ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ফিরে দেখা : চন্দ্রজয়ের ৫০ বছর

জাহাঙ্গীর সুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩২, ১৪ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফিরে দেখা : চন্দ্রজয়ের ৫০ বছর

চাঁদের মাটিতে রাখা একটি যন্ত্রের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন বাজ অলড্রিন

জাহাঙ্গীর সুর: চাঁদে মানুষ পাঠানো সহজ কাজ ছিল না মোটেও। অ্যাপোলো প্রকল্পে বিশ্বের চার লাখ মানুষের নিরলস শ্রম ও মেধার গৌরব জড়িয়ে রয়েছে চন্দ্রজয়ের ইতিহাসের সঙ্গে। এদের মধ্যেই পড়েন তিন নভোচারী- আর্মস্ট্রং, অলড্রিন আর কলিন্স। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি মহাকাশ বন্দর থেকে স্যাটার্ন ফাইভ রকেটে করে তাদের ওড়ানো হয়েছিল, ১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই। চারদিনের মাথায় অ্যাপোলো-১১ নভোযানে চেপে তারা পৌঁছে যান চাঁদের কক্ষপথে। চাঁদে নামার জন্য মূল নভোযান থেকে আলাদা হয়ে যান কমান্ডার নিল আর্মস্ট্রং ও অবতরকযানের পাইলট এডউইন বাজ অলড্রিন। ‘ইগল’ নামের অবতরকযানে চড়ে ১৩ মিনিটেই তারা ছুঁয়ে ফেলেন চাঁদের মাটি। কলিন্স কক্ষপথেই ঘুরতে থাকেন, অভিযান শেষে আর্মস্ট্রং আর অলড্রিনকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য। তারা ‘আপন বাড়ি’ পৃথিবীতে ফিরে এসেছিলেন ২৫ জুলাই।

মানুষকে মহাজাগতিক আলো দেখিয়েছিল যে কুকুর

মানুষেরও আগে মহাকাশ জয় করেছিল কুকুর। লাইকা নামের স্ত্রী কুকুরটি ১৯৫৭ সালের ৩ নভেম্বর পাড়ি জমিয়েছিল মহাকাশে। রাশিয়ার স্পুটনিক-২ মহাকাশযানে চড়ে মহাশূন্য ভ্রমণে বেরিয়েছিল লাইকা। পৃথিবীর ইতিহাসে লাইকার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ সত্যিকারার্থে ওই প্রথম পৃথিবীর কোনো প্রাণী মহাশূন্যে পাড়ি দিয়েছিল। সে হিসেবে পৃথিবীর ‘প্রথম নভোচারী’ হলো একটি কুকুর।

২০১৪ সালে লাইকার মহাকাশজয়ের ৫৭ বছরপূর্তিতে টাইম সাময়িকী এক অনলাইন প্রতিবেদনে ছবির ক্যাপশনে লিখেছিল, ‘রুশ নভোচারী কুকুর’। লাইকার অন্ধকার জীবনের গল্প তুলে ধরা হয় টাইমের ওই প্রতিবেদনে।

মহাকাশ কি মানুষের জন্য নিরাপদ? মহাকাশে ঝুঁকিমুক্ত ভ্রমণ মানুষের পক্ষে সম্ভব কি? এ ধরনের নানান প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর খুঁজতেই পরীক্ষায় ফেলা হয়েছিল লাইকাকে।

কোনো বড় বাড়ির পোষা কুকুর ছিল না লাইকা। সরকারি কোনো প্রশিক্ষণার্থীও ছিল না সে। সে ছিল রাস্তার অতি সাধারণ এক কুকুর, মস্কোর রাস্তা থেকে যাকে ধরে আনা হয়েছিল। স্পুটনিক-২ উড়াল দেওয়ার মাত্র ৯ দিন আগে লাইকাকে রাস্তা থেকে ধরা হয়। সে ছিল খুব শান্ত প্রকৃতির। আকারেও ছিল খুব ছোট। এই দুটি গুণের কারণে তাকে নভোচারী হিসেবে বেছে নিয়েছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন।

