ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

আমি আর মাশরাফি ছিলাম ফিয়ারলেস: তাপস

কামরুল ইসলাম ইমন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ৬ মে ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমি আর মাশরাফি ছিলাম ফিয়ারলেস: তাপস

১৮ জুন ২০০৫, বিদেশ বিভুঁইয়ে কার্ডিফের মাঠে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে মাটিতে নামিয়ে আনলো টিম বাংলাদেশ। সে ম্যাচে আশরাফুলের সেঞ্চুরিতে জয়ের ক্যানভাস রঙিণ হলেও শুরুতে বল হাতে তুলির আঁচড় দিয়েছিলেন তাপস বৈশ্য। ডানহাতি এই পেসার অজি তিন সেরা ব্যাটসম্যান রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্ক ও ড্যামিয়েন মার্টিনকে ফিরিয়ে আটকে রেখেছেন রানের লাগাম। ছিলেন দলের সেরা বোলার।

৫ বছরের ছোট ক্যারিয়ারে এমন অসাধারণ সব কীর্তি গড়েছেন দলের জন্য। মাশরাফির সঙ্গে বোলিংয়ে জুটি বেঁধে লাল-সবুজকে দিয়েছেন অনেক সুখস্মৃতি। বাংলাদেশের অনেক প্রথম জয়ের ভাগীদার হতে পেরেছেন। এর মধ্যে ইতিহাস হয়ে থাকা বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ের অংশীদার হতে পারাকে মানেন ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত হিসেবে। মাত্র ৭৭টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে টাইগার জার্সি গায়ে জড়িয়েও নেই কোনো আক্ষেপ। বরং ক্যারিয়ারের ৭২০ রান ও ৯৫ উইকেটের জন্য গর্ব আছে তাঁর। বিশ্বাস করেন ক্রিকেট ছিল বলেই আজকে তাপস হতে পেরেছেন তিনি।

১৯৮২ সালে জন্ম নেওয়া এই সিলেটি ক্রিকেটার পরিবার নিয়ে এখন আছেন সুদূর আমেরিকায়। সেখানেও আছেন ক্রিকেট নিয়ে। খুলেছেন ক্রিকেট একাডেমি। চেষ্টা করছেন নিজের অভিজ্ঞতা নতুনদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থান নিয়ে গর্ব করা তাপস সেখান থেকে জানিয়েছেন আরও অনেক কথা।

নিজের ক্রিকেটে আসার গল্প, ক্যারিয়ারের গল্প, সর্বোপরি একজন ক্রিকেটার তাপসের গল্প। রাইজিংবিডি’র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হচ্ছে তাপসের সে সব জানা-অজানা অধ্যায়।

রাইজিংবিডি: আমেরিকাতে থিতু হয়েছেন। সেখানে করোনার পরিস্থিতি তো ভয়াবহ। কিভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রেখেছেন?
তাপস: একেবারে লক ডাউন। এমনভাবে আছি যে, মনে হবে কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। দীর্ঘদিন ধরেই গৃহবন্দী। পরিবারের সাথে আছি। ঘরে নতুন অতিথি এসেছে। আগে এক ছেলে ছিল। কিছুদিন আগে মেয়ে হয়েছে। সবাই সুস্থ আছে। পত্র-পত্রিকায় পড়ছি দেশের পরিস্থিতিও তো দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে।

রাইজিংবিডি: একটু খারাপের দিকেই যাচ্ছে। আশা করছি দ্রুতই পরিস্থিতি অনুকূলে চলে আসবে। আমেরিকাতে কি করছেন? এ প্রজন্মের অনেকেই আপনার খেলা টিভিতে দেখেছে কিন্তু আপনি এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কি করছেন কিছুই জানে না...
তাপস: আমি আসলে আমেরিকাতে চলে এসেছি হুট করেই। এখানে পরিবার নিয়েই আছি। নিউইয়র্কে বসবাস করছি। ক্রিকেটের মানুষ। ক্রিকেট নিয়েই আছি। এখানে আমার একটি ক্রিকেট একাডেমি আছে। ভারতীয়, পাকিস্তানি, বাংলাদেশি প্রবাসীদের সন্তানেরা আসেন একাডেমিতে, এইতো। প্রায় দুই মাসের বেশি হলো একাডেমিতে যাওয়া বন্ধ। এখন ঘরে বসেই সময় কাটছে।

রাইজিংবিডি: সেখানকার ক্রিকেট সংস্কৃতি তো এখনও সেভাবে গড়ে উঠেনি?
তাপস: আমেরিকার একটি জাতীয় ক্রিকেট দল আছে। ওরা নিয়মিত খেলছে। কিন্তু সেভাবে আমেরিকাতে এখনও ক্রিকেট সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি। ওদের একটা বোর্ডও আছে। চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এখনও ক্রিকেট গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। মানে পপুলার নয়। তবে নিকট ভবিষ্যতে হতে পারে।

