ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মহাকাশ ভ্রমণে যুগান্তকারী যত প্রকল্প (শেষ পর্ব)

নিয়ন রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ১২ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মহাকাশ ভ্রমণে যুগান্তকারী যত প্রকল্প (শেষ পর্ব)

বহুকাল আগ থেকে ঘুরতে থাকা মহাকাশ গবেষণার চাকা বিংশ শতাব্দীতে এসে প্রবল বেগ পেয়েছে। মানুষ এখন মঙ্গল কিংবা চাঁদে উপনিবেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে। কেবল স্বপ্ন দেখছে বললে ভুল হবে, স্বপ্ন বাস্তবায়নে অনেকদূর এগিয়েও গেছে। পৃথিবীর কক্ষপথে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে বিজ্ঞানীরা স্বশরীরে কাজ করছে বছরের পর বছর, বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহে মানুষের তৈরি মহাকাশযান পাঠানো হচ্ছে নিয়মিত।

তবে এতদিন সরকারিভাবে বিশ্বের অনেক দেশ মহাকাশ নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করলেও, সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও মহাকাশে মানবজাতির পদক্ষেপে নেতৃত্ব নিতে শুরু করেছে।

সম্প্রতি বেসরকারি রকেট নির্মাতা সংস্থা স্পেস এক্স এমন একটি রকেট সিস্টেমের প্রটোটাইপ প্রকাশ করেছে যা মঙ্গলগ্রহে বাণিজ্যিকভাবে মানুষ পাঠানোর কাজে ব্যবহার করা হবে। ইতোমধ্যে স্পেস-এক্স বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে একটি মহাকাশ স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে।

মহাকাশ শুধু বিজ্ঞানীদের জন্য সীমাবদ্ধ না রেখে বরং বেসরকারি উদ্যোগে পর্যটন সুবিধা চালু করতে যুগান্তকারী কিছু প্রকল্প নিয়ে দুই পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে শেষ পর্ব।

ওরিয়ন স্প্যান বিলাসবহুল মহাকাশ স্টেশনের পরিকল্পনা করছে

ছয়জন মানুষ ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ‘অরোরা’ নামে মাঝারি আকারের একটি মহাকাশ স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ওরিয়ন স্প্যান। এই স্টেশনে চারজন দর্শনার্থী এবং দুইজন ক্রু থাকবে। ওরিয়ন স্প্যানের তৈরি এই মহাকাশ স্টেশনে তারাই যেতে পারবে যারা মাত্র ১২ দিনে নির্দ্বিধায় ৯.৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে পারবে। এই স্টেশনটির প্রস্থ হবে ১২ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ৩৫ ফুট। ব্যক্তিগত স্লিপিং পড, বিলাসবহুল সজ্জা এবং সারাক্ষণ মহাকাশ দেখার সুবিধার্থে থাকবে কাঁচের দেয়াল। হানিমুনে যাওয়ার নতুন গন্তব্য হতে পারে বিলাসবহুল এই মহাকাশ স্টেশন।

অরোরা নির্মাণে বাজেট নিয়ে এক চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন ওরিয়ন স্প্যান এর সিইও ফ্রাঙ্ক বাঞ্জার। তিনি বলেন, ‘শত শত মিলিয়ন ডলার লাগবে না, অরোরা’র একটা সিঙ্গেল মডিউল তৈরি করতে মাত্র ৬৫ মিলিয়ন ডলার খরচা হবে আমাদের।’

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে অরোরার ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। কোম্পানিটি ক্রাউড ফান্ডিং এর মাধ্যমে ২ মিলিয়ন ডলার উত্তোলনের জন্য ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেছিল। কিন্তু সেই ক্যাম্পেইনে মাত্র ১০ ভাগ সফলতা পেয়েছে তারা।

ইনফ্ল্যাটেবল স্পেস স্টেশন তৈরির পরিকল্পনা করছে বিগ্লো

মহাকাশে নিজস্ব উপায়ে ইনফ্ল্যাটেবল স্পেশ স্টেশন তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বিগ্লো। ইতোমধ্যে তাদের তৈরি একটি ইনফ্ল্যাটেবল মডিউল আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে স্থাপনের জন্য সম্পূর্ণরূপে তৈরি আছে।

