ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

হোয়ান লাপোর্তা: বার্সেলোনার স্বপ্নের রাজপুত্র

আবু মুসা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৭, ১৭ মার্চ ২০২১   আপডেট: ০৭:৫০, ১৭ মার্চ ২০২১
হোয়ান লাপোর্তা: বার্সেলোনার স্বপ্নের রাজপুত্র

চলুন একটা গল্প শুরু করা যাক।

এক অখ্যাত আইনজীবীর বিখ্যাত হয়ে ওঠার গল্প।

২০০৩ সালের দিকের কথা, স্পেনের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব বার্সেলোনার নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়ে বসলেন হোয়ান লাপোর্তা নামের একজন। পেশায় যিনি একজন আইনজীবী এবং সাংগঠনিকভাবে কেউ তাকে তেমন জানে না। তাই নির্বাচনে আসার আগে ততটা দৃষ্টি আকর্ষণই করতে পারেননি। মূলত সংশ্লিষ্ট অনেকেই ভেবে নিলেন অখ্যাত এই সমর্থকটি নিজেকে পরিচিত করতেই যেন নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছেন।

বস্তুতপক্ষে ১৯৯৯ এর পর থেকে কোনও ট্রফি ক্যাম্প ন্যু তে না আসা যেন স্পেনের এই দলটির জন্য  তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের উপর চরম চপোটাঘাত হিসেবে হানা দিচ্ছিল। দিনশেষে তাই নির্বাচনটা জমেই উঠলো, একদিকে ভারেধারে এগিয়ে থাকা লুই বাসাত, অপরদিকে অনেকটা আনকোরা 'স্ট্রিক্ট' মানসিকতার লাপোর্তা। যার দরুণ লুই বাসাতের জয়ধ্বনি চারদিকে বাজতে লাগলো। বোর্ডের নতুন প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রধান  দাবিদার লুই বাসাতই। কিন্ত স্বপ্ন দেখা তরুণ আইনজীবী, এতদূর এসে থেমে যাবেন তা তো হয় না, স্বপ্নাতুর এই  আইনজীবী যেন মোক্ষম চালটা চাললেন শেষ রাতে। দাম্ভিক স্বরে ঘোষণা দিলেন, তিনি নির্বাচনে  জিতে গেলে ম্যানইউ থেকে ডেভিড বেকহ্যামকে নিয়ে আসবেন ক্যাম্প ন্যুতে। ডেভিড বেকহ্যাম তখন ইউরোপের সেরা উঠতি তারকা, অপরুপ সুদর্শন, মাঠের প্রতিটি পদক্ষেপে মোহিত করেন বিশ্বকে, শৈল্পিক খেলার দক্ষ শিল্পী তিনি, গোল বলের  প্রতিটি ছোঁয়ায় নিজেকে তুলে ধরেন উঁচু থেকে উঁচুতে।

"বেকহ্যাম ন্যু ক্যাম্পে আসবেন"- একটি বাক্যই যেন তার হয়ে নির্বাচন জিতিয়ে নিলো! প্রেসিডেন্টের আসনে বসলেন হোয়ান লাপোর্তা। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে সদর দপ্তরের প্রধান চেয়ারটাতে মোড় ঘুরে বসতে না বসতেই চারদিকে পাগলাটে এক দমকা বাতাসের ধাক্কা দেখতে পেলেন, তার সঙ্গে কথাবার্তা সম্পূর্ণ হওয়ার পরেও ডেভিড বেকহ্যাম চলে গেলেন রিয়াল মাদ্রিদে। যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখিয়ে নির্বাচন জিতলেন সেই বেকহ্যামই যখন কথা না রেখে উল্টো শত্রুর ঘরে, তখন শোচনীয় অবস্থায় কে না পড়ে!

ওদিকে বেকহ্যামের জায়গা পূরণে ম্যানইউ কিনে নিয়েছে স্পোর্তিং লিসবনের ওয়ান্ডারকিড ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে। লাপোর্তার প্রেসিডেন্সির অন্য কর্মকর্তারা তখন আরেকটি সিজন ভরাডুবির হতাশায় নিমজ্জমান।

ঠিক ওই মুহূর্তেই ২০০৩-০৪ মৌসুমের সাইনিং মোমেন্টের পাগলাটে বাতাসকে স্বচ্ছন্দে ড্রিবল করে লাপোর্তা পিএসজি থেকে নিয়ে আসলেন রোনালদিনহো গাউচোকে। এই সাইনিংয়েরর মধ্যমে যে নতুন যুগের শুরুটা করেছিলেন ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডকে ম্যানেজারের আসনে বসিয়ে। সে যুগটা তাকে দিয়ছিল বার্সার ইতিহাসের সর্বসেরা প্রেসিডেন্টের মর্যাদা। তার অধীনেই বার্সা তিকিতাকার জাদুতে অপাঙক্তেয় করেছিল সারা বিশ্বকে। হেক্সা শিরোপা জিতে নিয়েছিল গার্দিওলা মেসিদের সেই স্বর্ণ যুগ।