রাইজিংবিডি: আপনার ক্রিকেট ক্যারিয়ার দিয়েই সাক্ষাৎকার শুরু করি। আপনার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল কিভাবে? কোনো চমকপ্রদ গল্প আছে নাকি খুব সাদামাটা?
তাপস: খুবই সাদামাটা। আমি টেপ টেনিস বল দিয়ে খেলা শুরু করি। স্থানীয় কোচরা একদিন আমাকে দেখে ক্রিকেট বল ধরিয়ে দেন। আমিও বল করি...স্কুল ক্রিকেট খেলেছি। ঢাকা থেকে কয়েকজন কোচ এসেছিল। আমাকে দেখে বলে যে ঢাকায় যেও। তারপরে একটু পড়ালেখাতে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ তখন মেট্রিকের ব্যাচ ছিলাম।

পরীক্ষার পর আমাদের স্থানীয় পারভেজ ভাই ও নাহিদ ভাই বললো, ঢাকায় গিয়ে খেলতে। আবার দীপু রায় চৌধুরী আমাকে চেনেন। ঢাকাতে এসেই যোগ দিলাম নির্মাণ স্কুল ক্রিকেট টিমে। দীপু রায় চৌধুরীর দল ছিল সেটা। তারপর থেকে আসলে সবকিছু বদলে গেলো। তখন থেকে একটু বুঝার চেষ্টা এবং শেখার চেষ্টা, উপরে যাওয়ার একটা প্রবল চেষ্টা কাজ করতো। ধানমন্ডির মাঠে যে ইনডোর গুলো ছিল, সেগুলোতে গিয়ে অনুশীলন করতাম। সেখানে অনেক অনেক সিনিয়ররা আসতো; তাদের দেখে, বড় বড় খেলোয়াড়কে দেখে, আবাহনীর দলকে দেখে নিজের ভেতর একটা ইচ্ছা আসে, আমিও ক্রিকেটার হবো।

নির্মাণ স্কুল থেকে অনূর্ধ্ব-১৯ ক্যাম্পে চলে আসি। তখন মোহামেডান বিশাল বড় এক ব্রেক থ্রু দিল আমাকে, ২০০০ সালে। আমি তখন অনূর্ধ্ব-১৯ ক্যাম্পে ব্যস্ত ছিলাম, এর মাঝে ইস্কাটনের হয়ে কয়েকটি প্রথম বিভাগের ম্যাচ খেলেছি। পরের বছরও প্রথম বিভাগে খেলার কথা ছিল লালমাটিয়ার হয়ে। আবার জাতীয় লিগের ম্যাচও শুরু হয়েছিলো। কিন্তু কোথা থেকে যেন মোহামেডান আমার নাম শুনে, একটা ছেলে আছে...বোলিংয়ে ধার আছে, গতিও আছে। তখন প্রিন্স ভাই, নাসু ভাই আমাকে মোহামেডানে নিয়ে গেল। ওখানে যাওয়ার পরেই আমার জীবন পুরোটা পাল্টে গেল। আমি তখন থেকে পেশাদার ক্রিকেটার হয়ে গেলাম।

রাইজিংবিডি: মোহামেডানে প্রথম বছরের চুক্তি কত টাকার ছিল?
তাপস: ৮০,০০০ টাকার চুক্তি ছিল। আমি তখন টাকা-পয়সা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। মোহামেডানের মতো দল আমার মতো ক্রিকেটার নিয়েছে সেটা অনেক বড় ঘটনা ছিল ক্লাব ক্রিকেটে।

রাইজিংবিডি: আপনার শুরুর হিসেবে সেটা তো আপনার জন্য পর্যাপ্ত ছিল?
তাপস: হ্যাঁ, কারণ প্রথম বিভাগে লালমাটিয়া ক্লাবে ওই বছরই ৪০ হাজার টাকার চুক্তি হয়েছিল আমার সাথে। নাসু ভাই, প্রিন্স ভাই মোহামেডানের হয়ে খেলতেন। মোহামেডান ক্লাবের নাম তো তখন আসলে ক্রেজ ছিল। আবাহনী-মোহামেডান তখন বিশাল ব্যাপার। তখন ওদের দাপটে লালমাটিয়া আমাকে রাখতে পারেনি। ওরা ক্লাবের সঙ্গে সমঝোতা করে। ওদের টাকাটা ফেরত দিয়ে, ওদেরকে ম্যানেজ করার পরেই মোহামেডান আমাকে আরও ৪০ হাজার বাড়িয়ে ৮০ হাজার দিয়ে চুক্তি করেছিল।

রাইজিংবিডি: প্রত্যেক ক্রিকেটারেরই কোনো না কোনো আইডল থাকে। যাকে দেখে শৈশবে স্বপ্ন দেখে আমি ওই ক্রিকেটারের মতো হবো। আপনার ক্রিকেটে আসার অনুপ্রেরণা কে?
তাপস: তখন আসলে আমি টিভিতে অনেক খেলা দেখতাম। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারতের খেলা ভাল লাগত। শচীনের খেলা ভালো লাগতো। ওয়েস্ট ইন্ডিজের অনেকগুলা টেস্ট ম্যাচ দেখতাম রাত জেগে। আমাদের এখানে রাতের ১-২ টা বেজে যেত। আসলে ওই খেলা গুলো দেখে খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। আমাদের সিলেটের স্কুলে খেলা দেখতে যেতাম। স্কুল ক্রিকেটে যে খেলা হতো বা অনূর্ধ্ব-১৯ এ যে খেলা গুলো হতো সেগুলো দেখতে যেতাম। সেখানে ভালো-ভালো ক্রিকেটাররা খেলতেন। ওদের স্টাইল, খেলা, লাইফ স্টাইল এগুলোই। নির্দিষ্ট কোনো আইডল আমার কখনো ছিলো না। তারপর একটা একটা করে টার্গেট করতাম।
 


