ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

গ্রানাইট স্ল্যাবে পরীক্ষা, লেজের ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং আনন্দ

চট্টগ্রাম থেকে ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৩১, ২৮ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ২০:৫৯, ২৮ জানুয়ারি ২০২১

অনুশীলন হতে হয় প্রাণবন্ত। তাতে থাকতে হয় বৈচিত্র্য, তরতাজা স্মৃতি। দিতে হয় কঠিন পরীক্ষা, আনন্দময় মুহূর্ত যোগ করে বাড়তি উন্মাদনা। যেখানে কখনও শাসন করেন গুরু, কখনও ভাসান প্রশংসায়। ভুল শুধরে শেখান নতুন কিছু। আবার একই ভুলে শাস্তিও দেন।

অনুশীলনে ঠিক এমনই একটি দিন কাটালেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা। সাকিব আল হাসান ছাড়া জাতীয় দলের সবাই বৃহস্পতিবার অনুশীলন করেছে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে। অনুশীলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটারদের অনুশীলন পাখির চোখে পরখ করেছে রাইজিংবিডি। অনুশীলনের সেসব খণ্ডচিত্র তুলে ধরা হলো:

গ্রানাইট পাথরের স্ল্যাবে তামিম, মুশফিক, মুমিনুল

‘তোমাকে ঠিক এখান থেকে বলটা করতে হবে। ওরা (ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসার) তো লম্বা-লম্বা। একটু জোর দিলেই শর্ট হয়ে যাবে। আমি পুল করার অনুশীলন করবো।’– নেট বোলারকে এভাবেই বল ছোড়ার নির্দেশনা দিচ্ছিলেন মুশফিকুর রহিম। এরপর গেলেন পূর্ব পাশের নেটের বাইরে। সেখানে আগে থেকেই বিছানো ছিল গ্রানাইট পাথরের স্ল্যাব। নেট বোলার একেকটি বল ছুঁড়ছেন। সেটা পুল করছেন মুশফিক। বারবার বলে ওঠছেন, ‘গুড, পারফেক্ট, সাব্বাস।’

নেটে গ্রানাইটের স্ল্যাব কেন? বাংলাদেশ দলের অনুশীলনে গ্রানাইট পাথরের স্ল্যাব ব্যবহার বেশ পুরোনো পদ্ধতি। তাতে ফেলা হলে বল একটু বেশিই লাফায়। বাড়তি বাউন্সের বিপক্ষে প্রস্তুতির সেই পুরনো ফর্মুলাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসারদের সামলাতে ব্যবহার করছেন মুশফিক, তামিম ইকবাল, মুমিনুল হকরা। দিনের শুরুতে তামিম। মধ্যভাগে মুশফিক ও সবশেষে মুমিনুল গ্রানাইটের স্ল্যাবে ব্যাটিং অনুশীলন করে নিজেদের ঝালিয়ে নেন।

বাংলাদেশের সাবেক কোচ জেমি সিডন্স একবার বাংলাদেশ দলের অস্ট্রেলিয়া সফরের আগে গ্রানাইট পাথরের স্ল্যাব আনিয়েছিলেন অনুশীলনে। এরপর থেকে উপমহাদেশের বাইরের প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলতে নামলে এমন অনুশীলন করেন ব্যাটসম্যানরা। 

কাটের সমার্থক শব্দ স্লাইস

গ্রানাইট পাথরে টেস্ট অধিনায়ক মুমিনুলকে বল ছুড়ছিলেন নাঈম শেখ। রায়ান কুক মুমিনুলের ব্যাটিং দেখতে চলে আসেন নেটে। শুরুতে কয়েকটি বল দেখার পর মুমিনুলের কাছে গিয়ে বলেন, ‘মুমিনুল সব ঠিক হচ্ছে। আরেকটু রিফ্লেক্স বাড়াতে হবে।’ সেই সঙ্গে যোগ করলেন, ‘কাট না করে স্লাইস করতে হবে। বলো তো কাটের আরেকটি সমার্থক শব্দ কী?’