যুগ পেরিয়ে আজ আবার বার্সেলোনা ডুবতে বসা কোন জাহাজ যেন! মেসির দলকে ছেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা, অর্থনৈতিক মন্দা, টানা ৫ মৌসুম চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে যেতে না পারা। সব মিলিয়ে হুলস্থুল একটি পরিস্থিতিতে দক্ষ নাবিক হিসেবে সারেং হয়ে এসেছেন লাপোর্তা- যিনি স্বপ্ন দেখান, স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করেন।

হোয়ান লাপোর্তা:

হোয়ান লাপোর্তা (পুরো নাম  হোয়ান লাপোর্তা এস্ট্রুচ)  ১৯৬২ সালের  ২৯ জুন স্পেনের কাতালুনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। সে হিসেবে তিনি স্পেনীয় জাতীয়তাবাদ ধারণ করেন। পেশায় আইনজীবী এই ভদ্রলোক ২০০৩ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে বার্সেলোনাকে আমূল বদলে দেন। একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা ক্লাব হিসেবে বার্সাকে তৈরি করেন নিজ হাতে, অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতায়। ব্যাক্তিগত জীবনে লাপোর্তা বিয়ে করেছিলেন একজন সফল প্রেমিক পুরুষ হিসেবে কনসটানজা এচেভেরিয়াকে, তাদের দাম্পত্যজীবনে তিন পুত্র সন্তান রয়েছে। যাদের মধ্যে মেজ ছেলে পোল একজন ফুটবলার।  তিনি মিডফিল্ডে খেলে থাকেন।

বার্সেলোনা ক্যারিয়ার:

মজার ব্যাপার হলো, লাপোর্তার বার্সায় আগমন একটি চরম নেতিবাচক চরিত্র নিয়ে। লাপোর্তা ১৯৯৮ সালে বার্সেলোনার অভ্যন্তরে “এলিফান্তা দে ব্লু” তথা ব্লু এলিফ্যান্ট বা নীল হাতী" নামের একটি মিশনের নেতৃত্বের মাধ্যমে তার বার্সার সঙ্গে সম্পর্কের শুরু করেছিলেন।

ওই মিশনটা ছিল মূলত তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জোসেপ লুস নয়েজকে অনাস্থা ভোটে উৎখাতের মিশন। যদিও তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন।

যাইহোক, বার্সেলোনার প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি একটি ডুবন্ত জাহাজকে বাতাসের বেগে ধাবমান করিয়েছিলেন একান্ত নিজ দক্ষতায়। আজ এই দক্ষ নাবিকের সেঙ্গে ‘নৌবিহারে’ যাওয়া যাক, তার সফলতার প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা ঘুরে আসবো।

মূলত বার্সেলোনা নব্বইয়ের দশকের শেষদিক থেকে প্রায় দশটি বছর ট্রফিশূন্য কাটানোর ফলে বার্সেলোনা সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে অসন্তোষ ধুমায়িত হতে থাকে।  ক্লাব সর্বত্র অনিয়ম-দুর্নীতির মধ্যে আটকা পড়ে যায়। উল্টোদিকে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদ সফলতা অর্জন করছিল হেসেখেলে। এতে করে বার্সেলোনার সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও হীনমন্যতা দেখা দেয়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই যে, তখন ক্লাবের অবস্থা এমন ছিল, তৎকালীন কাতালুনিয়া কেন্দ্রিক টিভি মিডিয়ায় খেলোয়াড়দের থেকে লাপোর্তাই প্রধান তারকা হয়ে ওঠেন বলতে গেলে, ২০০৩-০৪ মৌসুমটা সবাইকে ধৈর্য ধারণের একপ্রকার অনুরোধ করেই তিনি তার নিজ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন।

ডেভিড বেকহ্যাম রিয়ালে চলে গেলেন, থিয়েরি হেনরি অঁরি আর্সেনালে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, রোনালদিনহো গাউচো এসেও কারও সহযোগিতা পাচ্ছিলেন না। এরপরের মৌসুমে তিনি বার্সার কোচ হিসেবে নিয়ে আসেন ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডকে। নতুন বোর্ড, অনভিজ্ঞ বোর্ড কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে লাপোর্তা দলকে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে নামলেন।

আগের ৬ বছরে কোনও মেজর ট্রফি জিততে না পারা দল থেকে মাত্র দুজনকে রেখে দিলেন- এডিন জেকো ও স্যামুয়েল ইতো এবং এরই সঙ্গে নিজস্ব প্রোডাক্ট হিসেবে লা মাসিয়া থেকে তুলে আনলেন কার্লোস পুয়োল, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাসহ অন্য খেলোয়াড়দের। অনভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের নিয়ে হলেও দুর্বোধ্য একটি টিম গঠনে সফল হন। ফলাফল আসলো হাতেনাতেই, ২০০৪-০৫ মৌসুমেই লিগ শিরোপা উদ্ধার করলেন।