রাইজিংবিডি: সেই টার্গেট গুলো কি ছিল?
তাপস: যখন খেলতে শুরু করলাম। তখন দেখলাম, শান্ত ভাইরা খেলছে, বাবু ভাইরা খেলছে। তারপর আমাদের অলমোস্ট ব্যাচমেট বিকাশ খেলছিলো, মঞ্জু ভাইও ছিলো। তাদেরকে টার্গেট করে এগিয়ে যেতাম। পরিকল্পনা করতাম তাদেরকে টপকে যাবো ওয়ান বাই ওয়ান। এভাবেই আমি আমার টার্গেট সেট করতাম। আমি কখনো কোনো আইডলকে বেছে নেইনি। ওয়ান বাই ওয়ান একজনকে বিট করে দলে ঢুকবো, বিট করে উপরে যাবো এই জিনিসটা আমার মাথায় কাজ করতো ছোটবেলায়।

রাইজিংবিডি: আপনার সতীর্থদের কাছ থেকেই শুনেছি আপনি নাকি প্রচুর খেলা দেখতেন?
তাপস: প্রচুর বলতে...প্রচুর। মোহামেডান ক্লাবে আমার টেন্ট ছিলো। আর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে খেলা হতো। আমি অনুশীলন শেষে বিশ্রাম নিয়ে খেলা দেখতে যেতাম। বিকালে যদি অনুশীলন থাকত তাহলে আমি সকালের নাস্তা করে খেলা দেখতে যেতাম। ওই খেলা দেখায় আমি মনে করি, আমাকে খুব সাহায্য করেছে। আসলে আমি খুব স্বল্প দক্ষতার খেলোয়াড়ই ছিলাম। তবে যতটুকু হয়েছি, ওই খেলা দেখাটা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।

রাইজিংবিডি: এরপর তো ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন। এক সময় পেলেন আন্তর্জাতিক ক্যাপও। আপনার প্রথম ওয়ানডে ও টেস্ট ম্যাচের কথা মনে আছে?
তাপস: সেটা তো ২০০২ সালে। আমি তখন বিকেএসপিতে ক্যাম্পে ছিলাম। হুট করে ফোন আসলো আমাকে শ্রীলঙ্কা যেতে হবে। আমি সেরকম প্রস্তুত ছিলাম না। মাথায়ও কাজ করেনি। কারণ দল চলে গেছে, আমি একা ঢাকায়। আসলে ওই সময়ে অনেক কিছু হয়েছিল আমার সাথে। আমি সুযোগ পেয়ে যাচ্ছি যাচ্ছি করেও আমাকে সুযোগ দেওয়া হচ্ছিল না। একবার ভাবুন, জাতীয় দলের স্ট্যান্ডবাই হয়েও আমি ‘এ’ দলে সুযোগ পাইনি। অনেক কিছু হওয়ার পর আমি ভাবা ছেড়ে দিয়েছিলাম।

এরপর হুট করে ওই ডাকটা আসল। বলা হলো, আমার ফ্লাইট কালকেই। কিছু বুঝার আগেই মাঠে নেমে গেছি। মাঠে নামার পরে আসলে ওই দিনের যে কষ্টটা, আসলে ভুলার মতো না। প্রথম শ্রেণির অনেক ম্যাচ খেলেছি কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের যে পরিবেশ, আবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে; এত গরম, এত চাপ। আসলে ওই ম্যাচটা ভুলার মতো না। ম্যাচে সবচেয়ে ভালো স্মৃতি প্রথম উইকেটটা (জীহান মোবারক)। প্রথম উইকেটের জন্য যে আপিল করলাম। আর সেটাতে সাড়া দিয়ে আউট দেন ডেভিড শেফার্ড, অনেক নামকরা আম্পায়ার। এগুলা স্মৃতি হয়ে আছে।

ওয়ানডেতেও অভিষেক শ্রীলঙ্কার সাথে। প্রথম উইকেট নামকরা সনাৎ জয়সুরিয়ার। আমি উনার শক্তির জায়গায় বোলিং করছিলাম। আসলে আমি বিশ্বাস করি, যে যেখানে স্ট্রং তাকে ওই জায়গাতেই আঘাত করবো। তখন সুযোগও থাকে উইকেটটা নেওয়ার। উনি অ্যাটাক করছিলেন আমিও একই জায়গা বল করছিলাম। যার দরুণ আমিও উনাকে ভয় না পেয়ে বাউন্সার, শর্ট অফ লেংথ করার চেষ্টা করছিলাম। আর তাতে করে জয়সুরিয়ার উইকেটটা পেয়ে যাই। বলটা দ্রুতগতির ছিলো। টাইমিংয়ে গড়বড় করেছিলেন। টপ এজ হয়ে যায়। দুর্জয় ভাই ক্যাচটা ধরলেন। এগুলো আসলে অনেক বিশাল স্মৃতি। আমার ক্যারিয়ারের প্রথম উইকেট, এটা আসলে ভুলার মতো না।

