ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ব্যাংকার থেকে টেস্ট ম্যাচ রেফারি 

চট্টগ্রাম থেকে ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:০৪, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৮:৫৩, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২১
ব্যাংকার থেকে টেস্ট ম্যাচ রেফারি 

বিকেএসপির প্রথম ক্রিকেট ব্যাচের ছাত্র ছিলেন তিনি। ক্রিকেট মাঠে ব্যাট-বলের ঠুকঠাক যেমন তার পছন্দ তেমনি পড়াশোনাতেও ব্যাপক আগ্রহ। সমানতালে চালিয়ে গেছেন দুটোই। পড়াশোনা করেছেন প্রতিষ্ঠিত হতে। ক্রিকেট তার কাছে প্যাশন।

জাতীয় দলের হয়ে দুই ওয়ানডে খেলেছেন। বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ, ৯৯’ দলে ছিলেন। লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলেছেন ৪০টিরও ওপরে। ব্যাট-প্যাড তুলে রাখার পর করপোরেট দুনিয়ায় পা রেখেছেন। সেখানেও সফল। কিন্তু ক্রিকেটাঙ্গন ছাড়তে চান না। এজন্য ম্যাচ রেফারির প্রতি ঝুঁকে গেলেন।

নানা অলিগলি পেরিয়ে ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত সংস্করণের ম্যাচ রেফারির দায়িত্ব পেলেন তিনি। বাংলাদেশ থেকে তিনিই প্রথম। এই নিয়ামুর রশিদ রাহুল থাকছেন বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট সিরিজে ম্যাচ রেফারি হিসেবে। 

ক্রিকেটার, ব্যাংকার এবং প্রথম টেস্ট ম্যাচ রেফারি; অদ্ভুত এক মেলবন্ধন নিয়ামুর রশিদ রাহুলের জীবনে। সেই গল্প শুনেছে রাইজিংবিডি-

প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে টেস্ট ম্যাচে ম্যাচ রেফারির দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছেন, কতটা রোমাঞ্চিত?

নিয়ামুর রশিদ রাহুল: নিশ্চিতভাবে আমি রোমাঞ্চিত। একটু ভয়ও লাগছে, ভয় লাগার কারণ সবকিছু ঠিকঠাক হয় কি না! ঠিকঠাক মতো হতে পারলেই ভালো। তবে আমি আত্মবিশ্বাসী যেহেতু ম্যাচ রেফারি হিসেবে অনেক দিন ধরে করছি। দুই-তিনটা সফরও করেছি। এজন্য ভালো করার আত্মবিশ্বাসটাও আমার আছে। আইসিসি আমাকে নিয়োগ দিয়েছে, আগের পারফরম্যান্স দেখে ভালো মনে করেছে বলেই নিয়োগ পেয়েছি। এজন্য বাড়তি রোমাঞ্চিত। ভালো করার জন্য পুরোটা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

টেস্ট ম্যাচ বলেই কি বাড়তি উন্মাদনা কাজ করছে?

নিয়ামুর রশিদ রাহুল: ম্যাচ তো ম্যাচই, তবে টেস্ট ম্যাচ করতে পারলে একটা সম্মানের ব্যাপার। স্বাভাবিকভাবে টেস্ট ম্যাচে একটু অন্য আমেজ থাকে সব সময়। টেস্ট ম্যাচে ম্যাচ রেফরি করা, টস করা, তারপর পুরো ম্যাচের ম্যাচ হেডঅফ পিসিটির সঙ্গে কাজ করা। যারা এখানে আম্পায়ার আছে তাদের সঙ্গে বসে মিটিং করা। অনেক কিছু শেখা ও বোঝা, একটা অভিজ্ঞতা তো হচ্ছে। একটা ধাপ এগিয়ে গেলাম বাংলাদেশের প্রথম হিসেবে। যদিও অল ক্রেডিট গোজ টু আইসিসি, আমার নিজের ইচ্ছায় তো কোনো কিছু করতে পারবো না। আমি আমার ভালো কাজ করলে সেই স্বীকৃতিটুকু পাবো। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সহযোগিতা তো সব সময় থাকে। 

আপনার ম্যাচ রেফারিংয়ের সফরটা সম্পর্কে জানতে চাই। কখন, কিভাবে শুরু করলেন? 