লাইকার আগে মহাশূন্যে পাড়ি দিয়েছে আরও অনেক কুকুর। তবে কোনোটাই মূল কক্ষপথে ভ্রমণ করেনি। মানুষের মধ্যে মহাকাশচারী প্রথম নভোচারী ইউরি গ্যাগারিন মহাকাশে যাত্রা করার আগে লাইকাসহ ৩৬টি কুকুর পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছিল। তবে লাইকাই প্রথম কুকুর (এবং প্রথম প্রাণী), যে কক্ষপথে ভ্রমণ করেছে।

তখন রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। রাশিয়া যখন মহাকাশে একের পর এক জয়যাত্রা ঘোষণা করছে, যুক্তরাষ্ট্রের তখন মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। কিছু ভেবে ওঠার আগেই নতুন নতুন পরিকল্পনা ঘোষণা করতে থাকে রাশিয়া। কক্ষপথে লাইকার ভ্রমণও ছিল অনেকটা তড়িঘড়ি পরিকল্পনা। তা না হলে মাত্র নয় দিনের মাথায়ই কেন কুকুরকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো মহাকাশে?

লাইকা, রাশিয়ার মহাকাশচারী কুকুর। ১৯৫৭ সালে

লাইকার ভ্রমণ এবং গণমাধ্যমে ভেংচি কেটে দেখা

লাইকার মহাকাশ ভ্রমণ নিয়ে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। ফলাও করে ছাপা হয়েছিল সেই খবর। তবে পশ্চিমা বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো প্রতিবেদনে ভেংচি কেটেছিল রাশিয়ার ওই উদ্যোগকে। মহাকাশযান (স্পুটনিক-২) ও কুকুরের নামকে (লাইকা) একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে পত্রিকাগুলো ওই অভিযানের নাম দিয়েছিল ‘পাপনিক’, ‘স্পুটপাপ’ ইত্যাদি। কুকুরের ইংরেজি পাপি ও স্পুটনিক মিলিয়ে ব্যঙ্গাত্মক এমন নাম; এ ধরনের শব্দকে পোর্টম্যান্টু শব্দ বলা হয়। ওই সময়ের টাইমের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোনো কোনো গণমাধ্যম অভিযানটির নাম দিয়েছিল পুচনিক (পুচ মানে কুকুর)। কেউবা লিখেছিল, উফনিক (উফ মানে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক)। সবশেষে তারা একটা নাম বেছে নিয়েছিল, আর তা হলো মাটনিক। গাড়ল বা মোটাবুদ্ধির কিংবা ‘বেজাত কুকুর’ বোঝাতে মার্কিনিরা ‘মাট’ কথাটা ব্যবহার করত। সেই ‘মাট’ আর স্পুটনিকের ‘নিক’ মিলিয়ে লাইকার মহাকাশযাত্রার নাম দিয়েছিল তারা মাটনিক।

নাম বিদ্রূপ ছাড়াও লাইকার সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়েও ধারাভাষ্য ছাপতে ভুল করেনি গণমাধ্যমগুলো। টাইম জানিয়েছে, ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ডেইলি মিরর তখন লিখেছিল, ‘কুকুরটা মারা যাবেই। আমরা তাকে বাঁচাতে পারব না।’ প্রাণিপ্রেমীরা সেদিন আন্দোলনে সরব হয়েছিল। নভোযানে কোনো প্রাণী পাঠানোকে তারা ‘অপরাধ’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। লাইকার মহাকাশযাত্রায় উল্লাস প্রকাশ করার বদলে এ ধরনের প্রতিবেদন ও আন্দোলনের প্রতিবাদে মুখ খুলতে হয়েছিল লন্ডনের তৎকালীন সোভিয়েত দূতাবাসকে। সোভিয়েত এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘রুশরা কুকুর ভালোবাসে। এটা কোনো নিষ্ঠুরতা বা নির্মমতার প্রতীক নয়। মনুষ্যজাতির কল্যাণেই এই অভিযান।’