মুমিনুল চুপ করে রইলেন। কুকই বললেন, ‘স্লাইস।’ কুক বোঝাতে চাইলেন, কাট করে বল হাওয়ায় না ভাসিয়ে স্লাইস করতে। তাতে বল মাটি কামড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। এজন্য ডানহাতের পজিশন একটু উপরের দিকে নিয়ে যেতে হবে।

শুরুতে নিজের গ্রিপের কথা বলে অনাগ্রহ দেখালেও কুকের পরামর্শ মেনে মুমিনুল কয়েকটি স্লাইস খেললেন। দূর থেকে দেখে মনে হলো, মুমিনুল স্লাইসে যুৎসই কিছু খুঁজে পেলেন। হাসিমুখে নেট ছাড়ার আনন্দ চোখেমুখে স্পষ্ট ছিল।

টম অ্যান্ড জেরি

মুশফিক ও মেহেদী হাসান মিরাজ যেন বাংলাদেশ দলের ‘টম অ্যান্ড জেরি’। অনুশীলনে তাদের তর্কাতর্কি হবেই! তাদের লড়াই শেষ হয় মধুর ভালোবাসায়, হাসি আর উচ্ছ্বাসে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।

শুরুতে একটি এলবিডাব্লিউ নিয়ে তাদের দ্বন্দ্ব। মিরাজের একটি বল লাগে মুশফিকের প্যাডে। মিরাজের আউটের আবেদন। অন্যদিকে মুশফিকের দাবি বল স্টাম্প মিস করবে। তাদের তর্ক থামাতে ব্যাটিং কোচ জন লুইস দুইজনকে বলেন, ‘কুল, কুল।’ আবার মিরাজের একটি লেন্থ বল সুইপ করে মুশফিক বলে ওঠেন, ‘এটা চার।’ মানতে নারাজ মিরাজ, ‘ওখনে তো ফিল্ডার থাকবে।’ মুশফিকের জোর গলায় পাল্টা উত্তর, 'তোর কয়টা ফিল্ডার লাগে। তোর ফিল্ডার তো স্কয়ার লেগ ও মিড উইকেটে। ওইখানে তো ফাঁকা।’

তাদের লড়াই তখনও শেষ হয় না। এবার মিরাজের শর্ট বল সময় নিয়ে পুল করে মুশফিক পাঠালেন দৃষ্টিসীমার বাইরে। এবার মুশফিক বলে ওঠেন, ‘এটা চার হয়নি ১০ রান হয়েছে।' শেষমেশ মিরাজ লড়াইয়ে শান্তির পতাকা উড়িয়ে বলেন, ‘ভাই, আপনি তো মারি দিছেন, ওরা (ওয়েস্ট ইন্ডিজ) তো মারতি পারবি না।'

লেজের ব্যাটসম্যানদের কোচ লিটন

লেজের ব্যাটসম্যানদের নিয়ে রাসেল ডমিঙ্গোর বিশেষ ক্লাস চলল বন্দরনগরীতে। তবে কোচের ভূমিকায় রইলেন লিটন দাশ। ইবাদত, খালেদ, মোস্তাফিজদের পরামর্শ ও টেকনিক দিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখলেন লিটন। যেমন নেটে ইবাদত ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে লিটন চিৎকার করে বলেন, ‘ইবা…স্টান্সে একটু নিচু হয়ে দাঁড়া।’

এরপর নেট থেকে বেরিয়ে আসার পর ইবাদতকে লিটন কাছে নিয়ে বলেন, ‘ডান পা ও বাম পা পজিশন ঠিক রেখে ব্যাটিং করতে হবে। এক পায়ের সঙ্গে আরেক পায়ে সম্পর্ক।’ এছাড়া মোস্তফিজ, খালেদ আহমেদকে তাদের ব্যাটিং পজিশন ঠিক করা নিয়ে পরামর্শও দিয়েছেন লিটন। নেটে ব্যাটিংয়ের সময় তাদের সাহস যোগাতেও দেখা গেছে। 

