ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

অধিনায়ক মুশফিকের সফলতা-ব্যর্থতা

মুহা. ইকবাল আজাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ৫ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
অধিনায়ক মুশফিকের সফলতা-ব্যর্থতা

‘জন্মিলে মরিতে হয়’, ছোট বেলায় আদর্শ লিপি বইতে পড়া এই বাক্যের কখনো ব্যত্যয় ঘটেনি। কখনো যে ঘটবে না, এটা অবিশ্বাস করার জো নেই। পৃথিবীতে প্রবেশ করলে যেমন বিদায় নিতেই হয়। তেমনিভাবে কারো উপর কোন দায়িত্ব অর্পিত হলে সময় সুযোগ বুঝে সেটা ছেড়ে দিতে হয় কিংবা ছাড়তে হয়। কিছুদিন আগে যেমনটা ছেড়েছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। জাতীয় দলে দীর্ঘ সময় অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন, পরিস্থিতি অনুযায়ী দায়িত্বভার ত্যাগও করেছেন। বিশ্বের চিরাচরিত নিয়মেই ঘটেছিলো মাশরাফির অধিনায়কত্ব থেকে বিদায়ের কাহিনী।

বাংলাদেশ দলের এ পর্যন্ত সফলতম অধিনায়ক কে? নিঃসন্দেহে মাশরাফির নাম উচ্চারিত হবে সবার কণ্ঠে। কিন্তু টেস্টে বাংলাদেশের এ পর্যন্ত সফল অধিনায়ক কে? উত্তর দিতে কেউ কেউ হয়তো পরিসংখ্যান ঘাঁটবেন, কেউ বা সঠিক উত্তর প্রস্তুত করবেন। টেস্টের ক্ষেত্রে দর্শকদের এমন হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ, বাংলাদেশ টেস্ট সংস্করণে সবচেয়ে নিচু সারির দল। ফলে জনমনে টেস্টের চাহিদাও ভাটার স্রোতে বহমান। দুই দশক পার করা টেস্ট খেলুড়ে একটা দলের জয় মোটে ১৪টি। তন্মধ্যে মুশফিকের অধিনায়কত্বের কালে জয় মোট ৭টি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, টেস্টে মুশফিকই এ পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক।
২০১১ সালের জিম্বাবুয়ে সিরিজের ব্যর্থতার জন্য দেশের ক্রিকেটে দলনেতার পরিবর্তন আসে। সাকিবের পরিবর্তে ক্রিকেটের তিন সংস্করণের অধিনায়ক নির্বাচিত হন মুশফিকুর রহিম। ২০১২ সালে বাংলাদেশ মুশফিকের অধিনায়কত্বে প্রথম এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠে। তবুও ২০১৪ সালে দলগত ব্যর্থতার পরিণামে মাশরাফির কাছে নেতৃত্ব হারান মুশফিক। ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিতে নেতৃত্ব দেওয়া মাশরাফি খেলতেন না টেস্ট ম্যাচ। তাই টেস্টের দায়িত্ব মুশফিকের কাছেই বহাল ছিলও। ২০১৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সিরিজের ব্যর্থতা আর বিতর্কে সমাপ্তি টানে মুশফিকের অধিনায়কত্বের জীবন। কথা হলও, অধিনায়ক মুশফিক খেলার মাঠে কতটা উজ্জ্বল ছিলেন?

২০০০ সালে টেস্টে অভিষেক হওয়া বাংলাদেশ এ পর্যন্ত মোট ম্যাচ খেলে ১১৯টি। তাতে জয় ১৪টি, ড্র ১৬টি। টেস্ট ফরম্যাটের ১১৯টি ম্যাচের দায়িত্ব পালন করেন মোট এগারো জন অধিনায়ক। মুশির নেতৃত্বে ৩৪টি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ দল। যাতে টিম জয়লাভ করে মোট জয়ের ঠিক অর্ধেক, অর্থাৎ ৭টি। ড্র এর সংখ্যাও কম নেই। দলের মোট ড্র এর অধিকাংশই (৯টি) আসে মুশফিকের নেতৃত্বে। পরিসংখ্যান বলে দেয়, টেস্টের এযাবতকালের সফল অধিনায়ক ছিলেন 'দ্যা লিটল ম্যান।' সর্বশেষ হালনাগাদ অনুযায়ী, মুশফিকের টেস্ট সংস্করণে ব্যাটিং গড় ৩৬.৩২ বা ৩৭ এর কাছাকাছি। কিন্তু একজন টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকের ব্যাটিং গড় আরও উন্নত। ৩৪ টেস্টের নেতৃত্ব দেওয়া অধিনায়ক মুশি ৪১.৪৫ গড়ে করেছেন ২৩২১ রান। বাকি ৩২ ম্যাচে ৩২.৬৮ গড়ে করেছেন ২০৯২ রান। তাছাড়া ৭টি সেঞ্চুরির ৪টিই তার অধিনায়কত্বের কালে।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০০৬ সালে ওয়ানডেতে অভিষেক হয় মুশফিকের। তারপর থেকে ২৩৭টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ দল। অভিষেকের পর থেকে ইনজুরি এবং ফর্মহীনতায় মাত্র ১৯টি ম্যাচ খেলতে পারেননি মুশফিক। ২১৮ ম্যাচ খেলা মুশফিকের ব্যাটিং করা হয়নি ১৪ ম্যাচে। ২০৪ ইনিংস ব্যাট করা মুশফিক ৩৬.৩২ গড়ে করেছেন ৬১৭৪ রান। মজার ব্যাপার হলও, প্রথম ১০০ ওয়ানডে মাত্র ২৬ গড়ে রান করা মুশির বর্তমান ব্যাটিং গড় ৩৭ এর কাছাকাছি। মূলত অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর মুশফিকের ব্যাটিং ধারার উন্নতি ঘটে। তবে দলগত ব্যর্থতায় ওয়ানডের অধিনায়কত্বে ততটা সফল হতে পারেননি মুশফিক। যার ফলে ২০১৪ সালে নেতৃত্ব ছাড়তে হয়।