রাইজিংবিডি: শেফার্ডের সাথে তো আপনার ২০০৫ সালে ভালো স্মৃতি আছে...
তাপস: আসলে সেই ম্যাচটা বাংলাদেশের ক্রিকেটটাকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। আমরা আগে হয়তোবা জিতেছি। কিন্তু ওই ম্যাচটা আমাদের পুরো দৃশ্যপট পাল্টে দিয়েছে। আপনি দেখবেন ২০০৪-০৫ এর পরে থেকে কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটটা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অনেক উত্থান হয়েছে ওই সময়ে। নতুন নতুন খেলোয়াড় এসেছে। দলের পরিবেশ পরিবর্তন হয়েছে। ক্রিকেটের অবকাঠামো পরিবর্তন হয়েছে। তারপর জেতা শুরু করায় আমাদের মানসিকতা পাল্টে যাওয়া শুরু করেছিল।

আমি মনে করি, অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পর আমরা বিশ্বাস করা শুরু করছিলাম যে, আমরা যে কাউকে হারাতে পারি। ম্যাচটি অবশ্যই আমার জন্য অনেক বড় স্মৃতি। নামকরা তিনজন ব্যাটসম্যানের উইকেট পেয়েছিলাম। রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্ক, ড্যামিয়েন মার্টিন। সেগুলো তো ওই ম্যাচের জন্য বিশাল প্রাপ্তি। আশরাফুলের একশ তখন বিশাল ব্যাপার। আমি ব্যক্তিগতভাবে, আমাদের ওই দলের খেলোয়াড়, কোচ, স্টাফ সবাই বিশ্বাস করি যে, অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর ম্যাচটা দিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ধরন পাল্টে যাওয়া শুরু করে।  ৯৭’ এর আইসিসি ট্রফি দিয়ে আমাদের ক্রিকেটের যে পথ চলা শুরু হয়েছিল, সেটা ২০০৫ সালে পূর্ণতা পায়। মাঝে আমাদের অনেক সাফল্য ছিল। সেগুলো ছিল সিঁড়ি। সেগুলো দিয়ে আমরা বিশ্বাস অর্জন করতে শুরু করি আমাদের পক্ষে সম্ভব এবং অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পর আমরা বিশ্বাস করা শুরু করলাম যে, আমরা যে কাউকে হারাতে পারবো।

রাইজিংবিডি: কখন মনে হচ্ছিল যে ম্যাচটা জেতা সম্ভব? প্রথম ইনিংস শেষে ড্রেসিং রুমে আলোচনা কি হয়েছিল?
তাপস: আমাদের ওইরকম কোনো আলোচনাই হয়নি যে আমাদের জিততেই হবে। বাংলাদেশ দলের অনেকগুলা ম্যাচে আমি নিজেও খেলেছি, জিতেছি। আবার অনেকগুলো ম্যাচে আমি বাইরে ছিলাম কিন্তু দলের সাথেই ছিলাম। আমরা যে কয়টা ম্যাচ জিতেছি ভালো দলের বিরুদ্ধে আমরা কিন্তু কোনো ধরনের কোনো বিশাল পরিকল্পনা, অনেক কথা বলা এগুলা আমরা করতাম না। আমরা অনেক চুপচাপ থাকতাম। ওইদিনও আমরা চুপচাপ ছিলাম। বোলিংয়েও আমরা চুপচাপ ছিলাম, ব্যাটিংয়েও তাই।

তারপর আবার ভারতের বিপক্ষে। আমরা কিন্তু ওইসব ম্যাচ নিয়ে কোনো বিশাল পরিকল্পনা করিনি। আছে না, ড্রেসিংরুমে অনেক কথা হয়। এই করে দিবো, সেই করে দিবো, হারায় দিবো। এই তুই এটা করবি, তুই ওইটা করবি। এরকম কিছুই হইতো না। আমাদেরকে শুধু ম্যান টু ম্যান ব্যক্তিগত টার্গেট দেওয়া হতো। শুধু সেটা ফলো করার চেষ্টা করতাম। আমরা খুব চুপচাপ থাকতাম। ম্যাচটা কে ফিনিশ করবে, কে জিতিয়ে আসবে ওরকম কোনো পরিকল্পনা থাকত না।

রাইজিংবিডি: যে দুটি ম্যাচের কথা বললেন, কোনটা আপনার হৃদয়ের খুব কাছের?
তাপস: কোনো একান্তর নেই আসলে। দুইটাই খুব কাছের। একটা দেশের বাইরে একটা দেশে। আসলেই দুইটাই স্মৃতিবহ। গল্প করার মতো। গর্ব করারও মতো। হয়তো বেঁচে থাকলে ১০-২০ বছর পর বলতে পারবো ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার সেরা দলকে আমরা হারিয়েছিল।

রাইজিংবিডি: ভারতের সঙ্গে জয়ের ম্যাচে তো আপনার আর মাশরাফির জুটিটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
তাপস: হ্যাঁ, ওই ‍জুটিটা কতো বড় সেটা ম্যাচের পর আমরা বুঝেছি। প্রায় ৪০ রানের মতো (৩৯ রানের জুটি)। আমি মনে হয় ১৮/২০ এর মতো করেছিলাম (১৩ বলে ১৭)।