১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সফল মহাকাশ গবেষণা সংস্থা বিগ্লো দীর্ঘদিন যাবত পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে কাজ করছে। পাশাপাশি তারা তাদের তৈরি ইনফ্ল্যাটেবল মডিউলগুলো নিয়ে বিস্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। এই মডিউলগুলো নরম এবং সহজেই প্রসারণযোগ্য উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। খুবই হালকা এই মডিউলগুলো রকেট লঞ্চিংয়ের সময় ছোট জায়গায় প্যাক করে রাখা যাবে এবং নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছার পর খুব সহজেই প্রসারিত করা যাবে। কেভলারের মতো উপাদান দিয়ে তৈরি এই মডিউলগুলো প্রচলিত মহাকাশ স্টেশনের প্রযুক্তির মতোই শক্তিশালী এবং মজবুত। বিগ্লো এই প্রসারণযোগ্য মডিউলের ধারণা নাসার কাছ থেকেই পেয়েছিল। মূলত আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ব্যবহারের জন্য একটি মডিউল তৈরির জন্য বিগ্লোর সহায়তা নিয়েছিল নাসা।

বিগ্লোর তৈরি একটি ইনফ্ল্যাটেবল মডিউল দুই বছর ধরে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের উপর দিয়ে উড়ে চলছে। বিগ্লো এখন বাণিজ্যিক কর্মকান্ড পরিচালনা এবং মহাকাশ পর্যটনের জন্য একটি ব্যক্তিগত মহাকাশ স্টেশন নির্মাণের কাজ করছে। বর্তমানে সংস্থাটি ইনফ্ল্যাটেবল বি৩৩০ মডেলের মহাকাশ স্টেশনের প্রচারণা চালাচ্ছে। চারজনের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই স্টেশনে দুটি গ্যালারি, দুটি টয়লেট, বড় কার্গো স্পেস এবং দুটি প্রপোলেশন (নিয়ন্ত্রণ প্যানেল) সিস্টেম বিদ্যমান থাকবে।

‘এ স্পেস অডিসি’ সিনেমার আদলে ঘূর্ণয়মান স্পেস স্টেশন নির্মাণ করতে চায় গেটওয়ে

সম্প্রতি গেটওয়ে ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থা এক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তারা ২০০১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘এ স্পেস অডিসি’ সিনেমার আদলে মহাকাশে ‘ভন ব্রাউন’ নামে বিশাল এক ঘূর্ণায়মান স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। নাগরদোলা আকৃতির এই মহাকাশ স্টেশনটির ব্যাস হবে ১৬০০ ফুট (অর্থাৎ প্রায় আধ কিলোমিটার), প্রায় ১২ মিলিয়ন ঘনমিটার চাপ নিতে সক্ষম হবে এবং ভেতরে থাকা যন্ত্রপাতি এবং মানুষকে মাধ্যাকর্ষণ সরবরাহের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ঘূর্ণন তৈরি করতে পারবে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন যেখানে মাত্র ৩২,৩৩৩ ঘনমিটার চাপ নিতে সক্ষম সেখানে প্রায় ১০০ গুণের বেশি চাপ নেওয়ার সক্ষমতা নিয়ে তৈরি হবে ভন ব্রাউন।

এই স্পেস স্টেশন নির্মাণকেই মূল লক্ষ্য ধরে কাজ করে যাচ্ছে গেটওয়ে ফাউন্ডেশন। অনেকেই ভাবছেন, আগের কয়েকটি ব্যর্থ উচ্চাভিলাষী প্রজেক্টের মতো এই প্রজেক্টটিও ব্যর্থতার তালিকায় নাম লেখাবে। কিন্তু গেটওয়ে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িংয়ের কাজ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। সংস্থাটি আরো জানিয়েছে, দুই ডজন বিগ্লো বি৩৩০ ইনফ্ল্যাটেবল মডিউল ব্যবহার করে স্টেশনটি নির্মাণ করা সম্ভব। এছাড়া তারা পৃথিবীর কক্ষপথে কাজ করার জন্য যথাযথ অনুমতি পত্র এবং কক্ষপথের নির্দিষ্ট জায়গার জন্য আবেদন করে বরাদ্দও পেয়ে গেছে।