চাঁদে যাদের পতাকা পৌঁছেছে

রাশিয়াই মহাকাশে প্রথম মানুষ পাঠিয়েছে- ইউরি গ্যাগারিন (১২ এপ্রিল, ১৯৬১) প্রথম মহাকাশচারী মানুষ, ভ্যালেনতিনা তেরেসকোভা (১৬ জুন, ১৯৬৩) প্রথম নারী মহাকাশচারী। এছাড়া চাঁদে সফলভাবে ইম্যাপাক্ট সৃষ্টিবকারী অভিযানেও প্রথম রাশিয়া। তাদের লুনা-২ চন্দ্রযান ১৯৫৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ইমপ্যাক্ট তৈরি করে চাঁদে। তবে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই নভোচারী নামাতে পেরেছে চাঁদে। তিন বছরে ছয় অভিযানে ১২ নভোচারী চাঁদের পিঠে নেমেছে। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া চাঁদে সফলভাবে নভোযান নামাতে পেরেছে ভারত  ও চীন। ২০১৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর চীনের নভোযান চ্যাংই-৩ সফলভাবে চাঁদে অবতরণ করে। ২০১৯ সালে তাদের চ্যাংই-৪ নভোযান নেমেছে চাঁদের দূরবর্তী অংশে, দক্ষিণ মেরুতে। চাঁদে ভারতের পতাকা পৌঁছায় ২০০৮ সালের ১৪ নভেম্বর। সেদিন চন্দ্রযান-১ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে ইমপ্যাক্ট তৈরি করে। ২০১৯ সালে ইসরায়েলের বেসরকারি উদ্যোগে ওড়ানো চন্দ্রযান বেরেশিট (হিব্রু এই শব্দের অর্থ ‘আরম্ভ’) চাঁদে অবতরণের সময় বিধ্বস্ত হয়ে যায়। বাংলাদেশের পতাকা উড়বে কবে চাঁদে?

চন্দ্রজয় ও গণমাধ্যম

চন্দ্রজয়ের প্রথম ইতিহাস সরাসরি টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছিলেন ৬৫ কোটি মানুষ। এর মানে, ওই সময়কার পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার পাঁচভাগের একভাগই চাঁদে পা ফেলার দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছিলেন। এছাড়া বেতার ও দৈনিকে তো সংবাদের সঙ্গে ছিলেন বহু শ্রোতা ও পাঠক।

চাঁদে অবতরণের দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচারের জন্য নাসা যে কয়েকটি টেলিস্কোপ ব্যবহার করেছিল, অস্ট্রেলিয়ার পার্ক টেলিস্কোপ তাদের একটি। এই টেলিস্কোপে তখন বেতার প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছিলেন ডেভিড কুক। তিনি বিবিসিকে সেই সময়ের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি জানিয়েছেন। তার ভাষায়: ‘আমার নাম ডেভিড কুক। ১৯৬৯ সালে আমি ছিলাম রেডিও রিসিভার ইঞ্জিনিয়ার। কাজ করতাম [অস্ট্রেলিয়ার] পার্কস রেডিও টেলিস্কোপে। [চাঁদে নামার ফুটেজ সম্প্রচারের ব্যাপারে] আমার মধ্যে কোনো ভয় ছিল বলে মনে পড়ে না। আমি শুধু ভাবছিলাম, চন্দ্রাবতরণের সময় আমার রিসিভার ঠিকঠাক কাজ করলেই হয়।

আমরা টেলিস্কোপটা চাঁদের দিকে তাক করলাম। যেমন কম্পাংকের সংকেত আসার কথা ছিল, ঠিক সেরকই সংকেত আসতে থাকল। এবং আমরা সেই চিত্রটা দেখতে পেলাম। মহাআনন্দ উথলে পড়ল যেন।

ওই সময় আমরা যদি ভাবতাম, কত বড় কিছু করতে যাচ্ছি, তাহলে আমরা হাল ছেড়ে দিতাম, কাজটাই ঠিক মতো আর হতো না। কিছুক্ষণ পরেই আমি টেলিস্কোপ থেকে দূরে যাই। এবং চাঁদের পানে চেয়ে দেখি। আর ভাবতে থাকি, ওই চাঁদে গেছেন তিনজন মানুষ যাদের দুজন নেমেছেন চাঁদের মাটিতে।’

