ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ডন `দ্য ব্রাডম্যান`

মশিউর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১৯, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৫:২১, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১
ডন `দ্য ব্রাডম্যান`

পৃথিবীর সুন্দরতম সাহিত্যের নাম কী হতে পারে? আমার কাছে একটা পারফেক্ট কাভার ড্রাইভ। কী নেই তাতে! সূক্ষ্ণ ব্যাকরণ, সঠিক স্ট্যান্ড, পারফেক্ট টাইমিং। আহ! লাইনের পর লাইন লিখে ফেলা যায়। প্রেমিকার চোখে শব্দ আসে না, একটা পারফেক্ট কাভার ড্রাইভ অচিরেই মনের শব্দাভাব মিটিয়ে দেয়। আমার প্রিয় ক্রিকেটার তত ভালো কাভার ড্রাইভ খেলতেন না। তিনি ইনজামাম, শচীন কিংবা লারার মতো ব্যাকরণ পছন্দ করতেন না। তিনি ছিলেন একজন, ‘দ্য অনলি ওয়ান’।

কল্পনাপ্রবণ মানুষের মনে এমন একজন মানুষ থাকে, যাকে কখনও সে দেখেনি। নিজের মনের মধ্যে কল্পনাশক্তি দিয়ে একটা চরিত্র তৈরি করে নেয় সে। যে থাকে না, আবার থাকে। যার অস্তিত্ব নেই, কিন্তু অনুভবে পাওয়া যায়। আমার প্রিয় ক্রিকেটারকে আমি চোখে দেখিনি, আমি জন্ম নেওয়ার ৯ বছর আগেই আমার প্রিয় ক্রিকেটার প্রয়াত হয়েছেন। তবে তিনি বেঁচে থাকবেন আজ, আগামীকাল, একশ বছর পরে, এক লাখ বছর পরেও। কারণ তিনি একজনই, তিনি ডন ‘দ্য ব্রাডম্যান’।

স্যার ব্রাডম্যানের অস্তিত্ব বেঁচে থাকার কারণ খুব সহজ একটা উদাহরণেই দেখানো যায়। ফুটবলে কেউ সর্বকালের সেরা হতে পারেননি। পেলে গত শতকের সেরা হয়েছেন, অবশ্য খোদ লাখ লাখ ব্রাজিলিয়ান মনে করেন ফুটবলে গত শতকের সেরা ম্যারাডোনা। এ যুগের অধিকাংশ মেসিকে মনে করেন সর্বকালের সেরা, আবার কেউ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে। ফুটবলে কখনও কেউ সর্বকালের সেরা হবেন না। কারণ ফুটবলে তো আর স্যার ডন ব্রাডম্যান আসেননি। পুরো ইংল্যান্ড ঘুরেও কোনও একজন ইংলিশের মুখ থেকে বের করতে পারবেন না যে স্যার ব্রাডম্যান ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা নয়।

ব্রাডম্যানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে আজ কি-বোর্ড ধরিনি। আজ তার জন্মদিনও নয়। তবুও প্রিয় ক্রিকেটারের সম্পর্কে দু’কলম লিখতে যে কোনও দিবস লাগবে না, তা স্বাভাবিক। প্রেমিকার রূপ দেখে প্রেমে পড়েছিলাম, ডনের প্রেমে পড়েছিলাম তাকে না দেখেই। ডনের প্রিয় শটটা ছিল খুবই আনকমন। ইউটিউবে স্যার ডন ব্রাডম্যান শট লিখে খুঁজলেই পেয়ে যাবেন। হলফ করে বলতে পারি আপনি খুব বেশি মানুষকে এই শট খেলতে দেখেননি। ইউটিউবে যিনি এই শটটা খেলেন তিনিও এক অস্ট্রেলিয়ান, নাম গ্রেগ ব্লেওয়েট।

ডনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হয় ১৯৩২-৩৩ এর ‘কুখ্যাত’ সেই অ্যাশেজে। ডন তখন জীবনের সেরা ছন্দে। পৃথিবীতে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসেনি, হিটলারের তাণ্ডবও শুরু হয়নি। ক্রিকেট চলছিল তার আপন গতিতে। আর তখনই ইউরোপ জুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছিলেন ডন।

