ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

যেভাবে দেশীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করল বিশ্বমানের ভিডিও কনফারেন্স প্ল্যাটফর্ম

প্রকাশিত: ২১:৩৩, ২৪ নভেম্বর ২০২১   আপডেট: ২১:৩৩, ২৪ নভেম্বর ২০২১
যেভাবে দেশীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করল বিশ্বমানের ভিডিও কনফারেন্স প্ল্যাটফর্ম

বাসায় বসে অফিস! এ কেমন কথা। কীভাবে সম্ভব? দুই বছর আগেও এমন প্রশ্ন ছিল মানুষের মনে। আবার অফিসে গিয়েই কাজ করতে হবে এই রীতি বাধ্যতামূলক থাকলেও করোনা পাল্টে দিয়েছে সেই রীতি। পরিবর্তন করে দিয়েছে মানুষের জীবনযাপন।

বাড়িতে বসে কাজ করা মানেই যে খুশি তা কিন্তু নয়। করোনাভাইরাসের কারণে হোক বা অন্য কারণেই হোক, বাড়ি থেকে কাজের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিষ্কার যোগাযোগ ব্যবস্থা। আপনার ব্যবস্থাপক যেমন অফিসে সব সময় আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে, বাড়ি বসে কাজের ক্ষেত্রেও তাই হওয়া উচিত। সেই ভাবনা থেকেই দেশের প্রযুক্তি খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান সিনেসিস আইটি পরিষ্কার যোগাযোগ ও বাহিরের শব্দমুক্ত ভার্চুয়াল অফিস কোলাবোরেশন প্ল্যাটফর্ম ‘কনভে’ নিয়ে আসতে যাচ্ছে। আগামী বছরের প্রথম প্রান্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হবে প্ল্যাটফর্মটির। 

আরএনএন বেইজড নয়েজ সাপ্রেশন সিস্টেম কনভে গড়ে তোলার ধারণা ও চ্যালেঞ্জ-এর গল্প নিয়ে কথা বলেছেন সিনেসিস আইটির গ্রুপ সিইও রূপায়ন চৌধুরী। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে আমি যখন অস্ট্রেলিয়া চলে আসি, আসার পর পরই সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ি টিমের সদস্যদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ নিয়ে, কিভাবে আরও ভালোভাবে আমার প্রতিটা টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রকল্পগুলোকে ভালোমতো শেষ করা যায়। সেই সময় থেকে আমরা জুমের ব্যবহার শুরু করি। আমাদের সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের প্রধান শাহজালালও ওই সময় এক বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়। পুরো টিম বাধ্য হয়ে রিমোট কোলাবোরেশন ব্যবহার করতে শুরু করি। মহামারির আগে থেকে সিনেসিস ভিডিও কনফারেন্সিং এর ব্যবহার শুরু করে। তখন থেকে আমরা বুঝতে পারি এই রিমোট কোলাবোরেশন এখনো নতুন, এখানে অনেক কিছু দরকার। এই ইনোভেশন নিয়ে আমাদের মধ্যে চিন্তা শুরু হতেই চলে আসে মহামারি। জুম একেবারে মানুষের ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল, সঙ্গে জনপ্রিয় হওয়া শুরু করল অন্য কোলাবোরেশন টুলগুলোও। আমরা দেখতে থাকলাম এই টুলগুলো এখনো অনেক কিছু দিচ্ছে না। 

পরবর্তীতে ২০২০ এর শুরুতে আমাদের কিছু প্রেডিকশন ছিল সামনের দিকে রিমোট কোলাবোরেশন কি রকম হবে, কি ইনোভেশন আসবে। আমাদের খুব ভালো লাগে সেই প্রেডিকশন এখন সত্য হতে দেখে। কিছু সাধারণ সমস্যার অসাধারণ সমাধান নিয়ে আমাদের ইনোভেশন ‘কনভে’। প্রায় তিনটি মহাদেশের চারটি দেশ থেকে শুরু হয় এর উদ্ভাবন প্রক্রিয়া। চার দেশের মানুষজন এই ইনোভেশনে কাজ করছে। 

একটু বলে নিই, কনভে মূলত একটি ভার্চুয়াল কোলাবোরেশন সিস্টেম যেখানে ভিডিও কনফারেন্সিং, বিভিন্ন কোলাবোরেশন টুলস ও ভিজ্যুয়াল বোর্ডের সমন্বয়ে কর্মীদের মধ্যে খুবই কার্যকরী যোগাযোগ গড়ে তোলা যাবে। এই প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে তথ্য নিরাপত্তায় যা জুমের একটা বড় দুর্বলতা। কনভে-তে এমন অনেক ফিচার রাখা হয়েছে, যা এখনো কোনো ভিডিও কনফারেন্স প্ল্যাটফর্মে নেই। কনভে তৈরি করা হয়েছে গ্লোবাল মার্কেটের জন্য। এখন অনেক দেশে ডাটা রেসিডেন্সি আইন আছে, এটার সফটওয়্যার আর্কিটেকচার দাঁড় করাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। আমাদের জানা মতে, এখন শুধুমাত্র ‘স্ল্যাক’  এই সার্ভিসটি দেয়। 