রাইজিংবিডি: ২০০৪ সালে ভারতের সেই দলটিও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে প্রায় ২৭ হাজার দর্শক। ম্যাচে জয়ের প্রেরণা কিভাবে পেয়েছিলেন?
তাপস: এর আগের ম্যাচটাতে আমরা অনেক কাছাকাছি গিয়ে হেরেছিলাম, চট্টগ্রামে। সেখান থেকেই মনে হচ্ছিল আরেকটু যদি ভালো করি তাহলে হয়ে যেতে পারে। আসলে সব কিছুর জন্য একটা ছন্দ, একটা প্রক্রিয়া লাগে। ওই ম্যাচটায় দেখবেন ওপরে ব্যাটিংটা ভালো হচ্ছিল, মধ্যভাগে একটু হয়েছিল আবার শেষটায় ফিনিশিং ভালো হয়েছিল। তখন ২৩০ থেকে ২৫০ রান হয়ে গেলে অনেক-ই মনে হইতো। যেমন এটা এখন কোনো রানই না।
 


বোলিংয়েও শুরুতে আমরা ছন্দ পেয়ে যাই। মানে অনেক ভালো বোলিং হচ্ছিলো। আমি-মাশরাফি দুই সাইড থেকে সুজন ভাই, রফিক ভাই। মানে শুরু থেকে ওদের চাপে রাখছিলাম। সেই ছন্দ আমরা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখি। বোলিংয়ের পাশাপাশি সেদিন ফিল্ডিং ছিল তুখোড়। যে যেভাবে পারে রান বাঁচিয়েছে। যে যেভাবে পারে ক্যাচ ধরেছে। এই ছন্দের জন্যই আসলে আমাদের জয়টা চলে আসে।

রাইজিংবিডি: আপনার ক্যারিয়ারকে দীর্ঘ-ই বলবো। এ সময়ে আপনার সেরা বোলিং জুটি কে ছিল?
তাপস: আমি আর মাশরাফি। আমাদের সময়ে আমাদের বোলিং জুটিটাই ছিল সেরা। দেখা যেত একদিক থেকে আমি ভালো করছি, মাশরাফি আরেকদিক থেকে ভালো করছে। আবার কোনো দিন আমি খারাপ করলে মাশরাফি পুষিয়ে দিত। মাশরাফি খারাপ করলে আমি দিতাম।

আসলে মাশরাফি তো নিঃসন্দেহে ভালো। মাশরাফি তো মাশরাফিই, এখনো। আমার ভেতরে কাজ করতো যে, ও ওইরকম করতেছে আমি কেন করবো না। আর ও নিজেও ওর কিছু সাক্ষাৎকারে বলেছে যে ওর বোলিং পার্টনারের মধ্যে আমিও একজন আছি। আমিও বিশ্বাস করি আমিও ওর ভালো পার্টনার ছিলাম। আমরা দুইজন ব্যাটিং ও বোলিং যখন একসাথে শুরু করতাম দুজনেরই টার্গেট থাকতো উইকেট নিতে হবে। আমরা দুইজনেরই কেউই বোলিংয়ে রক্ষণাত্মক ছিলাম না। আমরা উইকেটের জন্য বোলিং করতাম। অ্যাটাকিং ছিলাম।

ও তো অনেক বড় লেভেলের খেলোয়াড়। সবসময় ওর লাইন-লেন্থ ভালো ধরে রেখেই অ্যাটাক করতো। আর আমি ছিলাম একটু অন্য ধরনের অ্যাটাকিং। আমার উইকেট লাগবেই লাগবে। তাই আমার আর ওর জুটিটাই জমতো।

রাইজিংবিডি: সাধারণত বাংলাদেশে বোলিং জুটি খুব অল্পদিন টিকে থাকে। কিন্তু আপনাদের জুটিটা দীর্ঘদিন বজায় ছিল। দুজনের রসায়নে এমন কী ছিল যেটা অন্যদের মধ্যে ছিল না?
তাপস: আমি আর মাশরাফি ছিলাম ফিয়ারলেস। দুজন দুজনের থেকে শিখতাম। ধরুন, আমি যখন খেলা শুরু করি তখন সহজাত ইন সুইঙ্গার ছিলাম। মাশরাফি পারত আউট সুইঙ্গার। ওর থেকে আউট সুইঙ্গার শিখে নিলাম আমি এবং বোলিং করতে করতে কিভাবে যেন আউট সুইঙ্গার হয়ে গেলাম।

আবার আমি খুব ভালো লেগ কাটার পারতাম। যেটা মাশরাফি পারতো না। আমার কাছ থেকে ও ওইটা শিখে নিল। ঠিক অফকাটার, যেটা ও এখন খুব বেশি ভালো পারে, তখনও পারত। ওই জিনিসটা আমি ওর কাছ থেকে শিখে নিলাম। এই বিষয়টা ওর আর আমার মধ্যে ছিল। নেটে আমি আর ও পাশাপাশি বোলিং করতাম। যখন দেখতাম ওকে একজন খেলতে পারছে না, তখন আমিও চেষ্টা করতাম আমাকেও যেন খেলতে না পারে।

একটা ঘটনা মনে পড়ছে, আমার নেটে ব্যাটসম্যান ছিল হান্নান সরকার। ওর নেটের ব্যাটসম্যানের নাম মনে নেই। ওই সময়ে আমি একদিক থেকে ব্যাটসম্যানকে বিট করছি। ও ঠিক তাই করছে। দুই বোলারকে সেদিন দলের কেউ খেলতেই পারছিল না। আসলে ও আর আমি সবসময় গল্প করতাম, জানতাম, শিখতাম একজন আরেকজনের কাছ থেকে।