ইতালির মিলানে টেলিভিশনে চাঁদে মানুষের পদার্পণ দেখছেন সাধারণ জনতা

তখন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সিস্টেম (সিবিএস) টেলিভিশনে সম্প্রচার সাংবাদিক (ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট) ছিলেন ওয়াল্টার ক্রনকাইট। ‘আ রিপোর্টাস লাইফ’ (১৯৯১) নামে তার জীবনীগ্রন্থে তিনি বলেছেন, ‘চাঁদে সেই প্রথম অবতরণ ছিল আমাদের সময়ের সবচেয়ে অনন্য-সাধারণ সংবাদ। মহাকাশ অভিযান যতটা স্মরণীয় ছিল, টেলিভিশনের জন্যও তা ছিল সমান স্মরণীয়।’ ওই সময় ক্রনকাইটের ডেস্ক সহযোগী ছিলেন মাইক রুশো। তিনি পয়েন্টারে এক লেখায় স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘চাঁদে অবতরণের দিন, ৩২ ঘণ্টা ধরে টেলিভিশন সম্প্রচার করা হয়। সে সময় এটা ছিল বিরতিহীনভাবে সবচেয়ে দীর্ঘ সরাসরি সংবাদ সম্প্রচার। কাভারাজজুড়েই ক্রনকাইট দর্শকদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘সবকিছু বাদ দিয়ে চেয়ে দেখুন, আমরা ইতিহাস গড়ছি।’

রুশোর দাবি, শুধু যুক্তরাষ্ট্রেরই নয় কোটি মানুষ সেদিন চন্দ্রজয়ের দৃশ্য টেলিভিশনে দেখেছিল। এর মধ্যে অর্ধেকই চোখ রেখেছিল সিবিএস নিউজে। আর এ কারণে, এমনকি চন্দ্রচারী আর্মস্ট্রং ও অলড্রিনের চেয়েও ‘সম্ভবত বেশি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন জাতীয় মুখ ক্রনকাইট’।  

ওই সময় নিউ ইয়র্ক ডেইলি নিউজে প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন মার্ক ব্লুম। তখন তার বয়স ৩০ বছর। অ্যাপোলো ১১-র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে তিনি উড়ে গিয়েছিলেন হাউসটনে যেখানে চাঁদে অবতরণের দৃশ্য সরাসরি দেখছিলেন বিজ্ঞানী, গণমাধ্যমকর্মী ও সাধারণ জনতা। তিনি স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘হঠাৎ কম্পিউটারে ১২০২ অ্যালার্ম বেজে উঠল। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না, এই সংকেতের কী মানে। এটা কি কম্পিউটারের কোনো গোলযোগ? নাকি চাঁদে নামার সিদ্ধান্ত শেষ মুহূর্তে বাতিল করতে বাধ্য হচ্ছেন নভোচারীরা?’ নাসা বহুবার সাংবাদিকদের এমন সংকেত বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে রাখলেও ব্লুম সেদিন কিছুতেই মনে করতে পারছিলেন না, ১২০২ অ্যালার্মের মানে আসলে কী। কিন্তু কিছু একটা ঝামেলা বেধেছে তা তিনি আঁচ করছিলেন। অবতরকযান কি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, মানে আর্মস্ট্রং আর অলড্রিন মারা গেছেন? মাইকেল কলিন্স কি তবে একাই ফিরে আসবেন পৃথিবীতে? ব্লুম বলেছেন, ‘একজন প্রতিবেদক হিসেবে আমার কাছে অ্যাপোলো-১১ অভিযানের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা বড় বিষয় ছিল না। যা-ই ঘটুক, ৩০ বছর বয়সে ওটাই আমার জন্য ছিল সবচেয়ে বড় স্টোরি।’ তিনি যোগ করেছেন, ‘অর্ধশত বছর পর কিছুই বদলায়নি। আজও আমি বড় স্টোরির জন্য অপেক্ষা করি।’

ওই সময়ও দিনে কয়েকটা সংস্করণ বের করত দৈনিকগুলো। নিউ ইয়র্ক ডেইলি নিউজের প্রথম সংস্করণে ব্লুমের লেখা প্রধান সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘হাউসটন, ম্যান ল্যান্ডেড অন দ্য মুন, টুডে।’

