ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

নিয়ন্ত্রণহারা চীনের রকেট: যে কারণে ভয় নেই 

জাহাঙ্গীর সুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:১০, ৮ মে ২০২১   আপডেট: ২০:২৫, ৮ মে ২০২১
নিয়ন্ত্রণহারা চীনের রকেট: যে কারণে ভয় নেই 

‘কেন, ভয় কিসের?’
না, এ প্রশ্ন ‘রক্তকরবী’র নন্দিনীকে ‘নেপথ্যে’র পাল্টা প্রশ্ন নয়। একটা রকেট নাকি নামার সময় ভেঙেচুরে গেছে, নিয়ন্ত্রণও করা যাচ্ছে না- কোথায় যে (আছড়ে) পড়ে, কার ওপর পড়ে- সহকর্মীর এমন উদ্বিগ্ন জিজ্ঞাসার মুখেও ছিল আমার ভয়-তাড়ানো প্রতিপ্রশ্ন।

তো, রকেটটা যেহেতু চীনের, আর খবরটা যেখান থেকে আমরা পাচ্ছি, তা হলো পশ্চিমা গণমাধ্যম, সেই কারণে ভীতি-নীতির অতিরঞ্জন অস্বাভাবিক নয়; আতঙ্কের অঙ্কটা বেশ বড়ই।
‘মানে, রকেটটা আমার মাথার ওপর পড়বে কি?’
বললাম, ‘আপনার মাথার ওপরই পড়বে কি না বলতে পারি না, তবে পড়তে যে পারে সেই সম্ভাবনা (পড়ুন, আশঙ্কা) উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে, সেই আশঙ্কা অনেক ক্ষীণ।
‘তারপরও কতটা ভয় আছে?’

এই উত্তরটা পাওয়া যাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোনাথন ম্যাকদোয়েলের টুইটার থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের হাভার্ড-স্মিথসোনিয়ানের এই গবেষক টুইট করেছেন: ‘আপনি যদি পৃথিবীর ২৫০ লক্ষ কোটি বর্গমিটারের মধ্যে একটি ভুল বর্গমিটারে অবস্থান করেন, তাহলে তো বিধি বাম! নচেৎ, আরামে থাকুন।’
মানে, কয়েকশ লক্ষ কোটি মানুষে পুরো পৃথিবীর প্রতিবর্গমিটার ঠাসা থাকলে, একজনের মাথায় এমন মহাকাশ-বর্জ্য পড়ার ঝুঁকি থাকত।

বলাবাহুল্য, পৃথিবীর তিন ভাগ জল। আর যেটুকু স্থল আছে, এর বেশিরভাগই জনমানবহীন। চ্যাং ঝেং ৫বি (লং মার্চ ৫বি) নামের রকেটটির কেন্দ্রভাগ ঠিক কোথায় পড়বে, এটা নির্ভর করছে কখন পড়বে, এই উত্তরের ওপর। শনিবার সকালে এ লেখাটি তৈরির সময় এটি প্রতি নব্বই মিনিটে পৃথিবীতে একবার পাক খাচ্ছিল। প্রতিঘণ্টায় গতি ছিল ২৯ হাজার কিলোমিটার। কিন্তু পাক খেতে খেতে সে পৃথিবীর উপরিস্তরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় গতি হারাচ্ছিল এবং নিচের দিকে নামছিল। ফলে, তার কক্ষপথ ছোট হয়ে আসছে। কিন্তু রকেটের নিয়ন্ত্রণহারা কেন্দ্রভাগ কী হারে গতিহারা হবে, এটা বেশ কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এবং সে বিষয়গুলোর মান, মোটা দাগে বলতে গেলে, অজানা।

তারপরও, সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত থেকে মার্কিন লেখক নদিয়া ড্রেকের অনুমান, নিউ ইয়র্ক সিটি থেকে অনেক অনেক উত্তরে এবং নিউ জিল্যান্ডের মতো অনেক দক্ষিণের কোনো অঞ্চলে রকেটের কেন্দ্রভাগটি আছড়ে পড়তে পারে|

তবে কোন সময়ে আছড়ে পড়বে, সেটিই বড় বিষয়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের প্রতিবেদনে ড্রেক যেমনটা লিখেছেন, আধা ঘণ্টার কমবেশি হলে ইলিনয় থেকে অর্ধেক পৃথিবী দূরে কোথাও জায়গা করে নেবে রকেটের ধ্বংসাবশেষ।

ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশ সময় ৮ মে সন্ধ্যা ৮টা থেকে ৯ মে রাত ৯টার মধ্যে যে কোনো সময় (বা, অন্য কোনো সময়) ধ্বংসাবশেষ জলে হোক, স্থলে হোক আছড়ে পড়বে। প্রায় ২২ মেট্রিক টনের কেন্দ্র ভাগটির কতটুকু টিকে থাকবে, এও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে, বেশিরভাগ অংশই বায়ুমণ্ডলেই বিনাশ হয়ে যাবে।

চীন নতুন মহাশূন্য কেন্দ্র কক্ষপথে স্থাপনের জন্য প্রথম মডিউলিটি ২৯ এপ্রিল রকেটটিতে উৎক্ষেপণ করে। সফল উৎক্ষেপণের পর কেন্দ্রভাগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মডিউল থেকে। এরপর থেকেই পৃথিবীতে পাক খাচ্ছে সেটি। এবং চীন মূলভূমি থেকে একে নিয়ন্ত্রণও করতে পারছে না।

শুধু করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ে নয়, সব ক্ষেত্রেই চীনের শত্রু রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র। তারা ৪ মে জানায়, মার্কিন মহাকাশবাহিনী নিয়ন্ত্রণহীন রকেটিটর কেন্দ্রভাগের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। তবে, আকাশেই একে আঘাত করে ধ্বংস করার কোনো পরিকল্পনা নেই বলে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে।