১৯৩০’র দশকে ঘরোয়া মৌসুমে ডন ছিলেন দুর্দান্ত। প্রায় ৯৫ গড়ে ১৬৯০ রান তুলেন ওই বছর। ফলে ডাক আসে অ্যাশেজের জন্য যাচাই বাছাইয়ের টেস্টে। প্রথম ইনিংসে ১২৪ রান করেন ডন। অবশ্য দলের অন্য ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় ফলো অনে পড়ে ডনের দল। দ্বিতীয় ইনিংসে ক্যাপ্টেন উডফুল ডনকে ওপেনিংয়ে পাঠান আর বলে দেন যাতে তাড়াতাড়ি ফিরে না আসেন। কিন্তু ডন যা করে আসেন তাতে তার ত্রিশের অ্যাশেজে দলে ডাক পাওয়া নিশ্চিত হয়ে যায়। একজন পাকা সিরিয়াল কিলারের মতো বোলারদের স্বপ্ন, আশা খুন করে দিনশেষে ২০৫ রানে অপরাজিত থাকেন ডন এবং পরের দিন ২২৫ রানে আউট হন। ওই সময় তিনি প্রথম শ্রেণিতে তৎকালীন রেকর্ড ৪৫২ রান করেন এক ইনিংসে।

১৯৩০ এর অ্যাশেজে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল ইংল্যান্ডের। সেবার অ্যাশেজ প্রায় একাই জেতান ডন। কিছু প্রস্তুতি ম্যাচ আর সিরিজে মিলিয়ে ছয়টি ডাবল সেঞ্চুরি করেন। পাশাপাশি দশটি সেঞ্চুরি ও পনেরোটি হাফ সেঞ্চুরি মিলিয়ে তার মোট রান দাঁড়ায় প্রায় তিন হাজার, তাও আটানব্বই গড়ে। এখানে ব্যাপার হচ্ছে ডন ওপেনিং পজিশনে খেলেছিলেন এবং নট আউট থাকার সুবিধা তিনি হয়তো নিতে পারেননি। ওই অ্যাশেজ অজিরা ২-১ এ জেতে, ডন প্রায় ৯শ রান করেন।

১৯৩২-৩৩ এর অ্যাশেজেই ঘটে কুখ্যাত সেই বডিলাইন সিরিজ। ১৯৩২ সালের ওই সফরে ইংল্যান্ডের ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হন ডগলাস জার্ডিন। তিনি দলের দুই সেরা বোলার লারউড ও ভোসকে নিয়ে আলোচনায় বসেন। আর ব্রাডম্যানকে আটকাতে ক্রমাগত লেগ স্টাম্পে বল করে যেতে বলেন তিনি ওই দুজনকে। দুই বোলার ক্যাপ্টেনের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। ওই সিরিজে লারউড একাই নেন ৩৩ উইকেট। যার মধ্যে চারবার আউট করেন ব্রাডম্যানকে। বোঝাই যাচ্ছে, তিনি কতটা সফল ছিলেন ওই সিরিজে। স্যার ডন ব্রাডম্যানের গোটা ক্রিকেট ক্যারিয়ারের গড় ছিল ৯৯.৪। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই যে, জার্ডিন লারউডকে দিয়ে ব্রাডম্যানকে বেঁধেই ফেলেছিলেন বডি লাইন সিরিজে। কারণ ব্রাডম্যানের সিরিজে গড় ছিল মাত্র ৫৬.৫৭! জ্বি, মাত্র ৫৬.৫৭। পয়েন্ট- 'বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি গড়ের খেলোয়াড় মারনাস লাবুশেন, যার গড় ৬২.৫০।'

ডনের জীবনে কালো অধ্যায় বলতে গেলে একটাই। ১৯৪৮ সালে অবসরের আগে শেষ ইনিংসে মাত্র ৪টা রান করতে পারলেই গড় একশো হতো। কিন্তু নাহ! ডন পারেননি। এরিক হেলিসের লেগ স্টামে পিচ করে স্পিন করা বলটা ডনের উইকেট নিয়েছিল। ডনের গড় একশো হলো না, ডন প্রমাণ করে গেলেন- তিনিও একজন মানুষ, তবে সাধারণ মানুষ নন।

আচ্ছা মারভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স তাদের একটা সুপারহিরো চরিত্রে ডনকে বানাতে পারে না? নামের শেষে স্পাইডারম্যান, সুপারম্যানের মত ম্যান তো আছেই। ব্রাডম্যান রক্ষা করে না, ধ্বংস করে একজন বোলারের স্বপ্ন।

পৃথিবীতে ডন আর আসবেন না। তবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আমার মতো হাজারও ক্রিকেটপ্রেমী ডনের খেলা না দেখেই তার প্রেমে পড়ে যাবে।

লেখক: দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী, সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ, মাদারীপুর।

ঢাকা/ফাহিম

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়