ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

পুজারা শৈলীর বিশেষত্ব

বোরহান উদ্দিন জাবেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৮, ২৯ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১০:২০, ২৯ জানুয়ারি ২০২১
পুজারা শৈলীর বিশেষত্ব

সাবেক অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেলকে তো সবাই চেনেন। সমালোচক শ্রেণীর তালিকা করলে এই 'ভদ্রলোক' উপরের সারিতেই থাকবেন। সেই চ্যাপেল যদি কারো গুণগান করে বসেন, আলাদা করে গুরুত্ব দিতেই হয়। ২০১৮-১৯ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ভারতের প্রথম বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি জয়ের সময়ই সেই চ্যাপেল আখ্যা দিয়েছিলেন 'কোহলির রাজ্যে পুজারাও বিশেষ কিছুই'। প্রতিপক্ষ যেখানে ছক কষে বিরাট কোহলি নামক রান মেশিনের জন্য, সেখানেই সিলেবাসের 'অতল' থেকে উঠে আসেন চেতেশ্বর পুজারা। লড়াই করে যান নিজের হার না মানা মানসিকতায়। সবশেষ অস্ট্রেলিয়া সফরের সিরিজের কথাই ধরুন না। ২০১৪-১৫ মৌসুমের বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিতে কোহলির অতিমানবীয় পারফরম্যান্স। পরের সিরিজও আলোর পুরোটাই কোহলির ওপর। তিন সেঞ্চুরিতে ৫২১ রান করে মঞ্চটা নিজের করে নিয়েছিলেন পুজারা। স্বীকৃতিস্বরূপ হয়েছিলেন সিরিজসেরা।

সিরিজে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৫৮ রান এসেছিল ঋষভ পান্তের ব্যাট থেকে। ২৮২ রান করে তালিকার তৃতীয় স্থানে কোহলি। প্রতিপক্ষের সেরা ব্যাটসম্যান মার্কাস হ্যারিসের ব্যাট থেকে এসেছিল ২৫৮ রান। এতটুকুতে সিরিজে পুজারার ব্যাটিং শৈলী ফুটে ওঠে। কিন্তু পুজারার মাহাত্ম্য তো শুধু রান করায় নয়। পূজারার মাহাত্ম্য 'উইকেটের জন্য' বোলারকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেওয়ায়! এই নিঃশেষ করে দেওয়ার কাজটা করতে গিয়ে সাত ইনিংসে পুজারা খেলেছেন সিরিজের সর্বোচ্চ ১২৫৮ বল। বলের হিসেবটা কেন দিচ্ছি? বুঝতে পারবেন ঠিক পরের বক্তব্যে। সিরিজে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬৮৪ বল খেলেন কোহলি। এই তথ্যটাই ব্যাটসম্যান পুজারার বিশেষত্ব। এই ছোট্ট পরিসংখ্যানটাই প্রমাণ করে সাফল্যের কাজটা ঠিক কতটা নিখুঁতভাবে সাজিয়ে দেন তিনি।

ভারতের ঐতিহাসিক সাম্প্রতিক সিরিজ জয়ের কথাই ধরা যাক না। অ্যাডিলেডে '৩৬' কেলেঙ্কারির পর ভারত যে 'ব্রিসবেন মহাকাব্যের' জন্ম দেবে, বাজি ধরতে বললে আপনিও হয়তো পিছু হটতেন। পুজারার জন্য ব্রিসবেনের আগে একটু মেলবোর্নে ফেরা যাক। ঘুরে দাঁড়ানোর দ্বিতীয় টেস্টে মেলবোর্নে অবশ্য পুজারাকে নিয়ে কোনও গল্প নেই। তাই বরং সিরিজের তৃতীয় টেস্টের ভেন্যু সিডনিতে ফেরা যাক। অজিদের প্রথম ইনিংসের ৩৩৪ রানের জবাবে ভারত অলআউট ২৪৪ রানে। ১৭৬ বল খেলে পুজারার ৫০ রান নিয়ে চারদিকে সমালোচনার ঢেউ। প্রসঙ্গ পুরানো। পুজারার স্ট্রাইক রেট। ছোটবেলা থেকেই স্ট্রাইক রেট নিয়ে আলোচনায় অভ্যস্ত তিনি। ক্রিকেটের ভাষায় এই স্ট্রাইক রেট অর্থাৎ ধীরে খেলার জন্য অনূর্ধ্ব-১৬ এশিয়া কাপের দলে জায়গা হয়নি পুজারার। তখনও বিরক্ত হননি। সিডনির প্রথম ইনিংস শেষেও পুজারা বিরক্ত হননি। তিনি জানেন এটাই তার খেলা। এই খেলা দিয়েই বারংবার দলকে উদ্ধার করেছেন।