আমরা তো সিনিয়র পেস বোলারদের দেখে পেসার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। এখন মাশরাফিকে দেখে মানুষ পেস বোলার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। যদিও আমি অনেক ভালো ছিলাম না। তবে আমার আগে-পরে অনেকের আমার বোলিং ভালো লাগতো। হয়ত বা চেষ্টা করেছিলাম বলে কিছু একটা হতে পেরেছি।

রাইজিংবিডি: আপনি কি বিশ্বাস করেন আপনাদের বোলিং জুটি বাংলাদেশের অনেক সাফল্যের পথ তৈরি করে দিয়েছিল?
তাপস: মাশরাফিকে তো আমি অনেক মিস করেছি। অনেক ইনজুরিতে ছিল। তাও যখনই ফিরে আসত ওকে পেতাম। হ্যাঁ আমাদের জুটিটা ভালো ছিল এবং আমরা একসাথে সাফল্যও এনে দিয়েছি। ও থাকায় তো অনেক সাফল্য পেয়েছি। আর সুমন ভাই (অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন) আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। আমাকে পছন্দও করতেন। শুধু ওয়ানডেতেই নয় টেস্টেও আমাদের ব্রেক থ্রু এসেছে একসাথে।

রাইজিংবিডি: আপনাকে মাশরাফি বাঙ্গি মামা বলে ডাকে? সেই নামটা আসল কিভাবে?
তাপস: সেটা আমি আসলে নিজেও জানি না। ও আমাকে আদর করে ডাকতো, আমি ওকে পাগলা ডাকি। এখনও আমি জানি না যে কেন ও আমায় বাঙ্গি মামা বলে।

রাইজিংবিডি: ক্যারিয়ারের শুরুতে যে চিন্তা করে শুরু করছিলেন। শেষ কি সেখানে করতে পারছেন?
তাপস: নাহ পারিনি। ক্যারিয়ারের শেষ ৩/৪ বছর অনেক ভুগেছি। ২০১৬ মৌসুমটা ছিল আমার জন্য কষ্টের ও দূর্ভাগ্যের। আবাহনীর হয়ে ওই মৌসুমে পা ভেঙে গেলো প্রথম দিনই। পরে ফিরে আসাটা অনেক কঠিন হয়ে গেল। ওইটা অনেক বড় দূর্ঘটনা। শেষ ৩/৪ বছর অনেক সমস্যার মধ্যেই ছিলাম। খেলতাম, ভালো খেলতাম, জিদ থাকতো কিন্তু ম্যাচ কম পেতাম। ওই সময়গুলোতে খেলার মাঠে অনেক কষ্ট করে দিন পার করেছি।

রাইজিংবিডি: আক্ষেপ আছে কোনো?
তাপস: যখন খেলা শুরু করছি, তখন তো চিন্তা করিনি যে কোথায় যেতে হবে। খেলার কারণে জীবন পরিবর্তন হয়ে গেছে। রাত-দিন ২৪ ঘন্টাই ছিল ক্রিকেট। আজকে এই দেশে, কালকে ওই দেশে খেলছি, ক্যাম্পে করছি। খেলার সময়ও ধরেন সেসব চিন্তা আসেনি যে কোথায় যেতে হবে। কিন্তু এখন এসব নিয়ে ভাবি। আর ভাবলে গর্বের সাথে কিছু আফসোস কাজ করে।

রাইজিংবিডি: পরিবার থেকে কেমন সহযোগিতা পেয়েছেন?
তাপস: পরিবার থেকে শুরুর দিকে বড় ভাই আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। সুজন ভাইয়ের নামের সাথে মিল আছে, সুজন বৈশ্য। তিনি আমাকে ঢাকায় আসার টাকা দিয়েছিলেন। ১৯৯৮-৯৯ এর দিকে ঢাকায় আসা কিন্তু অত সহজ ছিলো না। তার উপর আমার মতো ইন্টারে পড়ুয়া একটা ছেলের জন্য আসা কঠিন। তখন বড় ভাই অনেক সহযোগিতা করেছিল। তারপর যখন আমি মোহামেডান থেকে শুরু করি তখন ধীরে ধীরে নিজের খরচ চালাতে পারি। তবে বড় ভাই আমাকে পরিবারের কোনো কিছুতে যুক্ত করেনি। ফলে আমার যে দায়িত্ব সেটা আমি অনুভব করিনি। বড় ভাই একাই সব সামলে নিয়েছে। আমি ২০০৪-০৫ থেকে ফ্যামিলিকে কন্ট্রিবিউট করা শুরু করেছিলাম। আছে না যে বলা, পারিবারিক অনুষ্ঠান কন্ট্রিবিউট করো বা এটা করো ওটা করো। এগুলো বড় ভাই আমাকে করতে দেয়নি। আমাকে তিনি অনুভবও করতে দেননি। শুধু ক্রিকেটই খেলছি।

রাইজিংবিডি: মানে মাঠের বাইরে বড় ভাই আপনার সব করেছে?
তাপস: হ্যাঁ, শতভাগ সত্য। শুরুর দিকে তিনি যদি আমাকে আর্থিকভাবে সাহায্য না করতেন তাহলে আমি তাপস বৈশ্য হতে পারতাম না। আমার ঢাকায় আসা হতো না। ক্রিকেটই খেলতাম না।
 