ওই সময় টেলিভিশনের পর্দায় অপলক চোখ রাখা বেশ কয়েকজন ব্যক্তি দ্য গার্ডিয়ানের কাছে স্মৃতিচারণ করেছেন। ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কেশায়ারের মারলিন ফেনটন বলেছেন, ‘মই বেয়ে আর্মস্ট্রং যখন [চাঁদে] নামছিলেন, আমরা দম বন্ধ করে দেখছিলাম। আমরা সবাই কেঁদেছি! আমরা ভেবেছিলাম, চাঁদে এমন অবতরণের পর এই পৃথিবীটা বোধকরি উন্নত বিশ্ব হবে।’ সারের বাসিন্দা ডেবি ব্রুক বলেছেন, ‘স্কুলের অ্যাসেম্বলি কক্ষে সবাই আমরা জড়ো হয়েছিলাম। তারা [আর্মস্ট্রং, অলড্রিন ও কলিন্স] যেন নিরাপদে ফিরতে পারে, সেজন্য আমরা প্রার্থনা করেছিলাম।’

দুটি মহাজাগতিক বস্তুর মুখোমুখি সংঘর্ষ। ধারণা করা হয় পৃথিবীর সঙ্গে গ্রহ থিয়ার সংঘর্ষে চাঁদের সৃষ্টি

ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ফাঁদে চাঁদজয়ের গৌরব

নানা ভিত্তিহীন গুজব আর ষড়যন্ত্র তত্ত্বের শিকার হয়ে অনেকে আজও সন্দেহ প্রকাশ করেন, আদৌ কি মার্কিন নভোচারীরা চাঁদে গিয়েছিলেন! অথচ আর্মস্ট্রং আর অলড্রিনই শুধু নন, মোট ১২ মার্কিন নভোচারী চাঁদের মাটিতে পা ফেলার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। অবশ্য ১৯৭২ সালের পর থেকে চাঁদে আর মানুষ পাঠায়নি, না যুক্তরাষ্ট্র আর না মহাকাশে তাদের প্রতিপক্ষ রাশিয়া, ইউরোপ কিংবা মহাকাশে অধুনা পরাশক্তি চীন ও ভারত।

মার্কিন লেখক বিল কেসিং চন্দ্রজয়ের গৌরবকে ম্লান করতে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ফেঁদেছিলেন। চাঁদে মানুষ পাঠানোর মতো শক্তি-সামর্থ তো নাসার নেই- লোকে তার এই কথায় বিশ্বাস করেছিল কারণ, তিনি নিজেও নাসার মহাকাশাভিযানে অংশ নিয়েছেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত স্যাটার্ন ফাইভ রকেটের নকশাকারী একটি কোম্পানির হয়ে চাকরি করতেন তিনি।

ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অংশ হিসেবে কেসিং একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করেছিলেন, ‘উই নেভার ওয়েন্ট টু দ্য মুন’ (আমরা কখনই চাঁদে যাইনি)। আর এ কারণে নানাবিধ অকাট্য প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও উনিশশ উনসত্তর থেকেই গুজবে বিশ্বাসীরা চাঁদে অভিযানকে ‘ভুয়া’ ভেবেই আসছে। আমি নিজেও বহুবার বহুজনের কাছ থেকে এই প্রশ্ন শুনেছি, ‘আচ্ছা, চাঁদে মানুষ না পাঠিয়েও কেন যুক্তরাষ্ট্র এমনটা দাবি করে?’ কিংবা, ‘তাহলে পতাকা কেন কাঁপছিল?’ ইত্যাদি প্রশ্নও ওঠে। খুব একটা জবাব দিতে ইচ্ছা করে না। কারণ, বারবারই মনে হয়, যিনি প্রশ্নটা করছেন, তিনি খেয়াল নিয়ে ভাবলেই তিনি সত্যটা আঁচ করতে পারবেন। এই লেখায় সেসব নিয়ে আলাপ করা যাক।

অবিশ্বাসের ‘যুক্তি’ খণ্ডন

অনেকে প্রশ্ন করেন, চাঁদের মাটিতে দাঁড়িয়ে অ্যাপোলো নভোচারীদের তোলা ছবিতে তো নক্ষত্রদের দেখা যায় না। চাঁদে কোনো বায়ু নেই। এর মানে চাঁদ থেকে আকাশ কালো দেখাবে। তাহলে অন্ধকার আকাশে ‘তারারা কেউ কোথায় নেই কেন?’