এভাবে করে ধীরে ধীরে তিনি "স্বপ্নের দল", তথা ফুটবলীয় ভাষায় যাকে ড্রিম টিম বলা হয়, গড়ে তুললেন। ড্রিম টিমের শেষ তুলির আঁচড়টা দিতে লাপোর্তা দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন অনভিজ্ঞ গার্দিওলার হাতে। বার্সার কোচ হয়ে আসার আগে যার কোচিং ক্যারিয়ার ছিল মূলত বার্সা বি টিমের সঙ্গে।

মূল দলে কোচিং শুরুর প্রথম ম্যাচ গার্দিওলা হেরেছিলেন এবং পরের ম্যাচেও জিততে পারেননি, ড্র করেছিলেন। তবে এরপরে শুরু হয়েছিল কাতালুনিয়ার স্বপ্নের দলের স্বপ্নের যুগ। যে যুগটাতে ৪ বছরে ১৪টি শিরোপা ঘরে তুলেছিলেন গার্দিওলা।

তিকিতাকার বিধ্বংসী রুপ বিশ্বের সামনে উত্থাপন করেছিলেন গার্দিওলা। বিশ্বকে শাসন করেছিলেন আপন হাতের মুঠোয় পুরে। যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন এই তিকিতাকার মাধ্যমে।

বার্সেলোনার প্রেসিডেন্ট হিসেবে লাপোর্তার ট্রফিগুলো:

লা লিগা: দীর্ঘ ৫ বছরের খরা ঘুচিয়ে বার্সেলোনায় প্রথম মৌসুম শেষ করেন দুই নম্বর পজিশনে এসে। তার প্রেসেডেন্সির দ্বিতীয় বছরেই কাঙ্খিত ট্রফি ঘরে তোলেন। অর্থাৎ লাপোর্তার প্রেসিডেন্সিতে লা লিগায় শিরোপা কেস ছিলো এরকম-২০০৪-০৫ মৌসুমে মোট ৮৪ পয়েন্ট নিয়ে ১৭তম লিগ ট্রফি জয় করেন, ২০০৫-০৬ মৌসুমে ৮২ পয়েন্ট নিয়ে জয় করেন ১৮তম লিগ ট্রফি।

দুই বছর পরাক্রমশালী মাদ্রিদের কাছে অল্প ব্যবধানে লিগ ট্রফি হারালেও পুনরায় রাজত্ব ফিরে পান ২০০৮-০৯ মৌসুমে। এরপরেই আবার তার বিদায়ী বছর হিসেবে দলকে ট্রফি দিয়ে যান ২০০৯-১০ মৌসুমেও।

মোট ৪টি লিগ ট্রফি তুলে আনতে সক্ষম হন তার প্রেসিডেন্সিতে, অবশ্য ততদিনে পুরো ইউরোপ জুড়ে বার্সাফোবিয়া ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এই ত্রাণকর্তা। তার সময়ে বার্সা স্পেনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, বলা চলে পুরো ইউরোপেই। তার অন্যান্য ট্রফিগুলো ছিল:

কোপা দেল রে ২০০৮-০৯ মৌসুমে।

সুপার কোপা দে এস্পিনা: ২০০৫, ২০০৬ ও ২০০৯ সাল।

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছিলেন ২০০৫-০৬ মৌসুমে ও ২০০৮-০৯ মৌসুমে।

উয়েফা সুপার কাপ ২০০৯ সালে জিতেছেন এবং ২০০৯ সালের ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপাও।

তার রাজত্বে বার্সা কতটা ভয়ংকর ছিল, তার অনুমান করা যায় বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম ক্লাব হিসেবে বার্সার হেক্সা ট্রফি জয়ের মাধ্যমে। ২০০৮-০৯ সিজনে গার্দিওলা তিকিতাকা ফুটবলে বিশ্বকে বশ করেছিলেন মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তাদের পায়ের মোহময়ী জাদুতে।

গার্দিওলা, মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তারা ফুটবলকে পূর্ণতা দিয়েছিল ২০১০ ব্যালন ডি’অর গালা মঞ্চে। যখন একই সারিতে দাড়িয়েছিলেন বার্সেলোনার তিন প্রাণভোমরা- মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তা৷ যদিও মেসিই জিতে নিয়েছিলেন সেবার, ২০১০-ব্যালন ডি অর!

২০১৫ নির্বাচনে হেরেছিলেন বার্তোমেউ বোর্ডের কারচুপির কাছে, এবার বার্তোমেউ পদত্যাগ করে তবেই আসলেন লাপোর্তা। ফিনিক্স পাখির মতো বার্সাকে কী আবার উড়াতে পারবেন ইউরোপের মহাকাশে? স্বপ্নবাজ, এই অভিজ্ঞ সেনানায়কের কাছেই প্রশ্নটা রইলো।

কাতালুনিয়ার রাজনীতির এই তুখোড় খেলুড়ে সেনানায়কের হয়ে জবাবটা সময়ই দেবে।

 

লেখক: আবু মুসা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাকা/ফাহিম

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়