রাইজিংবিডি: বাংলাদেশ ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থা আপনার কাছে কেমন লাগে?
তাপস: বিশাল ভালো লাগে। মাঝে মধ্যে ওদের খেলা, ওদের অর্জন দেখে তো অনেক ভালো লাগে। কিন্তু যখন ওরা বিস্ময়কর, অসাধারণ ক্রিকেট খেলে তখন নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। মানে মনে হয় যে, আমরা তো এরকম খেলতেই পারিনি। তো ওইটাও কষ্ট দেয়। কিন্তু এখন যে পজিশনে আমরা আছি, চিন্তা করছি আমরা তো একদিন বিশ্বকাপ জিতব। সামনে তো অবশ্যই কয়েকজন ভালো খেলোয়াড় আসছে। আবার এখনকার যারা আছে, এছাড়া সিনিয়ররা আছে। এদের থেকে তো অনেক কিছু শেখার আছে। আমাদেরও অনেক কিছু শেখার আছে ওদের থেকে। আর খুবই ভালো লাগে। মনে হয়, এই খেলাটা আমি খেলেছি। এই খেলাটা এখন এই পজিশনে আছে কিছুটা হলেও এখানে অবদান আমার আছে। তখন খুব গর্ব হয়।

রাইজিংবিডি: ক্রিকেটটা কি মিস করেন?
তাপস: শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এই খেলাটা মিস করবো।

রাইজিংবিডি: এজন্যই কি দেশ ছেড়ে আমেরিকা গিয়েও ক্রিকেট নিয়ে কাজ করা?
তাপস: আমি আসলে ভাগ্যবান। দেশ থেকে এখানে আসার পর ক্রিকেট নিয়ে কাজ করতে পারবো ভাবিনি। আমার সৌভাগ্য যে আমি প্রতিদিন ব্যাট-বল ধরতে পারছি। আমেরিকার মতো জায়গায় ক্রিকেটের প্ল্যাটফর্ম অনেক কম। সেই জায়গা থেকে আমি আনন্দের সাথে বলবো, আমি ভাগ্যবান যে ক্রিকেট নিয়েই আছি।

রাইজিংবিডি: ক্রিকেটে আপনার বেশ কয়েকটি অর্জনই আছে। আপনার সেরা মুহূর্ত কোনটা বলবেন?
তাপস: আমার সবচেয়ে প্রিয় মুহুর্তটা প্রথম টেস্ট জয়।

রাইজিংবিডি: এটা কি টেস্ট ক্রিকেটে মর্যাদা অনেক বেশি এই কারণে?
তাপস: প্রথম তো প্রথমই। সে আনন্দ, সে মুহূর্ত বিশাল কিছু। এটাই মনে হয়েছে তখন। প্রথম টেস্ট জয়টা মনে হইছিল বিশ্বকাপ জয় করার মতো। প্রতিপক্ষ যে-ই হোক, যেখানেই খেলি না কেন ওইটা প্রথম টেস্ট জয়। আমাদের দুই দলের সামর্থ্য সমান সমনাই ছিল। ১৯-২০ ছিল হয়ত। আমরা ১৯ তারা ২০। আর আমরা ১৯-২০ অবস্থানে থেকে প্রথম টেস্ট জয় করলাম।

এরপর দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচটি এত কষ্ট করে লড়াই করে ড্র করলাম, সেটা আসলে বিশাল কিছু এবং আমাদের বাংলাদেশের মাঠে। চট্টগ্রামের টেস্ট জয়ই বড় স্মৃতি বলবো। অন্যান্য জয় গুলো দারুণ, তবে একটা বেছে নিলে ওইটাকেই বেছে নিবো আমি।

রাইজিংবিডি: আপনার অনেক বড় বড় কোচের সঙ্গে কাজ করা হয়েছে। এদের মধ্যে ডেভ হোয়াটমোরকে কি এগিয়ে রাখবেন? সাথে জানতে চাইবো, কোচদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? আর তারা আপনাকে কীভাবে তাপস বৈশ্য বানিয়েছিল?
তাপস: কোচ তো ২-৩ জনের সঙ্গে কাজ করা হয়েছে। শুরুতে আমাকে সবাই পছন্দ করতো। প্রথম দুইজন তো অনেক পছন্দ করতোই। ডেভও প্রথম দিকে অনেক সহযোগিতা করেছে। অনেক খেঁটেছে আমার জন্য। আলাদা ভাবে আমার সঙ্গে কাজ করতো, অনেক কথা বলতো, পরিকল্পনা ও লক্ষ্য দিতো। আলাদাভাবে ট্রেনারকে বলে দিতো আমাকে নিয়ে কাজ করতে, আমাকে ফিজিওর কাছে পাঠাতো। তো উনার অনেক সহযোগিতা ছিল।

আর শেষের দিকে যখন ইনজুরিতে পড়ে গেলাম বিশ্বকাপে। তার আগের ৪-৫ মাস ও পরের সময়টা ভালো ছিল না তেমন একটা। কারো কাছ থেকে ওইরকম সহযোগিতাও পাইনি। সেরা কোচ বলতে বললে অবশ্যই হোয়াটমোরের কথাই বলবো।