দ্বিতীয় ইনিংসে অজিরা ৩১২ রানে ইনিংস ঘোষণা করলে ভারতের সামনে জয়ের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ৪০৭ রানের। সিডনিতে চতুর্থ ইনিংসে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড অজিদের। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২০০৬ সালে রেকর্ড ২৮৮ রান তাড়া করে জিতেছিল অজিরা। ম্যাচে ফেরা যাক। পঞ্চম দিনের সকালে উইকেটে আসেন পুজারা। জয়ের ভারী পাল্লাটা তখনও স্বাগতিক দিকেই। একে একে ড্রেসিংরুমে ফিরতে দেখেন রোহিত শর্মা এবং আগের টেস্টের নায়ক একইসঙ্গে অধিনায়ক আজিঙ্কা রাহানেকে। জুটি গড়েন তরুণ ঋষভ পান্তের সঙ্গে। দলে যার জায়গা 'তখনও নড়বড়ে'। তরুণ সঙ্গীকে সাহস দিয়েছেন। ইনিংস মেরামতের সুযোগ দিয়েছেন। নিজে খেলেছেন স্বভাবসুলভ ২০৬ বলে ৭৭ রানের ইনিংস। ইনজুরি সামলে হানুমা বিহারি ও রবিচন্দ্রন অশ্বিন যে বাইশ গজের যুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। মঞ্চটা তো পুজারাই তৈরি করা। অজিদের গ্যাবা দুর্গ চূর্ণ করার সমীকরণে কোনও অংশে পিছিয়ে নেই সিডনির লড়াকু এই ড্র।

এবারের যাত্রাটা সেই ব্রিসবেনের দুর্গ গ্যাবা সমারোহে। মাথা উঁচু করে যেখানে ৩৩ বছরের অজেয় অজি সাম্রাজ্য তখনও টিকে ছিল। ৩২৮ রানের টার্গেটে পঞ্চম দিনের সাতসকালে আউট রোহিত। উইকেটে আসলেন ভারতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান পুজারা। ভারতের জয় তখনও অলীক কল্পনা। গ্যাবায় সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ডই যে ২৩৬ রান। অবশ্য এই মাঠেই ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার ৪৯০ রানের টার্গেটে ৪৫০ রানে অলআউট হয়েছিল 'আনপ্রেডিক্টেবল' পাকিস্তান। হাল ছাড়ে না ভারত। উইকেটে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন পুজারা। অপরপ্রান্তে দুর্দান্ত খেলতে থাকা শুভমান গিলের সঙ্গে তার জুটিও জমে উঠেছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বৃষ্টির দুশ্চিন্তা ততক্ষণে উবে গেছে। অজিরাও সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। উইকেটের 'নিশানা' বুঝে শর্ট বলকে মোক্ষম হাতিয়ার ভেবে নেয় অজিরা। সেই শর্ট বলের বডিলাইন বাউন্সারে জর্জরিত পুজারা। যেই শর্ট বলের লাইনে চোখ রেখে ডিফেন্স করা শিখেছেন পুজারা। আইপিএলে দল না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হওয়ার বদলে কাউন্টি ক্রিকেট খেলে সিমিং কন্ডিশনে নিজেকে পোক্ত করেছেন যে পুজারা, সেটার ফল তো হাতেনাতে পেয়েছেন আগের সিরিজেই।

সেই পুজারা শর্ট বলের নিশানা থেকে চোখ সরিয়ে বারবার সপে দিয়েছেন নিজের বুক, পাঁজর, হাত-পা। তবে কেন এই আত্মসমর্পণ! শর্ট অফ লেংন্থের ফাটল ধরা যে জায়গাটা থেকে কামিন্স বডিলাইন বাউন্সার জেনারেট করছিলেন পুজারা চাইলে ব্যাট এগিয়ে ডিফেন্স করতে পারতেন! তাতে কামিন্সের কৌশলের কাছে মার খেয়ে যেতেন। বল গ্লাভস ছুঁয়ে স্কয়ার লেগ কিংবা উইকেট কিপারের হাতে জমা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। তাইতো ব্যাটের বদলে শরীরটাই নিংড়ে দিয়েছেন পরিস্থিতি বিবেচনায়। যা দেখে হাজার মাইল দূর থেকে সহধর্মিণী পুজা পাবারি টিভি পর্দা থেকে বারবার চোখ সরিয়ে নিয়েছেন। বাবার শরীরে চুমু এঁকে সব ব্যাথা সারিয়ে দেবে বলে মাকে অভয় দেন ছোট্ট অদিতি পুজারা। এভাবেই ক্রিকেটের সঙ্গে জীবনের সীমানার মিলনায়তন ঘটে।

সিরিজের চতুর্থ সর্বোচ্চ (২৭১) রান সংগ্রাহক পুজারা এ সিরিজেও খেলেছেন সর্বোচ্চ ৯২৮ বল। এ হিসেবটাকে চতুর্থ ইনিংসে ঘরের বাইরে এক সিরিজে 'বল মোকাবিলার' তুলনায় ধরলে, চতুর্থ ইনিংসে পুজারা চতুর্থ সর্বোচ্চ ৪২০ বল মোকাবিলা করেছেন। চতুর্থ ইনিংসে ঘরের বাইরে ১৯৮১ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে ৬৩৪ বল মোকাবিলা করে অ্যালান বোর্ডার আছেন তালিকার এক নাম্বারে।

অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টানা দুই টেস্ট সিরিজ জয়। ৭১ বছর আর ১১ সিরিজের অপেক্ষা শেষে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট সিরিজ জিতেছিল বিরাট কোহলির ভারত। দ্বিতীয় সিরিজ জয়টা ভারতের জন্য আরও ঐতিহাসিক। প্রথম টেস্টে '৩৬ রানে অলআউট' তার মধ্যে অন্যতম। প্রথম টেস্ট হারের পর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সফরকারী দলের মাত্র 'চতুর্থ' টেস্ট সিরিজ জয় এটি। প্রথম তিনটাতেই জড়িয়ে অজিদের প্রবল প্রতিপক্ষ ইংলিশদের নাম। চতুর্থবারে রেকর্ডের পৃষ্ঠায় যুক্ত হয়েছে ভারতের নাম। দুটো সিরিজেই সম্মুখ সমরের সৈনিক পুজারা।

টি টোয়েন্টির এই রমরমা যুগে ব্যাটসম্যানরা বিপজ্জনক শটের রেঞ্জ বাড়াচ্ছেন। হরেকরকম নতুন শটের পসরা সাজাচ্ছেন। ঘরের লিগ আইপিএলে দাপিয়ে যাচ্ছেন বিদেশি ক্রিকেটাররা। মোটা অংকের টাকার ঝনঝনানিতে ফুলে ফেঁপে উঠছে একেকজনের ব্যাংক একাউন্ট। সেখানে সুযোগ হয় না পুজারার। ঠিক সেই সময়ে রাজকোটের কোনও এক মহল্লা মাঠে পুজারা হয়তো সোজা ব্যাটে সাদা বলের ক্রিকেটের জন্য আরেকবার নিজেকে প্রস্তুত করছেন। তাতে তার আক্ষেপ নেই। যেমন আক্ষেপ নেই স্ট্রাইক রেট নিয়ে ছুটে আসা সমালোচনায়। উইকেট আঁকড়ে থেকে লড়াই করাতে পুজারার যত আনন্দ। দলের যদি উপকার হয় তাতেই খুশি তিনি।

যতটা সহজে ব্যাপারগুলো বলে দেওয়া গেলো, পুজারার জন্য কি কাজগুলো এতটা সহজতর ছিল? ক্রিকেটের নিয়মিত অনুসারী হলে ভোটের বাক্সে হয়তো 'না' জয়যুক্ত হবে। আবার পুজারা বলেই হয়তো ক্রিকেটের সেই অনুসারীই 'হ্যাঁ' জয়যুক্ত করবেন। হ্যাঁ জয়যুক্ত করার ব্যাপারটা একটু বলি। দুপুরের ঝলসানো রোদ থেকে বিকেলের মিঠে রোদ, 'কথি কম্পাউন্ড এপার্টমেন্টের' বুড়ো-বুড়ির থেকে আপামর সাধারণ সবাই জানেন ঠিকানাটা। রাজকোটের রেলওয়ে কলোনি থেকে ভলিবল কোট- বাবা অরবিন্দ ছোট্ট চিন্টুকে বোলারকে নিঃশেষ করে দেওয়ার মন্ত্রটাই শিখিয়েছেন সুনিপুণ দক্ষতায়।

চিন্টুর বয়স তখন সবে আট। টেস্ট ক্রিকেটের আবহ সংগীতটা চিন্টুর রক্তের সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন বাবা অরবিন্দই। বাসায় তৈরি মিনি প্যাড আর ঝকঝকে সাদা পোশাক পরিয়ে ছেলেকে মাঠে নিয়ে আসতেন অরবিন্দ। পৃথিবীর ব্যস্ততা একপাশে রেখে ছেলেকে বলের পর বল করে যেতেন অরবিন্দ। উইকেট-কিপার ব্যাটসম্যান অরবিন্দ পুজারা রঞ্জি ট্রফিতে খেলেছেন সৌরাষ্ট্রের হয়ে। নিজে খেলাটা খেলেছেন বলেই কি না ওইটুকু বয়সের একটা বাচ্চার মনোজগৎটা ভালোভাবে পড়তে পেরেছিলেন অরবিন্দ। ছেলে যাতে ক্রস ব্যাটে খেলে অভ্যস্ত না হয়ে পড়ে সেজন্য মাটিতে গড়িয়ে বল করতেন। এক্ষেত্রে অরবিন্দের ভয়টা ছিল নরমাল ডেলিভারি এক ড্রপে সোজা ব্যাটে গেলে ছেলে হয়তো ক্রস ব্যাটে খেলবেন। এভাবেই সোজা ব্যাটে খেলাটা আয়ত্ত করিয়েছিলেন ছেলেকে। অরবিন্দের চেষ্টা বৃথা যায়নি। বৃথা যেতে দেননি চিন্টু থেকে পুজারা।

ঢাকা/ফাহিম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়