ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মেহেদী রাঙা দিন

চট্টগ্রাম থেকে ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:২৪, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১০:০৪, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১
মেহেদী রাঙা দিন

মাঘের হিমেল সকালে কুয়াশা ভেদ করে রুটিনবাঁধা রক্তিম সূর্যটাও আজ অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি প্রখর ও তেজোদীপ্ত। কুয়াশা ঘেরা আঁধার পাশ কাটিয়ে দীপ্তি ছড়ানো লাল সূর্যটাও যেনো ভালো দিনের আবাহন ছড়িয়ে দিচ্ছে সর্বত্র।

ভোরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে পড়ন্ত বিকেলের রাঙা সূর্যটাও দীপ্তি ছড়াচ্ছে চতুর্দিকে। ওই অলোয় চট্টগ্রামের জহুর আহমেদের সবুজ গালিচা যেন শিল্পীর অরাধ্য ক্যানভাস। যে ক্যানভাস রাঙানো মেহেদী রঙে। প্রভাত গড়িয়ে মধ্যদুপুর এরপর অলস বিকেল…ঘড়ির কাঁটার প্রতিটি ক্ষণ মেহেদী হাসান মিরাজের রঙে রাঙা।

চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম দিন যে মুখগুলো ছিল বিমর্ষ, দ্বিতীয় দিন সেই মুখগুলো চিকচিক করছিল। সবটুকু কৃতিত্ব ওই মেহেদীর। ১০৩ রানের ঝকঝকে ইনিংসে চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় দিনটি বাংলাদেশের। প্রায় এক বছর পর সাদা পোশাকের ক্রিকেটে মাঠে নেমে বাংলাদেশর দলীয় রান ৪৩০। শেষ সেশনে ব্যাটিংয়ে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তুলে নেয় ৭৫ রান। 

বাংলাদেশের পুঁজিতে দুই ক্যারিবিয়ানের উইকেট। সঙ্গে ৩৫৫ রানের বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে থাকার তৃপ্তি তো আছেই। মিরাজের জন্য আজকের দিনটি কতটা স্পেশাল তা হয়তো নিজেও জানেন না! প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলছেন ২০১৪ থেকে। অথচ সাত বছর পর তার নামের পাশে যুক্ত হলো প্রথম তিন অঙ্ক। আরো গভীর পরিসংখ্যান পেলে হতচকিয়ে ওঠতে পারেন। ২০১৩ সালের এপ্রিলে মিরাজ প্রথম জাতীয় পর্যায়ের ক্রিকেট খেলেছিলেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে। অভিষেকে শ্রীলঙ্কা যুব দলের বিপক্ষে হাঁকিয়েছিলেন শতক। এরপর কতশত ম্যাচ খেলেছেন বিভিন্ন মঞ্চে, বিভিন্ন জার্সিতে। পারফরম্যান্সে দ্যুতি ছড়ালেও ছিল না শতক। সব মিলিয়ে ২৪৭ ইনিংস পর মিরাজ পেলেন শতক।

তিন অঙ্কের ইনিংসটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ করেছে বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানদের অহেতুক অস্থিরতা ও সম্ভাবনাময় ইনিংসগুলোর খুব সহজে ইতি টানায়। আগের দিনের সাদমান, মুমিনুল, মুশফিকের আউটের সঙ্গে আজ লিটন ও সাকিবের আউটের ধরণ ছিল হতশ্রী। নতুন দিনে মাত্র ৪ রান যোগ করে ওয়ারিক্যানের ভেতরে ঢোকানো বল অহেতুক ব্যাকফুটে খেলতে গিয়ে বোল্ড হন লিটন (৩৮)।

সাকিব দিনের প্রথম ঘণ্টায় ছিলেন নিয়ন্ত্রিত। বাড়তি কিছু করার চেষ্টা করেননি। ১১০ বলে পেয়ে যান ক্যারিয়ারের ২৫তম ফিফটি। দিনের একমাত্র বাউন্ডারিটি আসে ওয়ারিক্যানের বলে। এগিয়ে এসে মিড অফ ও এক্সট্রা কভারের মাঝ দিয়ে বল বাউন্ডারিতে। বড় ইনিংস খেলার জন্য চাই ভালো জুটি। মিরাজ তাকে সেই সঙ্গ দিচ্ছিলেন ভালোভাবে।