জয়ের দিক থেকে ওয়ানডে সংস্করণে বাংলাদেশের ১৪ জন কাপ্তানের মধ্যে মুশির অবস্থান চতুর্থ। জয়ের হার মাত্র ৩১.৪২ শতাংশ। দলপতির দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০১১ সালে প্রথম বারের মতো মুশির বার্ষিক ব্যাটিং গড় ৩০ এর সংখ্যা স্পর্শ করে। অধিনায়ক হিসেবে ৩৭ ম্যাচে ৩৪.৩৫ গড়ে ১০৬৫ রান করে বগুড়ার সন্তান। তবে মুশফিকের ব্যাটিং ধারাবাহিকতা বৃদ্ধি পায় মাশরাফির আমলে। ব্যাটিংয়ের গড় বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রবল গতিতে ঘুরতে থাকে রানের চাকাও। মাশরাফির নেতৃত্বে ৮২ ম্যাচ খেলা মুশফিক ৪৬.০১ গড়ে করেন ২৯৯১ রান। ওয়ানডের অধিনায়কত্বে অনেকটা ম্লান মুশফিক বর্তমানে দেশের ওয়ানডে সংস্করণের সেরা ব্যাটসম্যান।

বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের নিচু সারির দল। কিছুদিন আগেও র‍্যাঙ্কিংয়ে আফগানিস্তানের পেছনে ছিলও বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টিতে ৯৬ ম্যাচ খেলা বাংলাদেশের জয় মাত্র ৩২টি। বিপরীতে হার ৬২টি। বলা হয়ে থাকে, হিটিং এবিলিটির অভাব আর উইকেট শিকারি বোলারের অপূর্ণতা দলের এত অবনমনের কারণ। অতিরিক্ত ডট বল খেলাও যে পরাজিত হওয়ার অন্যতম কারণ, এটাও অস্বীকার করার অবকাশ নেই। ছোট দলের ব্যাটসম্যানদের দৌড়ও সংক্ষিপ্ত। টেস্ট-ওয়ানডের সেরা ব্যাটসম্যান মুশফিক টি-টোয়েন্টিতে যেন বড্ড আনকোরা। ব্যাটসম্যান তালিকার শীর্ষ ৫০ এ নেই মুশফিক-তামিমের নাম। টি-টোয়েন্টিতে ৭৭ ইনিংস খেলা মুশফিকের ব্যাটিং গড় মাত্র ২০। তাতে করেছেন ১২৮২ রান। অথচ বাৎসরিক  হালনাগাদ অনুযায়ী, ২০১৭ সালে মাত্র ২৬ ম্যাচ (তিন ফরম্যাট মিলিয়ে) খেলে মুশফিক করেছিলেন ১২৬২ রান।

পরিসংখ্যান বলে দেয়, টি-টোয়েন্টিতে কতটা পিছিয়ে বাংলাদেশ, কতটা পেছানো দেশ সেরা ব্যাটসম্যান। তবে টি-টোয়েন্টি সংস্করণে সাধারণ খেলোয়াড় মুশফিক থেকে অধিনায়ক মুশফিক কিছুটা হলেও উত্তম। নেতৃত্ব দেওয়া ২৩ ম্যাচে ২৪.৫৯ গড়ে মুশি করেছেন ৪১৮ রান। বাকি ৬৩ ম্যাচে ১৮.৩৮ গড়ে করেছেন মাত্র ৮৬৪ রান। পাশাপাশি টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে টাইগারদের ছয় জন অধিনায়কের মধ্যে জয়ের হারে মুশফিকের অবস্থান দ্বিতীয়। অর্থাৎ এতক্ষণের বিশ্লেষণ এতটুকু প্রমাণ করে যে, অধিনায়কত্বের কালে দলের ব্যর্থতা আর সফলতার মাঝে নিয়মিত উজ্জ্বল থাকে মুশফিকের ব্যাট।

