবনমান কেমন উন্নয়ন হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রকল্প ঘুরে তাদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব এম এম ইমরুল কায়েস। তিনি বলেন, ‘মূল বিষয় হচ্ছে তারা এখন সমাজের মুলস্রোতে উঠে আসছে। সবাই কর্ম করছে।  তারা সবাই বেশ স্বাবলম্বী হচ্ছেন ধীরে ধীরে। সন্তানদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করছেন। তারা এখন সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখার সাহস পাচ্ছে। এসবই বঙ্গবন্ধু কন‌্যা শেখ হাসিনার জন‌্যই সম্ভব হয়েছে। কারণ তিনি ঘর দেওয়ার পরও তাদের নিয়মিত মনিটরিং করছেন।’

সিরাজগঞ্জ সদরের খোকশাবাড়ি ইউনিয়নে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১৫ একর জমিতে ২৬৬ পরিবারকে ঘর উপহার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সেই প্রকল্পে ঘর মেয়ে মা-বাবাকে নিয়ে জীবনের নতুন গল্প বুনছেন সানোয়ার হোসেন সানু। প্রধানমন্ত্রীর উপহার ঘর পেয়ে এখন পুরোদস্তর ব‌্যবসায়ী তিনি। দিয়েছেন মুদি দোকান। সানুর মতে, আজকের তার যে অবস্থান তা প্রধানমন্ত্রীর অবদান।

‘প্রতি বছর বন‌্যয় খুব কষ্ট করতাম। যেখানে থাকতাম ঘরে পানি উঠে যেত। পানি না নামা পর্যন্ত প্রাইমারি স্কুলে থাকছি। খুব কষ্ট হতো। এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই ঘর দিয়েছেন।  আমি ছোট্ট একটা দোকান দিয়েছি। এই ঘর আমাকে বদলে দিয়েছে। এই যে ঘরে বসে আাছি, এতটুকু করতে পারছি; সবই প্রধানমন্ত্রীর অবদান। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে দীর্ঘজীবী লাভ করান।’ 

আশ্রয়ণ প্রকল্পে দোকান দিয়ে সুখেই চলছে সংসার এই দম্পতির

এক সময় অন‌্যের জমিতে অস্থায়ীভাবে থাকতেন। সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলে আরেক জায়গায় গিয়ে থেকেছেন। নিজের বলতে কোনো কিছুই নেই। এখন নিজের ঘর হয়েছে। সেটি ভেবেই অশ্রুসজল আসমা খাতুন।

‘পরের ঘরে থাকিছি, মারামারি হুড়োহুড়ি। বাইরাইছে, পারা দিছে, একটা ছাপড়া ছিলো ভাইঙ্গা দিছে।  কত কষ্ট করিছি বাবা। এখন যদি ভিক্ষা কইরেও আনি ঘরে থুয়ে খাইতি পারবানি। এরম কোনো সরকার সুখ দেয় নাই, শান্তি দেয় নাই’, বলছিলেন আসমা খাতুন।

সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহমেদ বলেন, এখানে প্রত‌্যেকে আত্মকর্মসংস্থানের জন‌্য নিজেদের মধ‌্যে কিছু না কিছু করছেন। অনেকে দোকান দিচ্ছেন। কেউ ইজিবাইক চালাচ্ছেন। প্রত‌্যেকটি লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। শহর খুব কাছে হওয়ায় সেখানে কাজ করে আবার এখানে ফিরে আসছেন সন্ধ‌্যায়। প্রধানমন্ত্রী যে স্বপ্ন দেখছেন যে, ঘর দেওয়ার পর তারা নিজের পায়ে দাঁড়াবে, তার একটি উদাহরণ এই খোকশাবাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্প।

আরও পড়ুন

প্রথম পর্ব : তারাও আর পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নয়

দ্বিতীয় পর্ব: বেদখল জমিতে যেভাবে গড়ে উঠছে আগামীর স্বপ্ন

/পারভেজ/সাইফ/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়