সহজ উত্তর, তারারা সেখানে আছে। কিন্তু দেখার জন্য তারা যথেষ্ঠ উজ্জ্বল নয়। যখন ছবি তোলা হয়, তখন বিষয়বস্তু কী সেই মোতাবেক ফোকাস (ক্যামেরার দৃষ্টিপাত) করা হয়। এই ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই নভোচারীরা নক্ষত্রদের ফোকাস করবেন না, সেটাই স্বাভাবিক।

তাহলে [মার্কিন] পতাকা কেন উড়ছিল? প্রশ্নের যুক্তি, যেহেতু চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই, বাতাসও তো থাকার কথা নয়। আসলে বাতাস ছিল না, আজও নেই। আর পতাকা পতপত করে উড়ছিল না। আসলে যখন পতাকা পোতা হয়, তখন ঝাঁকুনিতে যতটুকু নড়ার তা-ই নড়েছে।

‘তেজষ্ক্রিয় বেড়া’ কীভাবে ডিঙালো ওরা? এই প্রশ্নটাও কেউ কেউ করেন। বলা হচ্ছে, ভ্যান অ্যালেন বেল্টের কথা। এই তেজষ্ক্রিয় রশ্মি পৃথিবীকে ঘিরে আছে। কয়েক ঘণ্টায় ২০০ থেকে ১০০০ র‌্যাড পরিমাণ এই তেজষ্ক্রিয় রশ্মি লাগলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়বে।

অ্যাপোলো-১১ নভোচারীরা দুই ঘণ্টা মতো এই তেজষ্ক্রিয় বেস্টনির মধ্য দিয়ে গেছেন। এই সময়ে মাত্র ১৮ র‌্যাড তেজষ্ক্রিয় রশ্মিতে ‘পুড়েছিলেন’ তারা। এটা নিরাপদ সীমার মধ্যেই। ফলে তারা অসুস্থতা বোধ করেননি।

চাঁদের মাটিতে হাঁটছেন নিল আর্মস্ট্রং

প্রমাণে বিশ্বাস ফেরে যদি

মার্কিন বিজ্ঞান লেখক ইথান সিগল ফোর্বস সাময়িকীর অনলাইন সংস্করণে এক প্রতিবেদনে বলেছেন, আরও অনেকের মতো নাসার মনুষ্যবাহী ছয়টি চন্দ্রাভিযানই তার জন্মের আগে হয়েছে। কিন্তু তিনি শতভাগ নিশ্চিত এসব বাস্তবিক। বিশ্বাসের পক্ষে তার যুক্তিগুলো হলো:

ক. আমরা চাইলে আজও চাঁদে অ্যাপোলো প্রকল্পের প্রমাণাদি দেখতে পারি। কারণ সেখানে বায়ুমণ্ডল নেই। ফলে যে পদচিহ্ন রেখে এসেছেন নভোচারীরা, তা মুছে যাওয়ার কথা নয়। কেবল মাত্র অন্য কোনো অভিযানে ইমপ্যাক্ট (কিছু দিয়ে আঘাত) তৈরি করা ছাড়া সেইসব চিহ্ন অবিকল একই রকম থাকবে। আছেও। যার প্রমাণ অন্য চন্দ্রাভিযান থেকে পাওয়া গেছে। কিংবা চাইলে যে কেউ আবার নভোযান পাঠিয়ে প্রমাণ দেখে নিতে পারেন।

খ. অ্যাপোলো প্রকল্পের স্থিরচিত্র ও ভিডিওচিত্র থেকেও আমরা প্রমাণ পেতে পারি।

গ. যেসব বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি চাঁদে রেখে এসেছেন নভোচারীরা, সেসব দীর্ঘ বছর ধরে তথ্য পাঠিয়েছে। এমনকি কয়েকটি এখনও সক্রিয় ও কার্যকর রয়েছে।

ঘ. চাঁদ থেকে বেশ কিছু নমুনা আমরা নিয়ে এসেছি। সেসব নিয়ে গবেষণাও করেছি। এবং আমরা জানতে পেরেছে চাঁদের ভূতত্ত্ব আর এর সঙ্গে মানুষের ইতিহাসের যোগসূত্র সম্পর্কে।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়