২০১৭ সালে জাতীয় দলে অধিনায়কত্বের ইতি টানেন মুশফিক। তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন, আবার কখনো দলনেতার দায়িত্বে দেখা যাবে না তাকে। গত বিপিএলের এক সংবাদ সম্মেলনেও এ কথা পরিষ্কার করেন মুশফিক। এদিকে সাকিব আল হাসান গত বছরের নিষেধাজ্ঞার পর থেকে মাঠের বাইরে। ফলে নতুন অধিনায়ক নির্বাচনে কিছুটা হলেও হিমশিম খেতে হয়েছে নির্বাচকদের। বারবার সিনিয়রদের রুমে ডেকে পাঠিয়েছেন, কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন। অধিনায়কের যোগ্য মুশফিক পুনরায় দলনেতা হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। অবশেষে টি-টোয়েন্টিতে রিয়াদ এবং ওয়ানডেতে মুমিনুলের হাতে সঁপে দেওয়া  হয়েছে দলের গুরুভার।

এদিকে গত জিম্বাবুয়ে সিরিজে অধিনায়ক হিসেবে শেষ ওয়ানডে ম্যাচ খেলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। মাশরাফির পরে কে আসবেন ওয়ানডের দায়িত্ব নিতে? কে নিবেন গুরু দায়িত্ব? এর মাঝে সুর পাল্টেছেন মুশফিক, ‘সুযোগ পেলে আবার দলনেতা হিসেবে ফিরতে চান। জাতীয় দলের নেতৃত্ব দেওয়াকে গর্বের মনে করেন।’ এমনটা জানালেন তিনি। তবে এতে দলপতির দায়িত্ব জোটেনি মুশফিকের।

আসন শূন্য হলেই তবে পুনরায় পূর্ণ হয়। মাশরাফি অধিনায়কের আসন ছেড়েছেন, বিসিবিও আসন পূর্ণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। জিম্বাবুয়ে সিরিজের পরে সবচেয়ে আলোচিত খবর ছিলও, কার ঘাড়ে চড়ে ফিরবে মাশরাফির দায়িত্ব? উত্তর পেতে কত জল ঘোলা করলো মিডিয়া কর্মীগণ। শেষমেশ বিসিবি একটা চমক দিয়েছেন। কম আলোচিত হওয়া তামিমকেই বেছে নিয়েছেন। মজার ব্যাপার হলও, বিদায়ী কাপ্তান মাশরাফি তামিম এর ঘাড়ে চড়ে শেষ ম্যাচে মাঠ ছেড়েছেন। পরবর্তীতে তামিম ম্যাশের আসনে বসেছেন। রূপকথার মতো হলেও আলোচিত প্রশ্নের প্রতীক্ষিত উত্তরটা যেন অনেক আগে মাঠেই নির্ধারণ করে রেখেছিলেন বিসিবি।

আসলে আধুনিক ক্রিকেটে অধিনায়কের দল সাজাতে এবং পরিচালনা করতে অনেকটা কৌশলী হতে হয়। পরিস্থিতি অনুযায়ী খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হয়। আগ্রাসী মেজাজে প্রতিপক্ষের উপর চড়াও হতে হয়। তাতে সাফল্যের হার বৃদ্ধি পায়। বলা হয়ে থাকে, ভদ্রলোক মুশফিক মাঠে অনেকটা আত্মরক্ষামূলক দায়িত্ব পালন করতেন। আর তাই অধিনায়ক মুশফিককে পুনর্বার দেখা যায়নি নেতৃত্বের ঝাণ্ডা হাতে।

তবে পুনরায় সময় হলে মুশিকে পুনর্বার অধিনায়কত্বের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। পরিসংখ্যান বলে, অধিনায়ক মুশফিকের ব্যাট সাধারণ মুশফিক থেকে বেশি দায়িত্ববান কিংবা অধিক চওড়া। তাতে ধারাবাহিক ব্যাটিংয়ের সাথে ধারাবাহিক জয়ও দেখা যেতে পারে। অন্তত টেস্টে মুশফিককে ভবিষ্যতে সুযোগ দিলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারে বাংলাদেশ দল।

লেখক: মুহা. ইকবাল আজাদ।

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ঢাকা/ইয়াসিন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়