ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

একাত্তরে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার মধু দার পরিবার

আবু বকর ইয়ামিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৮, ১৪ ডিসেম্বর ২০২২   আপডেট: ০৯:৫১, ১৪ ডিসেম্বর ২০২২
একাত্তরে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার মধু দার পরিবার

ছবি: রাইজিংবিডি

১৯৭১ সালে পাক হানাদারদের অত্যাচারের নির্মোহ চিত্র উঠে আসে মুধু দার পরিবার থেকে। ঘটনাটি একাত্তরের ২৫ মার্চ রাত ১০টা-১১টার দিকের। ওই সময় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় হানাদারবাহিনী জড়ো হতে থাকে। সেখান থেকে তারা বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়। এক গ্রুপ গেল জগন্নাথ হলে, এক গ্রুপ গেল জহুরুল হক হলে, এক গ্রুপ এস এম হলে, আরেক গ্রুপ গেল রোকেয়া, শামসুন্নাহার হলের দিকে।

১২টার দিকে তারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। আমরা তখন ঘুমাচ্ছিলাম। প্রথমদিকে কম গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। পরে আস্তে আস্তে আকল্পনিক গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। এবং সবাই বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিল। কর্মচারীদের ঘরগুলো আগুনে জ্বলছিল। তখন বাবা মা, বড় ভাইসহ আমরা পরিবারের সবাই বারান্দায় এসে দাঁড়াই। বারান্দা দিয়ে দেখছিলাম চারপাশে কি হচ্ছে।

মধুসুদন দে (মধু দা)-এর ছেলে বর্তমান মধুর ক্যান্টিনের কর্ণধার অরুণ কুমার দের ভাষ্যে এসব উঠে আসে।

তিনি বলেন, ২৬ মার্চ ভোর সাড়ে ৬টা কি ৭টা। একদল পাক হানাদারবাহিনী আসে আমাদের দোতলার বাসাটিতে। উর্দুতে বাবাকে ডাক দেয়। বাবা দরজা খোলে দেয়। সাথে সাথে বাবাকে হাত বেধে ফেলে। এবং পাশের ফ্ল্যাটের সাথে দাঁড় করিয়ে রাখে। শুরু হয় তছনছ করে ফেলে পুরো বাসা। শুরু করে হত্যাযজ্ঞ।

অরুন কুমার দে বলেন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে যেতে জগন্নাথ হলের বিপরীত পাশে হাতের বামে ৪ তলা ভবনের দোতলায় থাকতাম আমরা। আমার বাবা-মা, বড় ভাই, বউদিসহ ১১ জন বাসায় ছিলাম। জগন্নাথ হলের বর্তমান যে সীমানা দেয়ালটি তখন ছিল না। আমরা গুলির শব্দ শুনছিলাম। ২৬ মার্চ ভোর সাড়ে ৬টা-৭টার দিকে আমাদের ভবনের সামনে মেইন রোডে আর্মির আট-দশটা গাড়ি। একটা গ্রুপ গেল গোবিন্দ চন্দ্র দেবের (জিসি দেব) বাংলোর দিকে। বাসাটি ছিল রাস্তার অপর পাশে। আরেকটা গ্রুপ আসল আমাদের বাসায়। আরেকটা গ্রুপ গেল শিব মন্দিরের দিকে। কিছু গাড়িতে রাস্তায় ছিল।

১০-১২ জনের একটা গ্রুপ আমাদের বাসায় চলে এলো। নিচে এসে জিজ্ঞেস করল বাবার কথা। মধু দা কোথায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্টাফ তোতা মিয়া। সে ড্রাইভারের চাকরি করত। সেই এসে বাসা দেখিয়ে দিয়ে বলে, এ বাসায় থাকে। তখন তারা দোতলায় এসে বাসার দরজায় আঘাত শুরু করে। দরজা খোলার পর জানতে চায় বাবা কোথায়?