নিয়ামুর রশিদ রাহুল: আমি ম্যাচ রেফারি হওয়ার কোনো লক্ষ্য নিয়ে সফর শুরু করিনি। আমার আম্পায়ার হওয়ার ইচ্ছে ছিল। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে আম্পায়ারিং কোর্স করেছি। তারপর লেভেল টু পর্যন্ত কোচিংও করেছি। দু’চারটা সাক্ষাৎকারও দিয়েছি। কিন্তু যখন দেখলাম কোনোভাবেই কোনো কিছু হচ্ছে না তখন আমার বন্ধু আম্পায়ার মুকুল (মাসুদুর রহমান), আমাকে বলে, ‘‘রাহুল ম্যাচ রেফরিটা কর। এটা করলে ভালো। তোর সঙ্গে যায়, তোর পড়াশোনাসহ সব স্কিলই আছে।’’ সব কিছু মিলিয়ে ওর সাপোর্ট সে সময় আমি পেয়েছিলাম এবং আমি রেফারিংয়ে আসি। ওই সময় ক্রিকেট বোর্ডে জামাল বাবু ছিলো। ও আমাকে ম্যাচ রেফরি করার জন্য সাপোর্টটা দেয়। ওইভাবে আমার রেফারি হিসেবে যাত্রা শুরু হয়। আমি কখনো পেশা হিসেবে ম্যাচ রেফারিকে বেছে নেইনি। আমি এটাকে শখ বা ক্রিকেটে মাঠে থাকতে চেয়েছি বলে করেছি। কিন্তু যখন আম্পায়ার্স ক্রিকেট বিভাগ দেখলো যে, ভালোই করছি তখন এটাকে একটু ফ্যাশনেবল নেওয়ার চেষ্টা করেছি। এখন পর্যন্ত বিপদ আপদ হয়নি, আইনের মধ্যে থাকলে আসলে বিপদে পড়তেও হয় না।

আপনার পড়াশোনা ও পেশাদারি জীবন সম্পর্কে জানতে চাই?

নিয়ামুর রশিদ রাহুল: আমি বিকেএসপির ছাত্র। সেখান থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন থেকে অনার্স মাস্টার্স শেষ করি। এরপর আমি এমবিএ করি, ডিভাইস ইউনিভার্সিটি থেকে মার্কেটিংয়ের ওপর। এমবিএ করার পর এভাবেই চলছে। ২০০০ সালে ফল পাওয়ার পর পাপন স্যারের (নাজমুল হাসান) অধীনে বেক্সিমকোতে চাকরি শুরু করি। সেখানে আমরা ক্রিকেটও খেলতে পারতাম। তারপর ২০০৯ এ আমি সিটি ব্যাংকে দু’বছর চাকরি করি। এরপর আমি মিচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে যোগ দিই। এখানে ১১ বছর হতে চলছে। এক্সিকিউটিভ হিসেবে আছি।

ব্যাংকে চাকরির পাশাপাশি ম্যাচ রেফারিংয়ে দায়িত্ব পালন? সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটি জায়গা। কিভাবে সামলে নেন?

নিয়ামুর রশিদ রাহুল: আমার কর্মক্ষেত্র থেকে আমি অনেক সহযোগিতা পাই। আমার আগের এমডি আনিসুর খান ও এখনকার এমডি আমায় বেশ সাপোর্ট করছেন। ওনারা সবাই ক্রিকেটপ্রেমী। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি ছুটি জমিয়ে রাখি। যখন আমার ম্যাচ আসে তখন আমি আমার ছুটিগুলো কাজে লাগাই। আমি আমার ব্যাংকের কাজ ফাঁকি দিয়ে কোনো কাজ করি না। অবশ্য এর জন্য কারো না করো তো সাপোর্ট লাগে, সেক্ষেত্রে এমডি স্যার আমায় সাপোর্ট করেন। এছাড়া আমি যার আন্ডারে, তৌফিক আলম চৌধুরী, তিনিও আমায় অনেক সাপোর্ট করেন। তিনিও একজন ক্রিকেট প্রেমি। আমাদের নিজস্ব একটা ক্রিকেট টিম আছে।সব কিছু মিলে আমাদের মিচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে দারুণ ক্রিকেট আবহ। আমি প্রাক্তন ন্যাশনাল প্লেয়ার হিসেবে আলাদা সুবিধা নিই না।  তবে যদি কখনো লাগে তখন সবাই সেই সাপোর্ট আমায় দিবে।

আপনি বিকেএসপির প্রথম ক্রিকেট ব্যাচের ছাত্র। ক্রিকেট ক্যারিয়ার খুব একটা লম্বা হয়নি।৪০টি লিস্ট এ ম্যাচ খেলেছেন। জাতীয় দলের হয়ে দুইটি ওয়ানডে খেলেছেন। ম্যাচ রেফারি হিসেবে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?

