ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ক্রিকেটার তৈরির কারিগর কোচ পিলু

আব্দুল্লাহ এম রুবেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ২১ মে ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
ক্রিকেটার তৈরির কারিগর কোচ পিলু

বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে সব সময় আধিক্য থাকে খুলনা বিভাগের ক্রিকেটারদের। সেটা যেমন পুরুষদের দলে তেমনি নারীদের ক্রিকেটেও। নারী ক্রিকেটের শুরুর ইতিহাস থেকে এখনও বদলায়নি সে চিত্র। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের ম্যাচে ৬ জনই ছিলেন খুলনা জেলার ক্রিকেটার। সে থেকে খুলনা থেকে এখনও পর্যন্ত ১২ জনেরও বেশী নারী ক্রিকেটার জাতীয় দলে খেলেছেন। আর এসব ক্রিকেটারের একজনই গুরু। তিনি হলেন ইমতিয়াজ হোসেন পিলু। তাঁর হাত ধরেই একে একে দেশের গর্ব হয়ে উঠেছেন সালমা, রুমানা, শুকতারাসহ আরও অনেক ক্রিকেটার।

২০০৬ সালে বিসিবি প্রথম নারী ক্রিকেট বিভাগ গঠন করে। তৎকালীন বিসিবির সভাপতি আলী আসগর লবীর আগ্রহেই কোচ পিলুর তখন মেয়েদের কোচিংয়ে আসা। তখনকার সভাপতি লবী হুট করে কোচ পিলুকে বললেন, খুলনায় মেয়েদের ক্রিকেট নিয়ে কাজ করতে হবে তাকে। আর এরপরই নেমে পড়েন তিনি।

কিন্তু মেয়ে ক্রিকেটার পাবেন কোথায়? তখন তো কোন মেয়েই খুলনায় ক্রিকেট খেলে না। পরে খুলনার স্থানীয় পত্রিকায় মেয়েদের ক্রিকেট একাডেমি চালু হচ্ছে এমন একটি বিজ্ঞাপন দেন। সেই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সাড়া আসতে থাকে। একটা সময় দলও গঠন হয়ে যায়। এক বছরের মধ্যেই পিলুর হাত ধরে জাতীয় দলে জায়গা করে নেন আইরিন সুলতানা, রেশমা আক্তার আদুরী, আয়েশা রহমান শুকতারা, সালমা খাতুন, তাহিন তাহেরা শম্পা। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে তার হাত ধরেই লাল সবুজ জার্সিতে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন জাহানারা, শায়লা শারমীন, সুলতানা ইয়াসমীন বৈশাখী, রুমানা খাতুন, তাজিয়া আক্তার।

আর এই কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ওই সময়ে নিজের কোচিংয়ের জন্য বেশ কিছু কোর্স সম্পন্ন করেন পিলু। এছাড়া বিসিবির ফিটনেস কোর্স, মেডিকেল কোর্স, লেভেল-এ, লেভেল-ওয়ান, লেভেল-টু (অস্ট্রেলিয়া) এবং লেভেল টু আপডেট কোর্স করেছেন এই কোচ।

কোচ ইমতিয়াজ হোসেন পিলু জানালেন, শুরুর গল্পটা মোটেও সহজ ছিলো না তাঁর জন্য। সহজ ছিলো না তার কাছে কোচিং করতে আসা মেয়েদের জন্যও। মেয়েদের কোচিং করাতে গিয়ে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। এখনও বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন জায়গায় বাধাপ্রাপ্ত হন। যদিও এক যুগেরও বেশী সময় পার করেছেন নারী ক্রিকেটার তৈরীতে।

শুরু থেকে জেলা ক্রীড়া সংস্থা, বিসিবি কিংবা অন্য কোন সংস্থার কোন সহযোগিতা ছাড়াই একাই পথ চলা শুরু করেন কোচ পিলু। গড়ে তোলেন মেয়েদের ক্রিকেট একাডেমি। যা শুরু থেকেই একেবারেই অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এখানে নিজেদের গড়ে তুলতে আসা মেয়েদের মাসে মাসে কোন টাকা দিতে হয় না। উল্টো প্রতি মাসেই বড় অংকের টাকা নিজের পকেট থেকেই যায় কোচ পিলুর।
 


কিন্তু তাতেও কোনো আক্ষেপ নেই পুরো দস্তুর ক্রিকেট পাগল এই মানুষের। কারণ, ক্রিকেট যে তাঁর রক্তে গাঁথা। ক্রিকেটের সঙ্গে নিত্য বসবাস নিশ্চিত করতে নিজেই ক্রিকেটার থেকে কোচ হয়েছেন। মাঠ সংকট, প্রশিক্ষণ যন্ত্রপাতির অভাব, কতিপয় মানুষের নিরন্তন অসহযোগিতা পায়ে মাড়িয়ে তাই নিজ উদ্যোমে এগিয়ে চলছেন সালমা ও রুমানাদের আরও বিকশিত করার লক্ষ্যে।