বাবা তখন ৪ তলায় ছিলেন। বলা হলো যে উপরে থাকে। তখন চলে গেল চার তলায়। ওদের ঊর্দু ভাষায় দরজা খুলো দরজা খুলো বলার শব্দ শোনা গেল। বাবা দরজা খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা বাবাকে ঘিরে ধরে। বাবার হাত বেঁধে পাশের ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। চারদিক থেকে বাবাকে ঘিরে দাঁড়ায়। বাবা হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর আমাদের ঘরে আসে একজন হানাদার। বাসা তছনছ করে ফেলে। বাকিরা গেটের সামনে অপেক্ষা করছিল।

আমার বড় ভাই রনজিৎকুমার দে নতুন বিয়ে করেছেন। বউদি রীনা রানী দে পাশের রুমে ছিলেন। ওই সৈন্য বউদিকে ধরতে যায়। বউদি ছুটোছুটি শুরু করেন। আমার বোন গিয়ে ভাইকে ডাক দেয়। বড় ভাই এসে বলল হাত তোল, হাত তোল। কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গে বড় ভাইয়ের বুকে গুলি করে। ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। এক পর্যায়ে বউদি বসে পড়লেন। ওই অবস্থায় বৌদিকেও গুলি। ভাই-বৌদি দুজনেই মারা গেলেন। সেখানে মারা যান।

ভাই বৌদিকে মেরে ওই বাবাকে মারতে যায়। বাবাকে মারতে মা বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, আমার তো সবই শেষ করে দিলে। আমার স্বামীকে মেরো না। ওই অবস্থায় মায়ের সমস্ত শরীর গুলি করে ঝাঁজরা করে দেয়। খুবই নৃশংসভাবে হত্যা করে আমার মাকে। মায়ের জিহ্বা বের হয়ে যায়। নাক মুখ দিয়ে রক্ত যেতে থাকে।মা মারা যান।

মাকে মারার সময় দুইটা গুলি বাবার পায়ে লাগে। ওই সময় তারা বাবাকে মেরে ফেলেনি। পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বাবাকে রেখে ওরা সবাই চলে যায়। এক ঘণ্টা পরে দুইজন বাঙালিকে নিয়ে আসল। ওরা লাশগুলোকে সরিয়ে নিল। পরে বাবাকে নিয়ে গেল। সামনে পেছনে পাকিস্তানি সৈন্যরা। আমি ওদের পায়ে ধরে বাবাকে নিয়ে যেতে বাধা দিই। সৈন্যদের একজন পায়ের বুট দিয়ে আমাকে জোরে লাথি মারে।

অরুন কুমার দে বলেন, ওরা বাবাকে জগন্নাথ হলের মাঠে নিয়ে যায়। ওদিকে জগন্নাথ হল বাংলো থেকে নিয়ে আসে দর্শন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক গোবীন্দ চন্দ্র (জিসি) দেবকে। তিনিও গুলিবিদ্ধ ছিলেন। বাবা ও জিসি দেবসহ ছাত্র-শিক্ষকদের এক লাইনে দাঁড় করাল। সবাইকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদাররা। এরপর ওখানেই মাটি খুঁড়ে চাপা দেয় সবাইকে।

হত্যাযজ্ঞের পর বাসায় দুদিন ছিলাম। পরে আমরা চলে যাই দেশের বাড়ি বিক্রমপুরে। ওখানে আমার বড় বোন আর বড় দুলাভাই ছিল। সেখানে গিয়েও রাজাকারদের জ্বালায় শান্তিতে থাকতে পারিনি। পরে রাতের অন্ধকারে ভারত চলে যাই। সেখানে ত্রিপুরায় উঠি। ক্যাম্পে ছিলাম কিছু দিন। তারপর আত্মীয়দের বাসায় থাকলাম কিছুদিন। এভাবে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত ছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে আসি। নতুন করে দায়িত্ব নিই মধুর ক্যান্টিনের।

/ইয়ামিন/সাইফ/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়