খালেদ আহমেদের ২০ বলের চ্যালেঞ্জ

বোলিং শেষে ব্যাটিংয়ে গেলেন খালেদ। লেজের এ ব্যাটসম্যানকে ডমিঙ্গোর কড়া বার্তা, ’২০ বল টিকতে হবে।’ ডমিঙ্গো যেখানে পরীক্ষায় ফেলেন খালেদকে, সেখানে কুক সাহায্যে এগিয়ে আসেন। কুক বলেন, ‘মাথা উঁচু করে খেলতে হবে। বলটা দেখতে হবে। খেলার বল পেলে মারবে।’ এভাবে কিছুক্ষণ কাটিয়ে দেওয়ার পর ডমিঙ্গো জিজ্ঞেস করেন, ‘কয় বল গেলো?’ খালেদের উত্তর, ‘লাস্ট টু।’ ডমিঙ্গো, ‘মোটেও না। আরও ৫ বল খেলবে। আশা করি তুমি পারবে।’ 

কোচ সাহস দেওয়ায় যেন জ্বলে উঠলেন খালেদ। দারুণ একটি কভার ড্রাইভ খেলেন শুরুতেই। 'নাইস শট' বলে ডমিঙ্গোর চিৎকার। কুক তো দৌড়ে গিয়ে খালেদের সঙ্গে ফিস্ট বাম্প করলেন। স্পষ্ট বাংলায় বললেন, 'বেশি ভালো, বেশি ভালো।' ২০ বলের চ্যালেঞ্জে টিকে গেলেন খালেদ।

লেগস্টাম্পে গার্ড নিয়ে অফস্টাম্পে কেন?

ব্যাটিংটা মনে হয় একটুও পছন্দ করেন না ইবাদত। বোলিংয়ে শতভাগ পরিশ্রম দেখালেও ব্যাটিংয়ে একেবারেই নড়বড়ে তিনি। তাইতো ব্যাটিংয়ে নিজের মার্কটাও ঠিক মতো নেন না! লেজের ব্যাটসম্যানদের অনুশীলনের দিনে ব্যাটিং পেয়েছিলেন ইবাদতও। কিন্তু ব্যাটিংয়ে নেমেই গড়বড় করে দেন। আম্পায়ারের ভূমিকায় বাংলাদেশের কম্পিউটার অ্যানালিস্ট শ্রীনিবাস চন্দ্রশেখর। তার থেকে লেগস্টাম্পে গার্ড নিয়ে অফস্টাম্পে দাঁড়িয়ে ইবাদত। মেজাজটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি শ্রীনিবাস। বলে ওঠেন, ‘তুমি লেগস্টাম্পের গার্ড নিয়ে অফস্টাম্পে কেন দাঁড়িয়েছ?' এরপরও ঠিক জায়গায় দাঁড়াতে পারেননি। রায়ান কুক এক বল করার পর তার মার্ক ঠিক করে আসেন।

লেজের ব্যাটসম্যানদের থেকে রান চায় বাংলাদেশ

লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের থেকে রান পাওয়া মানেই লড়াইয়ে এগিয়ে যাওয়া। অথচ শেষ দুই বছরে বাংলাদেশের লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানরা রান পাচ্ছেন না। রান পাওয়ার গড়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে আফগানিস্তান ও আয়ারল্যান্ড থেকে পিছিয়ে। এজন্য তাদের ঝালাইয়ে কমতি রাখছে না বাংলাদেশ। কম্পিউটার অ্যানালিস্ট শ্রীনিবাস বলেন, ‘লোয়ার অর্ডারদের কাছ থেকে টেস্টে রান চাই আমরা। ওরা যেন উইকেটের মূল্য বুঝতে পারে এবং সহজে আউট না হয়। বল দেখে সরে না গিয়ে যেন লড়াই করে। শুধু টিকে থাকাই নয়, ওরা রানও যেন করতে পারে, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে।’

চট্টগ্রাম/ফাহিম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়