তাইতো, পিতৃতুল্য এ মানুষটিকে নিয়ে গর্বের শেষ নেই সালমাদের। ক্রিকেট ছাড়াও ব্যক্তিগত সমস্যা, পারিবারিক সংকট দেখা দিলে সালমা-রুমানাদের সবকিছুর সঠিক সমাধানের শেষ আশ্রয় হয়ে ওঠেন এই ‘পিলু স্যার’।

মেয়েদের ক্রিকেটে অসংখ্য ক্রিকেটার আসে দরিদ্র পরিবার থেকে। যাদের ক্রিকেট সামগ্রী কিনে নিয়মিত অনুশীলন করা বিলাসিতা করা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর তাদের জন্য হাজির পিলু স্যার। গত এক যুগে ক্রিকেটারদের সাহায্য করার জন্যই একাডেমি থেকে ব্যবসা করা তো দূরে থাক উল্টো নিজের পকেট থেকেই টাকা খরচ করেছেন তিনি। তাদেরকে ব্যাট, প্যাড, গ্লাভস কিনে দিয়েছেন। আর এই চিত্র শুধু মেয়েদের ক্রিকেটেই নয়, ছেলেদের বেলায়ও।

খুলনার কোন ক্রিকেটার যদি ভালো কিছু করে, আর তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থা যদি ভালো না হয়, পিলু স্যার ছুটে যান তাঁর কাছে। নিজ পকেটের টাকা দিয়ে বিভিন্ন ক্রিকেট সামগ্রী কিনে দেন তিনি। গত এক যুগে এমন অসংখ্য উদাহরন সৃষ্টি করেছেন ইমতিয়াজ হসেন পিলু। শুধু তাই নয়, তার একাডেমি থেকে যখনই কোন মেয়ে জাতীয় দলে জায়গা পেয়েছেন, তখনই ক্রিকেট ব্যাট, প্যাড, গ্লাভস, ব্যাগসহ পুরো ক্রিকেট কিটস কিনে ওই ক্রিকেটারকে উপহার দিয়েছেন তিনি।

ইমতিয়াজ হোসেন পিলু কেবলমাত্র নতুন ক্রিকেটার তৈরী করেই থেমে থাকেননি। দল হিসেবেও খুলনার মেয়েদের এনে দিয়েছেন ঈর্ষণীয় সাফল্য। এক সময় মেয়েদের জাতীয় লিগ হতো জেলা দলের হিসেবে। তিনবারের এই প্রতিযোগিতায় তিনবারই খুলনাকে চ্যাম্পিয়ন করেছেন তিনি। আর পরবর্তীতে এখনও পর্যন্ত ৮ বার হওয়া বিভাগীয় দলের জাতীয় লিগে খুলনাকে শিরোপা এনে দিয়েছেন ৫ বার। একই রকম সাফল্য মেয়েদের ক্লাব ক্রিকেটেও। মোট ১০ বার অনুষ্ঠিত হওয়া মেয়েদের প্রিমিয়ার ক্রিকেটে মোহামেডান ক্লাব এখনও পর্যন্ত তাঁর হাত ধরে ৬ বার শিরোপা ঘরে তুলেছে।

সময়ের সাথে সাথে অনেক প্রতিবন্ধকতা কাটলেও মেয়েদের ক্রিকেটে এখনও সমস্যার অন্ত নেই। মাঠ সংকট, নতুন নতুন খেলোয়ার তৈরীর উদ্যোগ না থাকার কষ্ট ভাবিয়ে তোলে কোচ ইমতিয়াজ হোসেনকে। আঞ্চলিকতা, প্রতিহিংসা অনেকে ক্ষেত্রে মেয়েদের ক্রিকেটে প্রভাব পড়তে পারে বলেও উদ্বীগ্ন তিনি।
 


আশাবাদী কোচ পিলু অবশ্য আশা ছাড়েন না। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, সুযোগ-সুবিধা পেলে খুলনা অঞ্চল থেকে আগামীতে আরও প্রতিভাবান ক্রিকেটার গড়ে উঠবে বলে বিশ্বাস করেন তিনি। যদিও অনেকটা অভিমান জমে আছে ইমতিয়াজ হোসেন পিলুর কণ্ঠে। এখন আর নতুন কোন ক্রিকেটার তার একাডেমিতে আসতে চাইলে তিনি উৎসাহিত করেন না। ফলে পরবর্তী পর্যায়ে খুলনা থেকে নারী ক্রিকেটার উঠে আসা নিয়ে কিছুটা শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। 