কনভে তৈরির নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি বলেন, আমরা কনভে এর শুরুতে বিপদে পড়ি ভিডিও কনফারেন্সিং এ, ২০/৩০ জনের বেশি মিটিং করতে পারি না, প্রচুর শব্দ আসে যা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এরপর আমাদের গবেষণা শুরু হয়। যেহেতু নয়েজ ক্যানসেলেশন আমাদের উদ্দেশ্য না, আমরা অন্য কোম্পানির সলিউশনস দেখতে থাকি। বিশ্বের এক নম্বর কোম্পানির খোঁজ পাই। জুম, গুগল, সিসকো সবাই এই কোম্পানির সলিউশনস ব্যবহার করে। যোগাযোগ করলাম। তাদের সেলস বিভাগের একজন যোগাযোগ করল। বলল, ‘আমরা এই সেবা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।’ আমরা আবার গবেষণা শুরু করি। ডিজিটাল সিগন্যাল প্রসেসিং এর ফিল্ডটা এত বড় আমরা হিমশিম খেতে থাকি। কিছুদিন পর সেই এক নম্বর কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করি। একটা ই-মেইল দিলে ১০ দিন পর উত্তর দেয়। আমার বিশ্বাস, যেহেতু শেষ গুগলকে দিয়েছে আমাদেরকেও দিবে, হাল ছাড়ি না। এদিকে আমাদের গবেষণাও চলতে থাকে। এক পর্যায়ে আমরা একটা টেকনিক আবিষ্কার করি, যা দিয়ে একটা পর্যায় পর্যন্ত ভালো মিটিং করা যায় কিন্তু জুমের যে এক্সপেরিয়েন্স সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। 

কয়দিন পর আবার সেই কোম্পানিকে ই-মেইল করি। আবারও একই উত্তর। এদিকে আমাদের গবেষণা এগুতে থাকে। দিশা পাই না। একদিন না পেরে ভাবছি শেষ ই-মেইল লিখি। দিলাম ৫ লাইনের একটা ই-মেইল, নিজেদের স্বপ্নের কথা। একদিনের মাথায় উত্তর এলো, একটা মিটিং এর শিডিউল দিয়ে। 

মিটিংয়ে আসলো সিলিকন ভ্যালির সেই কোম্পানির সেলসের একজন। একটু পরে যোগ দিলেন আরেকজন সিনিয়র। বুঝতে পারলাম খুব সিনিয়র একজন হবে। নামটা লিংকডইন’এ সার্চ দিলাম, এত বড় কোম্পানির সিওও আমার জুমে। নয়েজের জগতে অদ্বিতীয়। খুবই বিনয়ী। আমার কাছে আমাদের সম্পর্কে জানতে চাইল। আমাদের স্বপ্নের কথা বললাম। গল্প শুরু হয়ে গেল। অনেক ইনসাইট দিল। একদম শেষে বলল, ‘তোমাদের আইডিয়া বেশ ভালো। দেখো আমাদের ডিমান্ড এত বেশি আমরা মিট করতে পারছি না। তোমাকে না বলছি না। তুমি শুরু করো। একটা ইউজার বেইজ চলে আসলে আমরা তোমার সঙ্গে পার্টনারশিপ করব।’

মনটা খারাপ হয়ে গেল। পরদিন সকালে টিম নিয়ে বসলাম। বললাম আমাদের নয়েজ ক্যানসেলেশন আমাদের তৈরি করতে হবে। আমাদের আর উপায় নেই।

বেশ কয়েক মাস পরে সিনেসিসের কয়েকটি টিমে আমাদের কনভে ভিডিও কনফারেন্সিং পরীক্ষণমূলকভাবে ব্যবহার শুরু হয়। আমাদের হোম অফিস শেষ। আমাদের অফিসের লোকজন তাদের ডেস্ক থেকে বসে কনভে মিটিংগুলো করে। নয়েজ একেবারে শুনা যায় না। শেষদিন আমাদের হেড অব সেলস মুনাজিলের সঙ্গে মিটিং করছিলাম। উনি সিনেসিসে উনার ডেস্ক থেকে ফোন করেছিল। পাশে অনেক নয়েজ ছিল। কিন্তু কনভে-তে মিটিং হচ্ছিল একদম নীরবতায়, কোনো নয়েজ নেই। তাকে একটু তাক লাগাবার জন্য বললাম, চলেন একই পরিবেশে জুমে মিটিং করি। সেখানে নয়েজে কথা বলা যাচ্ছে না। সে অবাক হয়ে বলল, ‘ভাইয়া আমাকে এখনই কনভে বিক্রি করার জন্য দেন। এতো অনেক ভালো না শুধু, সিম্পলি অসাধারণ।’

নিজেদের গবেষণার আমাদের আরএনএন বেইজড নয়েজ সাপ্রেশন সিস্টেম। বানানোর ইচ্ছা ছিল না, এই ইনোভেশন আমাদের বাধ্য হয়ে আনতে হয়েছে।

কনভে- এর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে অনায়াসে একসঙ্গে ৩০০ জনের মিটিং করা যাবে। আমাদের লক্ষ্য ১২০০ জনের মিটিং হবে কনভে-তে। পরীক্ষণমূলকভাবে সিনেসিসের কয়েকটি টিম কনভে ব্যবহার করছে। আগামী বছরের প্রথম প্রান্তিকে সীমিত কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্য মার্কেটে আসবে কনভে। আরও অনেক পথ বাকি আমাদের, যেতে হবে বহুদূর।

ঢাকা/ফিরোজ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়