রাইজিংবিডি: আপনার চোখে বাংলাদেশের সেরা অধিনায়ক কে? আর কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
তাপস: আমি যার নেতৃত্বে খেলেছি, হাবিবুল বাশার। তিনি সবার সঙ্গে অনেক বন্ধুসুলভ আচরণ করতেন। খুব চুপচাপ মানুষ ছিলেন। আর সবসময় কম টার্গেট দিয়ে কাজটা আদায় করার চেষ্টা করতেন। উনার যে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ওইটাই মূলত আমাদের অনেক ভালো করার জন্য অনুপ্রেরণা দিয়েছিল।

এছাড়াও উনি মাঠের খেলা ভালো বুঝতেন। বোলিং পরিবর্তন ভালো বুঝতেন। অধিনায়ক হিসেবে মাঠে অনেক শান্ত এবং ধীরস্থির ছিল। উনি আমাকে সবসময় অনুপ্রাণিত করতেন। উনি আমাকে বলতেন, ‘‘তাপস তুই আমার মূল বলার। তুই আমাকে ব্রেক থ্রু এনে দিতে পারবি।’’ এগুলা সবসময় আমাকে বলতেন।

আমার ও মাশরাফির উপর উনার একটা বিশ্বাস ছিল। দল যখন বিপদে পড়তো আমাকে আর মাশরাফিকে নিয়ে পরিকল্পনা সাজাতো। আমাকে বিভিন্ন স্পেলে নিয়ে আসতেন। কঠিন কঠিন পরিস্থিতিতে আমাকে দিয়ে বোলিং করাতেন। এছাড়া নিজেও অনেক সাক্ষাৎকার, এমনকি আমাদের টিম মিটিং বা ব্যক্তিগতভাবে বলতো, ‘‘তাপস তোকে কিন্তু স্লগ ওভারে বল করতে হবে। তুই স্লগ ওভারে আমার সেরা বোলার।’’ একজন অধিনায়ক যখন এমন কথা বলবে এটা কিন্তু বোলারের জন্য বিশাল প্রাপ্তি। আর এটা আমাদের ভালো করার স্পিরিটও বাড়িয়ে দিতো।

রাইজিংবিডি: ক্রিকেট আপনার জীবনের সাথে জড়িত, এটা আপনি শুরুতেও বলেছেন। যদি ক্রিকেটকে আপনার নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করতে বলা হয়, তবে কি বলবেন?
তাপস: এই যে আমি তাপস বৈশ্য, এখন যে জায়গায় আছি, এই যে আপনি আমার সাথে কথা বলছেন- এর সবকিছু হয়েছে ক্রিকেটের কারণে। ক্রিকেট আমার পরিচয়। আমি ক্রিকেটার আগে। তারপর তাপস। তো ক্রিকেটটা আমার কাছে বিশাল। আমি এটা অনুভব করি।  ক্রিকেটের জন্য আমি এই জায়গায়।

যখন আমি স্কুলে ছিলাম, ক্লাস ৯ বা ১০ এ। তখন আমি আমার এলাকায় টেপ টেনিস বলে খেলতাম। তখন থেকে আমাকে সূচি তৈরি করে রাখতে হতো। কাল এই জায়গায়, পরশু ওই জায়গায় খেলা। যেদিন আমার খেলা থাকতো না। সেদিন পড়ার টেবিলে বসে মনোযোগ থাকতো দরজায়। কেউ কড়া নাড়ছে কিনা! খেলা না থাকলে মাথা নষ্ট। আসলে আমি এগুলা এখন অনুভব করি।

দেখা যেত অনেক সময় রাত ৯/১০টার সময় আমার ক্রিকেট বলের পার্টনাররা এসে বলতো কালকে খেলা। এই যে এই ব্যাপারগুলা, এগুলো আমার সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িত। আসলে ক্রিকেট ছাড়া আমি জিরো।

আজকে আমি যেখানে আছি, যতটুকু আছি, আমার পরিবারকে যতটা সাহায্য করতে পেরেছি, আশপাশের লোক, আমার আত্মীয় স্বজন, আমার ভাই-বন্ধুদের সঙ্গে যেভাবে আছি ক্রিকেটের জন্যই।

রাইজিংবিডি: ছেলেকে ক্রিকেটার বানানোর ইচ্ছা আছে?
তাপস: ইচ্ছা তো ছিল। যখন শুনলাম যে, ছেলের বাবা হচ্ছি। তখনই ইচ্ছাটা জন্মায়। তবে সব ইচ্ছা তো মনে হয় না পূরণ হবে। এখন যে জায়গায় চলে আসছি, ওই জায়গা থেকে ক্রিকেট খেলার সুযোগ অনেক কম। আসলে চেষ্টা থাকবে তবে আমি জানি না। আর ওর আগ্রহ আছে কিনা দেখতে হবে। আর আমার স্ত্রীও একটু ভীতু ও খেলাধুলা ভয় পায়।

রাইজিংবিডি: শেষ প্রশ্ন, ক্রিকেট নিয়ে এমন কিছু আছে যে আপনি কাউকে বলেন নি?
তাপস: আমার ক্যারিয়ার অনেক আগে শেষ হয়ে গিয়েছিল। তবে আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম। ২০০৭ এর পরে ২০১৫ পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলাম। তবে ক্রিকেট নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ বা কষ্ট নেই।


ঢাকা/কামরুল/ইয়াসিন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়