কোচ ইমতিয়াজ হোসেন পিলু এই ক্রিকেট কোচিং থেকে অনেক সম্মান পেয়েছেন তবে না পাওয়ার গল্পটাও তার বেশ বড়। আক্ষেপ করেই বলছিলেন, ‘স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত সব জায়গাতেই আমার কাজ নিয়ে সমালোচনা। নানা ভাবে আমাকে কাজ করা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। খুলনা জেলা ক্রীড়া সংস্থা অনুশীলনের জন্য কখনও আমাকে মাঠ ব্যবহার করতে দেয় না। শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে অনুশীলন করতে গিয়ে বিসিবিরও বাধার সম্মুখীন হয়েছি বারবার। এসব ক্ষেত্রে পুর্ণ সহযোগিতা পেলে হয়তো খুলনাসহ দেশের মেয়েদের ক্রিকেট আরও অনেক বেশী এগিয়ে যেতে পারতো।’

মেয়েদের জাতীয় ক্রিকেট লিগ নিয়ে একাই শুরু থেকে লড়াই করে আসছেন পিলু। বলেন, ‘জাতীয় লিগ নাম হওয়ার কারণে যে অঞ্চলের মেয়ে সেই অঞ্চলেই খেলার কথা। অথচ শেষ পাঁচ/ছয়টা জাতীয় লিগে সাম্যতার কথা বলে সব টিমে জাতীয় দলের ক্রিকেটার ভাগ করে দেয়। ভাগ শেষে দেখা যায় খুলনায় মাত্র ২ জন, অন্যদিকে সিলেটের নিজেদের কোন জাতীয় দলের ক্রিকেটার না থাকলেও তারা পাচ্ছে ৪/৫ জন। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে যতবার কথা বলতে গিয়েছি ততবার ক্রিকেট বোর্ডে আমার দুর্নাম হয়েছে।’

আর এসব কারণে যে কয়েকজন পুরোনো নারী ক্রিকেটার আছেন তাদের নিয়েই আপাতত পথ চলছেন কোচ ইমতিয়াজ হোসেন পিলু। নতুন কোন ক্রিকেটার আসলে তিনি নিতে চান না। তাহলে ভবিষ্যৎ কি হবে খুলনার নারী ক্রিকেটের, দেশের নারী ক্রিকেটের..কোচ ইমতিয়াজ হোসেন বললেন, ‘এত এত অনিয়ম, এত এত অসহযোগিতার বিরুদ্ধে আর কতক্ষন এই বয়সে একা লড়াই করে পারবো। সেই সাথে এখন অর্থনৈতিক দিকটাও ভাবতে হচ্ছে। প্রতি মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা শুধু অনুশীলনের পিছনে আমার খরচ হয়। সব মিলিয়ে অনেক তো সম্মান আর অসম্মান দুটোই পেলাম।’

খুলনার মেয়েদের খেলাধুলায় আরও বেশী সম্পৃক্ত করার জন্য স্থানীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অনেক দায়িত্ব থাকলেও সেটা তারা করতে পারছে না বলে মনে করেন পিলু। বলেন, ‘জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থা একেবারেই নিস্ক্রিয়। তারা মেয়েদের কোন কাজই করে না। মেয়েদের তাদের নিয়মিত একটিভিটজ থাকলে সেখান থেকে বাছাই করেও ক্রিকেটার নিয়ে আসা যেতো।’

২০২১ সালে প্রথমবারের মতো নারীদের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে। সেই বিশ্বকাপে স্বাগতিক বাংলাদেশই। নারীদের বয়স ভিত্তিক ওই বিশ্বকাপ নিয়ে এরই মধ্যে বিসিবি বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বিসিবির সেই উদ্যোগ খুলনায় এসে পৌছাঁয়নি। বিসিবির পূর্ণ সহযোগিতা পেলে যেটুকু সময় আছে সেই সময়েই মেয়েদের নিয়ে কাজ করতে চান পিলু। আর কাজ করতে পারলে সফল হবেন বলে বিশ্বাস আছে সফল এই কোচের। বলেন, ‘অহংকার করে বলছি না, আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার মধ্যে খেলোয়াড় তৈরী করার গুণটা দিয়েছেন। এখনও যদি কাউকে মনে হয় খেলোয়াড় হিসেবে তৈরী করবো, তো ইনশাআল্লাহ তাকে তৈরী করেই ছাড়বো এ বিশ্বাস আমার আছে।’



ঢাকা/রুবেল/কামরুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়