এ নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোয় ফলাও করে প্রতিবেদন প্রচার হচ্ছে। স্বীকার করতে হয়, এ প্রতিবেদনও সেই অতিপ্রচারের একটা অংশ বটে। কিন্তু বেশিরভাগ প্রতিবেদনে যেভাবে ভয় প্রচার করা হচ্ছে, এটি তার উল্টো।

মাত্র এক বছর আগেই (২০২০ সালে, এই মে মাসেই) চীনের এই রকেটই পুনঃপ্রবেশের সময় নিয়ন্ত্রণহারা হয়ে গিয়েছিল। আটলান্টিক মহাসাগরে পড়েছিল। কিন্তু ধাতব ভগ্নাবশেষ (প্রায় ৩৩ মিটার লম্বা) আছড়ে পড়েছিল আফ্রিকার আইভোরি কোস্টে, স্থলভাগে। অবশ্য কোনো মানুষ তাতে হতাহত হয়নি। এ কারণে, বিবিসিকে ম্যাকদোয়েল বলেছেন, ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মহাশূন্য কেন্দ্র অনিয়ন্ত্রিতভাবে আছড়ে পড়ার পরবর্তীকালে চীনের এ দুটো রকেটের নিয়ন্ত্রণহারা পুনঃপ্রবেশ থেকে বোঝা যায় ‘এ বিষয়ে অবহেলা করা হচ্ছে’।

২০১৬ সালে নিজেদের প্রথম মহাশূন্য কেন্দ্র তিয়ানগং ১-এর নিয়ন্ত্রণও হারিয়ে ফেলেছিল চীন। ২০১৮ সালে সাড়ে আট টনের মহাশূন্য কেন্দ্রটি বিধ্বস্ত হয়েছিল প্রশান্ত মহাসাগরে। কিন্তু ১৯৯১ সালে কি সোভিয়েত মহাশূন্য কেন্দ্র স্যালিয়াট ভেঙে পড়েনি আর্জেন্টিনার আকাশে? ২০০১ সালে রুশ মহাশূন্য কেন্দ্র মির-এর হাজার দেড়েক ভগ্নাবশেষ পড়েছিল ফিজির কাছে, সমুদ্রে।

এই তো এ বছর মার্চেই কয়েক টন ভরের স্পেসএক্সের ফ্যালকন ৯ রকেটের ধ্বংসাবশেষ ওয়াশিংটন স্টেটের এক খামারে আছড়ে পড়েছিল।আঘাতে চার ইঞ্চি গর্ত হয়ে গিয়েছিল খামারের জমিতে। এমনকি, নাসার নিয়ন্ত্রণহীন ৭৫ টন ভারী স্কাইল্যাবের ধ্বংসাবশেষ তো বৃষ্টির মতো আছড়ে পড়েছিল পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার এসপারেন্স শহরে। আর মাত্র নয়দিন পর পার্থে বার্ষিক মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতার মঞ্চে সেই ধ্বংসাবশেষ প্রদর্শন করা হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ান ট্রাভেলার ডটকম তো এক প্রতিবেদনে লিখেছে, সেই ধ্বংসাবশেষের কাছে সেবারের ‘সুন্দরী’রা মলিন হয়ে গিয়েছিলেন।

এরপর ২০০৩ সালে, নিজেদের মহাশূন্যযান কলাম্বিয়া কি পুনঃপ্রবেশের সময় যুক্তরাষ্ট্রেই আছড়ে পড়েনি? এরও পর, ২০১১ সালে নাসার বায়ুর উপরিমণ্ডল গবেষণা উপগ্রহ আছড়ে পড়েছিল প্রশান্ত মহাসাগরে। তাহলে, চীনের বেলায় পশ্চিমা গণমাধ্যমে এত বেশি আতঙ্ক-ছড়ানো কেন? এও কি কোনো মহাকাশ-রাজনীতির ব্যাপার?

২০১৯ সালে এমন প্রশ্ন করেছিলাম চীনা বংশোদ্ভূত মার্কিন জ্যোতিঃপদার্থবিদ ইয়ে কুয়ানচিকে। তার সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল চাঁদের অচিন পিঠে সফলভাবে চীনের চ্যাং ই ৪ চন্দ্রযানের সফল অবতরণের পরপরই। উত্তরে ইমেইলে এই বিজ্ঞানী বলেছিলেন, ‘মহাকাশ অভিযান যে জাতীয় গর্বের একটা অংশ, এ আর গোপন কথা নয়। মহাকাশ অভিযান ক্ষমতা প্রদর্শনের একটা পথও বটে। ইচ্ছাকৃত হোক অনিচ্ছাকৃত হোক, আমি তো বলব, সব ধরনের অভিযানেরই একটা রাজনৈতিক অর্থ আছে।’

কুয়ানচি মনে করিয়ে দেন, ‘হয়তো পনের শতকেও ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা নতুন স্থলভাগ আবিষ্কারমাত্রই পতাকা ওড়াতেন। চ্যাং ই ৪ এবং অন্য যে কোনো আন্তঃগ্রহ অভিযানগুলো নিজ নিজ দেশের জাতীয় পতাকা বহন করে।’

তবে আশাবাদী কুয়ানচি বলেন, ‘স্নায়ুযুদ্ধের পর মহাশূন্য অভিযানগুলো [রাজনীতির চেয়ে] বিজ্ঞানের দিকে বেশি মনোযোগী, এটা অবশ্য বলতেই হয়। এক্ষেত্রে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ছে। এটাই ভালো খবর।’ 
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়