নিয়ামুর রশিদ রাহুল: ৪০টি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলেছি ডাটাবেজ অনুযায়ী। এর আগে অনেক ম্যাচ খেলেছি সেগুলো হিসেবে আসেনি। জাতীয় দলের হয়ে দুইটি ওয়ানডে সেটা ঠিক। টেস্ট খেলার সুযোগ পাইনি। যখন রেফারিং শুরু করি তখন থেকে একটা লক্ষ্য ছিল টেস্টে ম্যাচ পরিচালনা করবো। সেই সুযোগটি এখন এসেছে। কোভিডের কারণে কিছুটা ভাগ্য সহায়তা করেছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে এই সুযোগটা যখন পেয়েছি, তখন ভালোভাবে কাজে লাগানো উচিৎ। অবশ্যই ক্যারিয়ার শেষে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত স্থানে দেখতে চাই। আইসিসি চাইলে আমরা আরও বেশি ম্যাচ পাবো। আরও ভালো করতে পারবো। এখন আইসিসি আমাদের কিভাবে দেখে না দেখে বা ক্রিকেট বোর্ড থেকে যে নামগুলো যায় কতটুকু কমিউনিকেশন করে কাজ করা যায়, সেটার বিষয়ে তো আমরা বলতে পারবো না। আমাদের কাজগুলো আমরা করে থাকি। আমাদের ভালো কাজ করছিই বলেই হয়তো দু’জনের মধ্যে একজনকে স্বীকৃতি করছে। সে জন্য তো অবশ্যই ভালো লাগার কথা।

টেস্ট অঙ্গনে ২০ বছর কাটানোর পর বাংলাদেশের কেউ টেস্ট ম্যাচে রেফারি হচ্ছেন। একটু লম্বা সময় লেগে গেল কি না?

নিয়ামুর রশিদ রাহুল: আসলে এই সেক্টরে একটু কম নজর দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ম্যাচ রেফারির সেক্টরটা। ২০ বছর পর যেহেতু ম্যাচ রেফারির কাজ আমরা করতে যাচ্ছি সেহেতু বোঝা যাচ্ছে সিনারিওটা। আগেই বললাম যে, কোভিড অনেক কিছু নিয়ে গেছে আবার অনেক ভালো কিছু দিয়ে গেছে। এটা একটা ভালো জিনিস, কোভিড ২০ বছর পর হলেও আমাদের দিয়ে গেছে। এখন এটা ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। এতে বাংলাদেশ ক্রিকেট ও আমাদেরই লাভ হবে। আমাদের প্রক্রিয়াটা অন্যরকম ছিলো, এখন ওই প্রক্রিয়া হয়তো ভিন্নভাবে আসবে।

এ সেক্টরে উন্নতির জন্য বিসিবির কি করা উচিত বলে মনে করছেন?

নিয়ামুর রশিদ রাহুল: আমরা এই জায়গায় পিছিয়ে আছি। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যেভাবে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা পেয়ে থাকে বা এলিট শ্রেণির আম্পায়াররা যেভাবে পেয়ে থাকে সেই সহযোগিতা আমাদের এই সেক্টরে একদমই নেই। বিদেশ থেকে যখন আম্পায়ার নিয়ে আসা হয়, বিপিএল বা অন্য কোনো ইভেন্টের জন্য বা কোনো ম্যাচ রেফরি নিয়ে আসা হয়, তাদের যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেওয়া হয় তা যদি আমরা পাই, সেটা খুব উচুঁ হতে হবে এমনটা নয়। হেলদি অ্যাকাউন্ট পেলে এই পেশাকে অনেকেই স্থায়ী হিসেবে নিতে পারবে।

আপনি কিভাবে ম্যাচ রেফারি হিসেবে কাজ করছেন?

নিয়ামুর রশিদ রাহুল: আমি ক্রিকেট বোর্ডের পেশাদার ম্যাচ রেফরি না। রকিবুল হাসান যেমন চিফ ম্যাচ রেফরি, তিনি পেইড ম্যাচ রেফরি, তিনি বিসিবির চাকরি করলেও আমি কিন্তু তা নয়। ক্রিকেট বোর্ডে আমরা ম্যাচ বাই ম্যাচ পেমেন্ট পাই। তবে এখানে যদি একটা ভালো এমাউন্ট দেওয়া হয় তখনই হয়তো আগ্রহটা আরও বেশি বাড়বে।

ঢাকা/রিয়াদ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়