শিপিং কন্টেইনারের আদলে ছোট স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য কাজ করছে অ্যারোস্পেস

১৯৬০ সালের দিকে সর্বব্যাপী শিপিং কন্টেইনারের ব্যবহার শুরু হলে জাহাজে পণ্য লোডিং আনলোডিংয়ে আমূল পরিবর্তন আসে। ফলস্বরূপ বিশ্ব অর্থনীতিতে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা হয়। অ্যারোস্পেস কর্পোরেশন শিপিং কন্টেইনারের আদলে ছোট স্যাটেলাইটগুলোর জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড ‘লঞ্চ ইউনিট’ প্রস্তাব করেছে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে এটি এক অভাবনীয় পরিবর্তন আনবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মহাকাশে উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়াটি এখনও অনেক জটিল একটি প্রক্রিয়া। একটি বিবৃতিতে অ্যারোস্পেস কর্পোরেশন বলেছে, রেফ্রিজারেটর সাইজের একটি স্ট্যান্ডার্ড লঞ্চ ইউনিট তৈরি করার মাধ্যমে সহজে এবং কম খরচে মহাকাশে ছোট স্যাটেলাইটগুলো উৎক্ষেপণ সম্ভব হবে।

২০২০ সালে চাঁদে লুনার ল্যান্ডার পাঠানোর পরিকল্পনা করছে মুন এক্সপ্রেস

চাঁদে একটি রোবটিক স্পেসক্রাফট অবতরণ করে ৫০০ মিটার ভ্রমণ করতে এবং ভ্রমণের হাই ডেফিনেশন ভিডিও পৃথিবীতে পাঠাতে পারে এমন একটি প্রজেক্টের প্রতিযোগিতায় জন্য ২০০৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গুগল প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলারের পুরস্কার স্পন্সর করেছিল। বেশ কয়েকটি দল এই প্রজেক্ট সম্পন্ন করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গুগল সেই প্রতিযোগিতাটি বাতিল করে।

মুন এক্সপ্রেস সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে একটি। তাদের তৈরি ল্যান্ডারটি ২০২০ সালের জুলাইয়ে চাঁদের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। এটি চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে পানির উপস্থিতি অনুসন্ধান করবে।

আশা করা যায় যে, এটি ভারত কিংবা ইসরায়েলি মহাকাশ সংস্থার পাঠানো ল্যান্ডারগুলোর মতো করুণ পরিণতি ভোগ করবে না।

মাত্র আধঘন্টায় যাত্রীদের পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে পৌঁছে দিতে পারে এমন স্টারশিপ বানাচ্ছে স্পেস এক্স

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নিয়মিত সাপ্লাই সরবরাহ, চাঁদের চারপাশে অ্যাপোলো-৮ স্টাইলে মিশন পরিচালনা, পুনরায় ব্যবহার উপযোগী রকেট নির্মাণ, মঙ্গলগ্রহে আবাসনের কাজ পুরোদমে এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি সংস্থাটি নিয়মিত রুটিন ফ্লাইট পরিচালনার জন্য দ্রুতগতির স্টারশিপ সিস্টেম তৈরির উদ্দেশ্যে কাজ করছে। এই স্টারশিপটি এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যাতে মাত্র আধঘন্টায় পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। স্পেস এক্স প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক ২০১৭ সালে প্রথম এই পরিকল্পনার কথা জানান।

আশা করা যাচ্ছে ২০২০ সালের শেষের দিকেই আপনি নিউইয়র্ক থেকে বিমানে উঠার ৩০ মিনিট পর প্যারিসে পৌঁছে যেতে পারবেন। অথবা লন্ডন থেকে হংকং পৌঁছে যেতে পারবেন মাত্র ৩৪ মিনিটে। ইলন মাস্ক বলেন, এই স্টারশিপে করে ভ্রমণের সবচেয়ে মজার ব্যাপারটি হবে ডিজনি স্পেস মাউন্টেনের মতো এর ভেতর থেকে আপনি পৃথিবীর বক্রতা স্পষ্টতই দেখতে পাবেন।

পড়ুন :


ঢাকা/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়