ক্রিজে নেমে শ্যানন গ্যাব্রিয়েলের শর্ট বল যেভাবে টাইমিং মিলিয়ে বাউন্ডারিতে পাঠান তা ছিল মনোমুগ্ধকর। আবার কেমার রোচের বল মিড অন দিয়ে হালকা ফ্লিক করে পাওয়া চারটি ছিল ধ্রুপদী। এভাবেই দুই ব্যাটসম্যান স্কোরবোর্ডে যোগ করেন ৬৭ রান। এরপর মনোযোগ হারান সাকিব। মধ্যাহ্ন বিরতির ৩৭ বল আগে উইকেট উপহার দেন রাকিম কর্নওয়ালকে। দীর্ঘদেহী স্পিনারের প্রথম সাফল্য।

মিরাজ সঙ্গী হারান। কিন্তু মনোবল হারালেন না। হাল ছাড়লেন না। মিরাজ জানতেন কোথায় যেতে হবে, দলের ঠিকানা কোথায়। নতুন সঙ্গীকে নিয়ে আরও ধারালো হয়ে ওঠে তার ব্যাট। কর্নওয়ালকে লেগ স্টাম্প থেকে সুইপ, অফস্টাম্পের বল গাইড কিংবা ওয়ারিক্যান  ইনসাইড আউট শটে কভারের ওপর দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকানো শটগুলো মুগ্ধতা ছড়ায়।

তাইজুল ইসলামের সঙ্গে ৪৪ রানের জুটি গড়ায় ২২ ও নাঈম হাসানের সঙ্গে ৫৭ রানের জুটি গড়তে রাখলেন ৩২ রানের অবদান। নাঈমের সঙ্গে জুটি গড়ার পথে মিরাজ জীবন পেলেন কর্নওয়ালের বলে, ৮৫ রানে। এক ওভার পর নাঈমের উইকেট তুলে নেন এনক্রুমাহ বোনার। শেষ উইকেটে মিরাজের সঙ্গী মোস্তাফিজুর রহমান। ৮ বছরের বন্ধুত্ব তাদের। বন্ধুর শতক পাওয়ার দিনে ৩ বল খেলে আস্থার প্রতিদান দেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।

পরের ওভারে মিরাজ পেয়ে যান শতক। পাঁচ উইকেটের অপেক্ষায় থাকা ওয়ারিক্যানকে কাট করে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে পাঠিয়ে ৯৩ থেকে ৯৭ রানে পৌঁছান ডানহাতি ব্যাটসম্যান। পরের বল সুইপার কাভারে ঠেলে আরও ২ রান। তৃতীয় বল ডটের পর চুতর্থ বলে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। যেটা মিরাজ কখনও ভুলবেন না, ভুলবে না বাংলাদেশও।

আটে নেমে চতুর্থ বাংলাদেশি হিসেবে শতক। দ্রুত রান তোলার তাড়ায় কর্নওয়ালকে উড়াতে গিয়ে লং অনে ক্যাচ দেন ১০৩ রানে। লড়াকু শতকের ইনিংসের শেষ ওখানে। ততক্ষণে বাংলাদেশের রান চূড়ায়।

এক পেসার নিয়ে বোলিংয়ে নেমে উড়ন্ত বাংলাদেশ। মোস্তাফিজুর রহমান ৭ ওভারের প্রথম স্পেলে ২ মেডেনে ১২ রানে নেন ২ উইকেট। ওপেনার জন ক্যাম্পবেলকে শুরুতে ৩ রানে এলবিডব্লিউ করান। রিভিউ নিয়ে বাংলাদেশ পায় সাফল্য। এরপর মোসলেকে প্রায় ইয়র্কার এক বলে এলবিডব্লিউ করে উইকেটের স্বাদ পান মোস্তাফিজ। আম্পায়ার আউট দিলেও রিভিউ নিয়েছিলেন। তাতে ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। 

দিনের বাকিটা সময় সামলে নেন অধিনায়ক ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েট (৪৯) ও বোনার (১৭) । তাদের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে এসেছে ৫১ রান।

প্রভাতের সূর্য নাকি বলে দেয় দিনের পূর্বাভাস। কিন্তু এবার তেমনটা হলো না! লিটন দিনের তৃতীয় ওভারে সাজঘরে ফিরে বিপদে ফেলেছিলেন। মেহেদীর রঙে দিনের বাকিটা সময় পুরোটাই বাংলাদেশের।

ঢাকা/রিয়াদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়